সুদীর্ঘ দুইশ বছরের ব্রিটিশ অপশাসনের কুফল, শোষণ, বঞ্চনা, দমন-পীড়নে জর্জরিত ভারতবাসীর হৃদয়-বেদনা, সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন এক ভারতীয় স্বদেশপ্রেমী, সত্যাগ্রহী মহামানব, যার নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যার জনমোহিনী নেতৃত্বে, ব্যক্তিত্বে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-
খৃষ্টান-শিখ-জৈন নির্বিশেষে সকল অংশের মানুষ যার অমোঘ আহবানে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনে। ১৯৪২ সনে গান্ধীজীর উত্তোলিত তর্জনী নির্দেশ-'ইংরেজ, ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের তীব্রতায় কেঁপে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী প্রবল ইংরেজ শক্তি। আলোড়িত হয়েছিল ভারতের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা তথা সর্বস্তরের জনগণ। ভারত উপমহাদেশের মানুষ গান্ধীজীর আহবানে অহিংস পন্থায় স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জনে আত্মনিবেদন করতে দ্বিধা করেনি। মূলত তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বেই ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সনের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে 'মহাত্মা' রূপে প্রথম সম্বোধন করেন। শান্তিনিকেতনের উন্নয়নকল্পে গান্ধীজী যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন অর্থ সংগ্রহ করে, নৈতিক সমর্থন দিয়ে। তিনিই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথকে 'কবিগুরু' নামে প্রথম অভিহিত করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম সম্বোধন করেছেন 'গুরুদেব' নামে।
১৯৪১ সনে কবিগুরুর মহাপ্রয়াণ ঘটে। গান্ধীজী সংবাদ শুনে তাঁর আত্মার সদগতি কামনায় প্রার্থনা সভার নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলেন। স্বাধীন ভারতের রক্তিম সূর্য দেখা হলোনা কবিগুরুর। অবশ্য দেশভাগের বেদনাও তাঁকে সহ্য করতে হয়নি। দেশের মানুষ গান্ধীজিকে 'জাতির পিতা'রূপে বরণ করে নিল। অনুরাগী জনেরা 'বাপুজী' নামেও সম্বোধন করে পিতার আসন দিল। মহাত্মা গান্ধী ১৮৬৯ সনের ২রা অক্টোবর গুজরাট প্রদেশের পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কাবা গান্ধী। মাতৃদেবীর নাম পুতলি বাঈ। পিতা কাবা গান্ধী ছিলেন সত্যাশ্রয়ী, ন্যায়পরায়ণ ও ধর্মশীল ব্যক্তিত্ব। গান্ধীজী স্কুলজীবন শেষ করে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত যান। পাশ করে ১৮৯১ সনে ফিরে এলেন স্বদেশভূমে। দেশপ্রেমিক দাদাভাই নওরোজি, গোপালকৃষ্ণ গোখলের সান্নিধ্য তাঁকে অধিকতর ভাবে ঋদ্ধ করলো। ভারতে পরাধীনতার অন্ধকার সম্পর্কে গান্ধীজীর ধারণা আরো স্পষ্ট হলো।
ইতিমধ্যে গান্ধীজিকে একটি মামলার কাজে দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতে হয়েছিল। সেখানে বর্ণবিদ্বেষী ঔপনিবেশিক ইংরেজ শক্তির দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গরা নানাভাবে অত্যাচারিত, শোষিত, বঞ্চিত হচ্ছিল। স্বয়ং গান্ধীজীকেও 'কালা আদমি' বলে নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়। গান্ধীজী এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। দক্ষিণ আফ্রিকাবাসি ও প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে গান্ধীজী গড়ে তুললেন 'নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস।' যে মামলা সূত্রে গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালে গিয়েছিলেন সত্যের পথে তিনি সে মামলায় জয়লাভ করেন। তাঁর মক্কেল বেকসুর খালাস পায়। তিনি উপলব্ধি করলেন-সশস্ত্র দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে নিরস্ত্র মানুষের ঐক্যবদ্ধ অহিংস সত্যাগ্রহই শ্রেষ্ঠ পন্থা। এতে সময় লাগে বেশি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া অধিকাংশ মানুষই অস্ত্র ধরতে চায় না। অহিংসা মন্ত্রের দেশ ভারতবর্ষ। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাফল্যে, অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ গান্ধীজী ১৯১৪-১৫ সাল নাগাদ স্বদেশে ফিরে এলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিক্ষরা আবহেই তিনি ১৯২০ সনে দেশবাসীর স্বাধীকার অর্জনের লড়াই শুরু করেন। তিনি ছিলেন আজীবন হিংসামুক্ত বিশ্বের স্বপ্নদ্রষ্টা মহামানব। অহিংস সত্যাগ্রহ এর মাধ্যমে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা লাভ সম্ভব-এই ছিল তাঁর স্থির বিশ্বাস। হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা তাঁকে পীড়া দিত। তাই তিনি অস্পৃশ্যতার অন্ধকার দূরীকরণে সচেষ্ট হন। অশিক্ষার অন্ধকারও দেশের সামনে ঘোর সংকট, এটা উপলব্ধি করে তিনি শিক্ষা সংস্কারেও হাত দিলেন। তিনি জানতেন-শিক্ষা, সংহতি, পরিশীলিত ধর্মজ্ঞান, ভেদরেখামুক্ত ভালোবাসার শক্তি অপরিসীম।
১৮৮৫ সনে গঠিত হলো 'ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।'গান্ধীজীর হাতেই রইল সর্বোচ্চ নেতৃত্বভার। ১৯২৯ সনে জাতীয় কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে তিনি প্রথম 'স্বরাজ' অর্থাৎ 'আমরাই আমাদের নিজেদের মতো করে শাসন করবো'-এই দাবি তুললেন। স্বরাজ লাভের লক্ষ্য নিয়ে শুরু হলো আইন অমান্য আন্দোলন। ডান্ডি অভিযানে তিনি ব্রিটিশ সরকারের নিষেধ অমান্য করে নিজের হাতে সমুদ্র থেকে লবণ সংগ্রহ করেন। সঙ্গে ছিলেন ৫৯ জন সত্যাগ্রহী অনুগামী। ২০০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে তিনি এই আন্দোলন সফল করেন।
১৯৪২ সনে গান্ধীজীর নেতৃত্বে শুরু হলো 'ইংরেজ, ভারত ছাড়ো' আন্দোলন। আগস্ট মাসে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল বলে একে আগস্ট আন্দোলনও বলা হয়। গান্ধীজিকে ব্রিটিশ সরকার কারাবন্দি করে আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চাইলেও সফল হয়নি। বহু নেতা-নেত্রীও কারারুদ্ধ হলেন। আন্দোলন থামল না। ১৯৪৩ সনে গান্ধীজী কারাগারে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। দেশবাসীর ওপর দমন-পীড়ন, কারাবন্দীদের উপর অকথ্য অত্যাচার এর বিরুদ্ধে ছিল তাঁর ২১ দিনব্যাপী অনশন ধর্মঘট।
ব্রিটিশ শক্তির কূটচালে এবং কিছু অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের ইন্ধনে নানা স্থানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হলো। দেশের জাতীয় সংহতি বিপন্ন হলে স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন বিঘ্নিত হয়, তেমনি আত্মঘাতী, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা দেশের অর্থনীতি, সামাজিক বাতাবরণ, রাজনৈতিক শক্তিকেও দুর্বল করে। গান্ধীজী বিচলিত হলেন। দাঙ্গাকবলিত নানা অঞ্চলে ছুটে গেলেন। অবশেষে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ল। ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের মানচিত্র ধরিয়ে দিয়ে ইংরেজ শক্তি ক্ষমতা হস্তান্তর করল।
গান্ধিজীর বিখ্যাত গ্রন্থ গুলির মধ্যে আছে-'আমার ধ্যানের ভারত', 'নঈ তালিম', 'সর্বোদয় ভাবনা', প্রভৃতি নানা প্রজ্ঞাসিদ্ধ গ্রন্থ। ভারতে জাতীয় শিক্ষানীতির তিনিই প্রথম পথ প্রদর্শক। জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক, জাতিভেদ প্রথার ঘোরবিরোধী সমাজ সংস্কারক, শিক্ষা সম্প্রসারক, শিক্ষাবিদ। রামধুন সহ নানা সংগীতের সুধা রসে ভরপুর ছিল তাঁর প্রার্থনা সভা। সাংস্কৃতিক চেতনাতেও তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের গভীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন গান্ধীজী। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন নানা ভাবে তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়েছে। গান্ধীজীও রবীন্দ্রনাথকে প্রগাঢ় শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন আজীবন।
দেশ ও জাতির অবিসংবাদি নেতৃত্ব, জাতীয় সংহতি রক্ষায় আজীবন নিষ্ঠাবান মহাপুরুষ গান্ধীজী শত চেষ্টা করেও দেশভাগ বন্ধ করতে পারেননি। তারই মন্ত্র শিষ্যগণের কেউ কেউ দুই মেরুতে অবস্থান নিলেন। অভিমানী পিতৃস্থানীয় গান্ধীজী সবরমতী আশ্রমে চলে গেলেন পর্ণকুটিরে, ইন্দ্রপ্রস্থের বহুদূরে, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুকে পেছনে ফেলে। ১৯৪৮ সনের ৩১ জানুয়ারি প্রার্থনা সভায় নাথুরাম গডসে নামক এক বিভ্রান্ত তরুণের গুলিতে তিনি নিহত হন। গান্ধীজিকে হত্যা করা গেলেও তার চিন্তা-চেতনা আজও ভারতবর্ষে সমভাবেই সমাদৃত, প্রাসঙ্গিক।
ডঃ আশিস কুমার বৈদ্য
উপদেষ্টা
আরশিকথা গ্লোবাল ফোরাম
আরশিকথা হাইলাইটস
২রা অক্টোবর ২০২১