আজীবন সত্যের পূজারী জাতির জনক মহাত্মাগান্ধীর সাথে আমরা কম বেশী সবাই পরিচিত। কিন্তু ঊনার শিক্ষাভাবনা নিয়ে আমরা তেমনভাবে পরিচিত নই। স্বাধীনতা সংগ্রামে ঊনার লড়াই, আত্মত্যাগের কথা আমরা সবাই জানি। সকল সম্প্রদায়ের সম্মিলিত ভারত গঠনে উৎসর্গিত ছিল তাঁর জীবন। এককথায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি।
গান্ধীজী যদিও বিশেষভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক সমস্যা নিয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময় চিন্তাভাবনা করেছেন তবুও তার মনে ধারণা ছিল রাজনৈতিক, সামাজিক চেতনা জাগ্রত করার জন্য দেশবাসীর একটি আদর্শ শিক্ষার প্রয়োজন। দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দরকার সুনাগরিক, দায়িত্বশীল নাগরিক আর তাদেরকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা। এই শিক্ষার কথা উপলব্ধি তিনি করেছিলেন তার জীবন দিয়ে। যখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় টলস্টয় ফার্মে ছিলেন এবং পরবর্তী কালে ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সময় তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ভারতকে দিয়েছিলেন একটা নতুন শিক্ষার উপহার।
তাঁর শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা দেখি ব্যক্তিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদের সমন্বয়। একদিকে তিনি শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত দৈহিক, মানসিক, আধাত্মিক সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ আর অন্যদিকে উৎপাদনশীল নাগরিক তৈরি করার জন্য কর্মকেন্দ্রিক বুনিয়াদি শিক্ষা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার উদ্দেশ্যে চরিত্র গঠন ও নাগরিকতা শিক্ষার কথা বলেছেন, সাথে হস্তশিল্পের উপর ও তিনি বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। যার দরুন তাঁর শিক্ষাদর্শে ভাববাদ ও প্রয়োগবাদ দুটোরই প্রভাব দেখতে পাই। ঈশ্বরে বিশ্বাসী গান্ধীজির ধারণা ছিল জীবের সৃষ্টি ঈশ্বর থেকে এবং আত্মোপলব্ধি দ্বারা সে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে হবে। আর শিক্ষা এই আত্মোপলব্ধি প্রাপ্তিতে আমাদের সাহায্য করবে। আমরা যদি গান্ধীজীর জীবন দর্শনের সাথে পরিচিত হই তাহলে দেখি গান্ধীজী যিনি বুদ্ধের জীবন দর্শন থেকে সংগ্রহ করেছিলেন অহিংসা নীতি আর টলস্টয় যে ছিল তার প্রিয় লেখক তার চিন্তাভাবনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর কাছ থেকে নিয়েছিলেন মানবপ্রেম ও শ্রমের মর্যাদার মূল্যবোধে।আর এই দুইজনের মিলিত ভাবনাকে তিনি শিক্ষায় কার্যকরী করেছিলেন এবং অহিংসা মানবপ্রেম ও শ্রমের মর্যাদা এই তিনটি পাতার উপর ভিত্তি করে তিনি রচনা করলেন নতুন শিক্ষা পরিকল্পনা, আর সেটাই হল বুনিয়াদি শিক্ষার পরিকল্পনা। যা তিনি সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে জনগনের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। টলস্টয় ফার্মে তিনি প্রথম তার শিক্ষা পরিকল্পনার সূত্রপাত করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে ওয়ার্ধায় তার শিক্ষাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ডক্টর জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। যা পরবর্তী কালে ওয়ার্ধা পরিকল্পনা বা বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনা নামে জানি।
এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল শিশুর দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক জীবনের বিকাশ সাধন করা। গান্ধীজী বলেছেন, এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে কোন একটি হাতের কাজকে শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তিনি তার শিক্ষাদর্শনে সার্বজনীন অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক উৎপাদন কেন্দ্রিক বৃত্তিমুখী শিক্ষা মানব জীবনকে ঘিরে গড়ে উঠবে এই কথা বারবার বলেছেন। গান্ধীজী শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, " By education I mean an allround drawing out of the best in child and man-body, mind and spirit"
গান্ধীজী বিশ্বাস করতেন, "শরীর গড়ে না উঠলে বুদ্ধির বিকাশ সম্ভব নয়, দেহ- মন-আত্মা একই সঙ্গে বিকাশিত না হলে শিক্ষার ধারা অসম্পূর্ণ একপেশে হবে।" গান্ধীজীর শিক্ষা দর্শনে গড়া সমাজ এমনই হবে যেখানে সকলেই নিজগুণ প্রবণতা, আগ্রহ অনুসারে দক্ষ হবার সুযোগ পাবে, তাই শিক্ষাই হল সমাজ পরিবর্তনের যথার্থ হাতিয়ার। এই শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি গ্রাম ও শহরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে একটি আদর্শ উৎপাদনশীল সমাজতাত্ত্বিক ভারত গড়তে চেয়েছিলেন। যদিও তার শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি কিন্তু এর জন্য গান্ধীজী নয়, দেশবাসীর অযোগ্যতাই ছিল তার সঠিক বাস্তবায়নের পথে প্রধান অন্তরায়। আজকাল আমরা যে অঙ্গনওয়ারী বিদ্যালয়গুলোতে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা দেখি তা কিন্তু গান্ধীজীর শিক্ষাপরিকল্পনা থেকেই নেওয়া। এই যে আজকাল শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা মানব সম্পদ উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের কথা শুনি যদিও তা আজও সে ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয়নি তথাপি সেই চিন্তা ভাবনার কথা কিন্তু গান্ধীজী আজ থেকে সেই ছয় থেকে সাত দশক আগেই প্রথম চিন্তাভাবনা করেছিলেন। যাইহোক ভারতীয় রাজনীতির জীবনে যেমন গান্ধীজীর অবদান অনস্বীকার্য ঠিক তেমনি শিক্ষার ইতিহাসে গান্ধীজীর অবদান অমূল্য। তার গভীরতা, প্রাসঙ্গিকতা, ব্যবহারযোগ্যতা আজও সেই সমানভাবে কার্যকরী।
সুস্মিতা এস. দেবনাথ
আরশিকথা গ্লোবাল ফোরাম
আরশিকথা সাহিত্য-সংস্কৃতি
২রা অক্টোবর ২০২১