বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক মহিবুল আলমের দীর্ঘ উপন্যাস 'জোড়া সিঁথি নদীর তীরে' পড়ে যার পরনাই মুগ্ধ হলাম। এই প্রথম নয়, বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে তিন খণ্ডে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'তালপাতার পুঁথি' লিখেছেন তিনি। সেটাও দীর্ঘ উপন্যাস।
'জোড়া সিঁথি নদীর তীরে' উপন্যাসের নায়ক চরিত্রের নাম রাকিব অর্থাৎ রাকিবুল আলম। ডাক নাম আঁখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার সময় 'উঠোনের কোষকাব্য' নামে একটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছিল রাকিব। জীবনের বিড়ম্বনায় আজ সে নিউজিল্যান্ডের একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে কাজ করে। যে রাকিব ক্লাসে কখনও প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হত না। এমনকী উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেয়েছিল, সেই রাকিবকে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে লড়াই করে মাথাগোঁজার জায়গা তৈরি করতে হয়েছে। আপেল বাগানে শ্রমিকের কাজ করতে হয়েছে। লড়তে লড়তে অর্থের সংকট এখন আর নেই।
রাকিব সুখী মানুষ হলেও মনের ভেতর তার কোথাও যেন দুঃখী মানুষেরই বাস। কারণ সেই কোন ছোটবেলায় তাঁর মা দক্ষিণ কাজীবাড়ির মোখলেস জায়গীর মাস্টারের হাত ধরে চলে যায়। কাজী বাড়িতে রাকিবের মায়ের মতো এমন সুন্দরী আর দ্বিতীয়টি ছিলেন না। প্রায় উনিশ বছর পর মায়ের সঙ্গে দেখা। বাবার মতো স্ত্রী হারানোর যন্ত্রণা তাকেও কুড়ে কুড়ে খায়। নিউজিল্যান্ডে আসার পর বিদেশিনী এমেন্ডার সঙ্গে ভাব ও পরে বিয়ে হয়। কিন্তু ভাগ্য সাথ দিল না। এমেন্ডা একদিন পরপুরুষের হাত ধরে চলে গেল। তখন থেকে রাকিবের ছন্নছাড়া জীবন। পরে ঢাকা থেকে ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা বৃষ্টির সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়। রাকিব অন্তর্মুখী স্বভাবের হলেও বৃষ্টির কাছে ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরে। গল্পের নায়ক রাকিবের জীবনে তিনজন নারী আসে। সেই কোন ছোটবেলায় ছোটচাচি সাদিয়া। নিউজিল্যান্ডে তাঁর বিবাহিত স্ত্রী এমেন্ডা ও শেষে বৃষ্টি।
লেখক মহিবুল আলম এই দীর্ঘ উপন্যাসে অনেকগুলো ডাইমেনশন রেখেছেন। ফলে পাঠকের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে না এই উপন্যাস। উপন্যাসের ফাঁকে ফাঁকে নিউজিল্যান্ডের অপরূপ প্রকৃতির বর্ণনা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। লেখকের দেশের বাড়ি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার উপজেলা মুরাদনগরের সঙ্গে সেখানকার পল্লি-প্রকৃতি, গোমতী নদীর সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের প্রকৃতিকে মিশিয়ে দেন। নিউজিল্যান্ডের দীর্ঘতম নদী ওয়াইকাটো, প্রশান্ত মহাসাগরের বর্ণনা ফুটে ওঠে। উপন্যাসের গল্প ও কথনে বৈচিত্র আনতে সেখানকার মাউরি উপজাতির ইতিহাস পরতে পরতে ব্যবহার করেছেন যা পাঠকের রসাস্বাদনে অভিনবত্ব আনে।
এই উপমহাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের সংস্কৃতির বিস্তর ফারাক। লেখক সেই বৈপরীত্যকে উপন্যাসে লেখার উপজীব্য করে তুলেছেন। বিদেশ-বিভুঁইয়ের শেকড়হীন জীবনের ছবিটা খুবই স্পষ্ট। লেখকের হলিউডি ও বিদেশি সিনেমা নিয়েও বেশ চর্চা আছে। রাকিব চরিত্রের মধ্যে সেসবও পাঠক খুঁজে পান। রাকিব কখনও রাসেল ক্রোর 'গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমা দেখেন। কখনও অস্ট্রেলিয়ান ছবি 'ব্ল্যাক ওয়াটার'। আবার কখনও ব্রিকলেস উপন্যাস অবলম্বনে 'ব্রিকলেশ' মুভি দেখেন।
রাকিব, ছোটচাচি সাদিয়া, এমেন্ডা, বৃষ্টি ছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে যেমন ইউরোপিয়ান সাদা বা পাকিহা মহিলা রিনেই ভাবি, আতিক, রাকিবের মা, ছোটফুফু রুনা, জাহিদ, নাজমুল আহসান, আজমল হোসেন, শিমুল ভাবি, নদীর শিক্ষক প্রফেসর ড. নিকোলাস রজারসন প্রভৃতি।
নিউজিল্যান্ডের পল্লিপ্রকৃতি ও এলাকা সম্পর্কে লেখক মহিবুল আলমের বাস্তব অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। সেই সৌন্দর্য তাঁর উপন্যাসের বর্ণনায়, 'রাকিব ভাবল, সে জীবনে অনেক সৌন্দর্যই উপভোগ করেছে। নিউজিল্যান্ডের প্রতিটা বাঁকই তো সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো। পৃথিবীর 'ন্যাচারাল বিউটি' বা 'গ্রিন হ্যাভেন' বলতে যা বোঝায় তা এই নিউজিল্যান্ডেই আছে।'
এমেন্ডা রাকিবের স্ত্রী। কিন্তু লেখক ছোটচাচি ও বৃষ্টির জন্য যতখানি পৃষ্ঠা বরাদ্দ করেছেন, এমেন্ডার জন্য সেই পৃষ্ঠা বরাদ্দ করেননি। সে যাইহোক, রাকিবকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অবশেষে অনুশোচনা আসে এমেন্ডার মধ্যে। লেখকের বর্ণনায় সেই কাহিনিই উঠে আসে, 'এমেন্ডা ঝুঁকে রাকিবের একটা হাত মুঠো করে ধরে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিও, প্লিজ। আমাকে ক্ষমা করে দিও। রাকিব তার হাতটা টেনে নিতে গিয়ে নিল না। হাতের স্পর্শে সে তৎক্ষণাৎ এমেন্ডার সেই আগের উষ্ণতা অনুভব করল। সে দেখল, এমেন্ডার চোখ ভিজে আসছে। রাকিব মূক হয়ে তাকিয়ে রইল। ওয়েটার তখনই কফি ও চকলেট মফিন নিয়ে এল।...রাকিব বুঝতে পারল, কাছাকাছি থাকার চেয়ে বিচ্ছিন্নতাতেই ভালোবাসা গভীরে জিইয়ে থাকে।'
আলোচক- বিবেকানন্দ বসাক, কোচবিহার
১লা আগস্ট ২০২১