Type Here to Get Search Results !

রাজ-অতিথি রবীন্দ্রনাথ ( ত্রিপুরার কথা)ঃ জবা চৌধুরী, আমেরিকা

শীতের ছুটিতে দেশে গিয়ে ত্রিপুরায় বসে ত্রিপুরার ইতিহাস জানার চেষ্টা করছি নানা বই পড়ে ---এমনটি আগে কখনো হয়নি। গত ডিসেম্বরে অতিমারীর ভয় মনে নিয়েও যখন আমরা দেশে গেলাম, সাবধানতার কথা ভেবে ত্রিপুরার বাইরে আমরা পা রাখিনি। মাঝে মধ্যেই ঘুরে বেড়িয়েছি ত্রিপুরার নানা জায়গায়, যে সব জায়গায় আগে কখনো যাওয়া হয়নি। প্রতিবার নতুন জায়গায় গিয়ে মুগ্ধ হয়েছি আমাদের রাজ্যের সৌন্দর্য্যে, উন্নত জীবন-যাত্রার ইতিহাসের কাহিনীতে। 

ত্রিপুরার রাজাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগের কথা ছোটবেলায় পড়েছিলাম। এই সাহিত্য-প্রীতির টানেই একসময় রাজপরিবারের সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বের আত্মিকতা গড়ে উঠেছিলো।

১৮৮১ সাল। ৩৪টি সর্গে তখন প্রকাশিত হয় রবিঠাকুরের গীতিকাব্য 'ভগ্নহৃদয়' l লন্ডনে বেড়াতে গিয়ে সেখানে থাকাকালীন সময়ে তিনি শুরু করেছিলেন এই গীতিকাব্যের রচনা। বাংলায় লেখা এই গীতিকাব্য তখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের হাতেও এসে পৌঁছোয় রবিঠাকুরের 'ভগ্নহৃদয়' l 

ত্রিপুরার রাজবংশের নানা ইতিহাস থেকে জানা যায় মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন শিল্পের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রজাবৎসল। তিনি নিজেও কবিতা লিখতেন। রবিঠাকুরের 'ভগ্নহৃদয়' গীতিকাব্যে আপ্লুত হয়ে তিনি কবির কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন। আর সেই থেকে জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথের সাথে রাজপরিবারের নিবিড় সম্পর্ক।

বীরচন্দ্র মাণিক্যের জীবনকালে রবিঠাকুরের ত্রিপুরায় আসা না হলেও, মহারাজের সাথে তাঁর অক্ষুণ্ণ সম্পর্ক ত্রিপুরার পরবর্তী তিন রাজার সাথে জুড়ে দিয়েছিলো আজীবনের মতো। 

১৩০৬ বঙ্গাব্দ। সে বছর বসন্ত পঞ্চমীর দিনে প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরায় আসেন রাজ-অতিথি হয়ে। বীরচন্দ্র মাণিক্যের পুত্র রাধাকিশোর মাণিক্য তখন রাজার আসনে।

সেই সময়ের উপযোগী রাজকীয় অভ্যর্থনা ও আতিথেয়তায় রাজ পরিবারের সাথে কবির আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আগরতলার কুঞ্জবন এলাকায় তৎকালীন রাজপরিবারের প্রাসাদের কাছেই বানানো হয়েছিল অতিথিশালা 'মালঞ্চ নিবাস' যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরায় এলে থাকতেন। হয়তো অনেকেরই জানা নেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরায় এসেছিলেন সাতবার ।

নোবেল পুরস্কার লাভের পর ভুবনজোড়া খ্যাতি নিয়ে যখন কবিগুরু ত্রিপুরায় যান, আগরতলার উমাকান্ত একাডেমীতে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কবিকে সংবর্ধনা জানানো হয় ১৯১৯ সালের ১০ই নভেম্বর। সেটি ছিল মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের রাজত্বকাল।

ত্রিপুরায় কবিগুরুর শেষ সফর ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ই ফাল্গুন। সে বছর কবির সাথে এসেছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধু প্রতিমাদেবী, পৌত্রী নন্দিনী এবং আরও অনেকে। 

যাঁর লেখনী বিশ্বজোড়া বাঙালির সম্পদ, সেই কবির ত্রিপুরার প্রেক্ষাপটে লেখা 'রাজর্ষি' উপন্যাস , 'বিসর্জন' নাটক , 'মুকুট' গল্পগুচ্ছ  এবং বহু-সমাদৃত রবীন্দ্রসংগীত ---"বনে যদি  ফুটলো কুসুম", "এসো আমার ঘরে এসো" ইত্যাদি তাঁর লেখা আরও অনেক গান আমাদের চিরকালের গর্বের প্রাপ্তি হয়ে বেঁচে থাকবে। 

যদিও তারপর আর কবি ত্রিপুরায় যাননি। কিন্তু ত্রিপুরার রাজার সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ছিল। জানা যায় কবিগুরুর ৮০তম জন্মদিন ত্রিপুরার উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদে পালন করা হয়েছিল এবং তাঁকে 'ভারত ভাস্কর' উপাধিতে সম্মানিত করা হয়েছিল। মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বিশেষ দূত শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কবিগুরুর হাতে বিশেষ সম্মাননা সহ মানপত্রটি তুলে দিয়েছিলেন।

সময়ের সাথে সব পাল্টায়। আজ সেই বিশেষ সময়ের সাক্ষী হয়ে অনাদরে দাঁড়িয়ে থাকা 'মালঞ্চ নিবাস'কে দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় একসময় কী আভিজাত্য ছিলো সেই অতিথিশালার ! ওই বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে রাজ-অতিথি হিসেবে আড়ম্বরময় সময় কাটিয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর, তাঁর আবেগময় লেখনীতে দিয়ে গেছেন আমাদের ত্রিপুরাবাসীদেরকে চিরদিনের জন্য অনেক অনেক অমূল্য উপহার। 


জবা চৌধুরী, আমেরিকা


*এই লেখায় ব্যবহৃত তারিখগুলো ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত নানা বই থেকে নেওয়া হয়েছে।


ছবিঃ ডাঃ স্বপন চৌধুরী


১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.