করোনা আবহেও থেমে নেই ঐতিহ্য ও পরম্পরা। বাধা-বিপত্তি, কারফিউর নির্দেশনামা সবকিছুর পরেও রাজ্যজুড়ে ঘরে ঘরে পালিত হলো বাঙালির অন্যতম সেরা পার্বণ জামাইষষ্ঠী। সন্তান সন্ততি ও জামাইবাবাজীর মঙ্গল কামনায় মায়েরা আচারবশত: পালন করেছেন জামাই ষষ্ঠী ব্রত।
দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, আমজনতা থেকে সেলিব্রিটি সমাজের সর্বস্তরের ঘরে ঘরে সাধ্য অনুসারে সবাই আয়োজন করেছেন জামাইষষ্ঠীর। রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, অধ্যাপক, শিল্পী সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাদের ব্যস্ততম কাজের মধ্যেও ঐতিহ্য, পরম্পরা রক্ষায় আজকের দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করেছেন।বিধায়ক রামপ্রসাদ পাল ঠাসা রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যেও শাশুড়ি মা ঠাকুরুণের কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়েছেন জামাইষষ্ঠীতে।কথা হচ্ছিল রাজ্যের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার অমিতাভ রায়ের সঙ্গে। বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা: দেবলিনা দেববর্মণ হাসপাতাল, রোগী, ক্লিনিক সব দায়িত্ব সামলিয়েও শাশুড়ি মা কমলা দেববর্মনের কাছ থেকে জামাইষষ্ঠীর আশীর্বাদ নিয়েছেন। ডাক্তারের কথায় In busy schedule in hospital uniform, but rituals alive.রাজ্যের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অমিত ভৌমিক ও তাঁর সহধর্মিণী বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী তথা আগরতলা গভর্নমেন্ট মেডিকেল কলেজের গ্রন্থাগারিক শাওলী রায় আজ দুপুরে জয়নগরে মা মনিদীপা রায়ের কাছ থেকে ষষ্ঠীর আশীর্বাদ নিয়েছেন। মনিদীপা রায় একজন প্রবীণ অভিনেত্রী। সব দায়িত্ব সামলেও কন্যা ও জামাই বাবাজীর মঙ্গলার্থে মনিদীপা দেবী সাজিয়েছেন ষষ্ঠীর ঘট। নতুন বস্ত্র, উপহার, বাঁশের করুল, করমচা কিংবা তালপাতার পাখার বাতাস কোন কিছুরই ত্রুটি ছিল না। সেই সঙ্গে ছিল রসেবসে জামাইষষ্ঠীর ভুরিভোজ।ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট ল কলেজের সহকারী অধ্যাপক তথা বিশিষ্ট লেখক কানু নাথ সস্ত্রীক শ্বশুরবাড়িতে জামাই ষষ্ঠীর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। আশীর্বাদ নিয়েছেন শাশুড়ি মায়ের।
সন্তানের টান এমন নিবিড় যে করোনার তান্ডব ঘরে বেঁধে রাখতে পারে না। তাই কন্যা ও জামাইবাবাজীকে আশীর্বাদ করতে আগরতলা থেকে বেঙ্গালুরু ছুটে গেছেন তাদের বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী রাজীব চ্যাটার্জী ও তার স্ত্রী সুস্মিতা চ্যাটার্জি। মেয়ের ফ্ল্যাটেই আচারবসত ষষ্ঠী ব্রত পালন করেছেন। মেয়ে বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সৃজিতা চ্যাটার্জী এবং মেয়ের জামাই বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী অভিষেক ভট্টাচার্যকে মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদ দিয়েছেন। ঘর থেকে দূরে হলেও ঐতিহ্য বা পরম্পরার কোন ঘাটতি ছিল না।
বাংলার ঐতিহ্য ও পরম্পরায় নানা নামে ষষ্ঠী দেবী পূজিতা হন। যেমন জামাইষষ্ঠী মূলত স্কন্দ ষষ্ঠী বা অরণ্য ষষ্ঠী। সন্তান ও জামাইবাবাজীদের মঙ্গল কামনায় পরে এর নাম হয় জামাইষষ্ঠী। উল্লেখযোগ্য ষষ্ঠীর মধ্যে জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী বা জামাই ষষ্ঠী। যদিও এ বছরটা আষাঢ় মাসে পড়েছে। শ্রাবণ মাসে লুটন বা লুণ্ঠন ষষ্ঠী। ভাদ্র মাসে চাপড়া বা মন্থন ষষ্ঠী। আশ্বিন মাসের দুর্গা ষষ্ঠী বা বোধন ষষ্ঠী। অগ্রহায়ণ মাসে মূলা ষষ্ঠী, পৌষ মাসে পাটাই ষষ্ঠী, মাঘ মাসের শীতল ষষ্ঠী, চৈত্র মাসে অশোক ষষ্ঠী এবং নীল ষষ্ঠী। শিশুর জন্মের পর সূতিকা ষষ্ঠী, ষাট দিনে ষাট ষষ্ঠী, ২১ দিনে একুশে এবং শিশুর ১২ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি জন্মতিথিতে জল ষষ্ঠী দেবীর পূজা করা হয়। বিহারের ছট এবং সূর্যের সম্মানে ছট পূজা বা ষষ্ঠী পূজা পালন করা হয়। ঐতিহাসিক তথ্যে জানা যায়, বৈদিক যুগ থেকে এই জামাই ষষ্ঠী ব্রত উদযাপিত হচ্ছে। অষ্টম ও নবম শতকে বা খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পাওয়া যায় যার মধ্যে তিনি শিশুদের নিয়ে হিন্দু যুদ্ধ দেবতা স্কন্ধের সাথে যুক্ত। সময়ের বিবর্তনে এই লৌকিক দেবী ষষ্ঠী দেবীতে রূপান্তরিত হয়। লোক কাহিনী অনুসারে গৃহবধূ মাছ চুরি করে বেড়ালের কাঁধে দোষ চাপিয়েছিলেন। এই অপরাধে বাচ্চা হলেই বেড়ালটি তার সন্তান তুলে মা ষষ্ঠীর কাছে দিয়ে আসেন। বেড়াল হল মা ষষ্ঠীর বাহন। গৃহবধূর কাতর আর্তিতে মা ষষ্ঠী গৃহবধূকে তার সন্তান ফিরিয়ে দেন অরণ্যে। এর জন্য এই ষষ্ঠীর নাম স্কন্দ ষষ্ঠী বা অরণ্য ষষ্ঠী। অন্যদিকে মাছ চুরির অপরাধে শ্বশুর-শাশুড়ি সেই গৃহবধূর পিতৃগৃহে যাওয়া বন্ধ করে দিলে ব্যাকুল মা-বাবা ষষ্ঠী পুজোর দিনে জামাইকে নিমন্ত্রণ জানান শ্বশুরালয়ে। তারপর থেকে ষষ্ঠী পুজো পরিণত হয় জামাইষষ্ঠীতে। যদিও এই লোককাহিনীর কোন প্রামাণ্য তথ্য সূত্র নেই। সে যাই হোক, পুত্রকন্যা বা জামাইবাবাজীর মঙ্গলার্থে আজকের আত্মকেন্দ্রিক সময়ে একটা পার্বণ যদি পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্ককে আরো মিষ্টি মধুর করে তোলে তাহলে ক্ষতি কোথায় ?
আরশিকথা হাইলাইটস
১৬ই জুন ২০২১