Type Here to Get Search Results !

ধমনীতে আমাদের বঙ্কিম পরম্পরাঃ জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা

বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষরিক অর্থে বাংলা কথাসাহিত্যকে কৌলিন্য দান করেন। মধ্যযুগীয় রীতিনীতির বেড়াজাল ছিন্ন করে গঠনশৈলীর নান্দনিক উৎকর্ষে, চরিত্র চিত্রণের মুন্সিয়ানায়,  মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বাংলা ভাষা সাহিত্যকে এক লাবণ্যময় উৎকর্ষের স্থায়ী ভিত্তিভূমির উপর সাহিত্য  প্রতিষ্ঠিত করেন । যে সময় শিক্ষিত মানুষ ভাবতেই পারত না বাংলা ভাষার মাধ্যমে অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে সে সময় দুই বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, আসাম মিলিয়ে বৃহত্তর বাঙালি সমাজ বিস্তৃত ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র নিরন্তর এই বাঙালি সমাজের জন্য ভেবেছেন, কাজ করেছেন। বাঙালির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তথা বাঙালিয়ানার অভিজ্ঞানকে তুলে ধরতে তিনি 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। আমরা সবাই জানি বাঙালির চিন্তা-চেতনার রূপান্তর সাধিত হয়েছিল এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে। 'বঙ্গদর্শন'পত্রিকার জন্য তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালি উন্মুখ হয়ে  থাকতেন।

     বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করে বলেছিলেন -'সাহেবেরা পাখি শিকার করিতে গেলে তাহা লইয়া ইতিহাস রচিত হয়, কিন্তু বাঙালি জাতির নিজস্ব কোনো ইতিহাস নাই!'তাই তিনি বাঙালির গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস ও পরম্পরাকে লিপিবদ্ধ করতে তৎপর হয়েছিলেন। বাঙালির জীবন, দর্শন, ধর্ম, জীবিকা, বিজ্ঞান সাধনা  অর্জন প্রতিটি ক্ষেত্রকে তিনি গ্রন্থের মধ্যে ধরে রাখার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

       ব্যক্তিগত জীবনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছেন। সরকারি কার্য দক্ষতার সাথে সম্পাদন করেছেন। পাশাপাশি উপন্যাস, প্রবন্ধ, পত্রিকা সম্পাদনা,  সমালোচনা,সাহিত্য  রচনার গুরুদায়িত্ব সমান নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন। তার সময়ে বাংলা সাহিত্যে তিনি ছিলেন মহীরুহ ও সর্বজনগ্রাহ্য অভিভাবকতুল্য ব্যক্তিত্ব। নবীন লেখকরা তার একটু মতামত পাবার আশায় ব্যগ্র হয়ে থাকতেন। বঙ্কিমচন্দ্র নবীন লেখকদের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, '  যাহা নিখিল সমাজের তথা দেশের মঙ্গল সাধিত হয় অথবা যাহাতে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাহা লিখিবে। নাম, যশের জন্য লিখিবে না, লেখা ভালো হইলে নাম যশ এমনিতেই হইবে।'যে রচনা সকলেই বুঝিতে পারে এবং পড়িবা মাত্র  অর্থগৌরব   বুঝা যায়।অর্থ গৌরব থাকলে তাহাই সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা।'

রবীন্দ্রনাথ তাঁর অগ্রজ সাহিত্যিক সম্পর্কে বলেছেন- 'নতুন যুগের জোয়ার  এসেছিল বঙ্কিম মনীষার হাত ধরে। বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাবে এক লহমায় বাংলা সাহিত্য তার মধ্যযুগীয় গণ্ডি পেরিয়ে আধুনিক যুগে উত্তীর্ণ হয়েছিল। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভগীরথ ছিলেন।'অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্রও উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর সারস্বত উত্তরাধিকারের দায় বর্তাবে সুযোগ্য প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের উপর।

       শ্রী অরবিন্দ বঙ্কিমচন্দ্র কে 'ঋষি'আখ্যা দিয়েছিলেন। 'বন্দেমাতরম' মন্ত্র তিনি তুলে দিয়েছিলেন পরাধীন দেশবাসীর হাতে। একটি সঙ্গীত সমগ্র দেশকে একসূত্রে বাঁধতে পারে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা দিতে পারে, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের বেয়নেটের সামনে বা ফাঁসির মঞ্চে মহান বিপ্লবীরা হাসতে হাসতে জীবন উৎসর্গ করতে পারে সমগ্র বিশ্বে এই নজির বিরল। জাতীয়তাবাদী এই বীজমন্ত্রকে ব্রিটিশ রাজশক্তি ভয় পেয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।

     'বন্দেমাতরম' সংগীত সম্পর্কে একটি গল্প বলতে ইচ্ছে করছে। তখন 'বঙ্গদর্শন'পত্রিকার পেজ মেকআপ চলছে। একটার পর একটা সীসার টাইপ সাজিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে' পত্রিকার অবয়ব। ডেডলাইন পেরিয়ে যাচ্ছে, ছাপা শুরু করতেই হয়, একটা ছোট ম্যাটার খুব দরকার হাতে কোন বিজ্ঞাপনও নেই, দ্রুত পাতা ভরাতেই হবে।

বঙ্গদর্শনের তৎকালীন কর্মাধ্যক্ষ রামচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজ নিয়ে বললেন,'এইযে গীতটি আপনার এখানে লেখা আছে, উহা নেহাত মন্দ নয়, এটা দিন না কেন'?

বঙ্কিমচন্দ্র তখন বিরক্ত হয়ে তার হাত থেকে কাগজটি নিয়ে দেরাজে রেখে বলেছিলেন- 'উহা ভালো না মন্দ, তুমি বুঝিতে পারিবে না। কিছুকাল পরে উহা বুঝিবে, তখন আমি হয়তো জীবিত থাকিব না, তুমি থাকিলেও থাকিতে পার।'

    ১৮৯৪ সালে ৮ এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্রের মহাপ্রয়াণের পর ৪-৫ বছর যেতে না যেতেই 'বন্দেমাতরম'হয়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের স্বদেশ চেতনা তথা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বীজ মন্ত্র।আমরা জানি "বন্দেমাতরম" সংগীতটি প্রথম প্রকাশিত হয় "আনন্দ মঠ ",উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে।

      কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রাজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্র ব্রিটিশ রাজশক্তির অধীনে কাজ করলেও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে চিরকালই গর্জে উঠতেন। অনেক ইংরেজদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। তিনি সমুচিত জবাব দিয়েছেন বেয়াদব ইংরেজদের। বঙ্কিমচন্দ্রকে হেনস্থা করতে বারেবারে তাঁকে বদলি করা হয়েছে, এতে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে বারবার। তার ধ্রুপদী উপন্যাসগুলি বাংলা সাহিত্যের সম্পদ।

   শুধু জন্ম দিবস বা প্রয়াণ দিবসে প্রথাগত সম্মান -স্মরণ অনুষ্ঠান নয়, বঙ্কিমচন্দ্রের দেশমাতৃকার প্রতি অগাধ ভালোবাসার মন্ত্র ও জীবনাদর্শে আমরা নতুন করে শপথ নিই, দেশ ও জাতিকে নতুন শিক্ষা ও বোধের হিরন্ময় আলোকে গড়ে তুলি। কারণ সবার আগে দেশ ...... দেশের জনগণ।

সমস্ত ধর্মকে বঙ্কিমচন্দ্র সমান সম্মান করে একাসনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধর্মতত্ত্ব বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে গুরুর মুখে তিনি বলেছেন নিজস্ব বিশ্বাসের কথা - 'তিনি ঈশ্বর হউন বা না হউন আমি তাহাকে নমস্কার করি। যিনি একাধারে শাক্যসিংহ, যীশু খ্রীষ্ট, মহম্মদ ও রামচন্দ্র। যিনি সর্ববলাধার, সর্বগুণাধার, সর্বধর্মবেত্তা, সর্বত্র প্রেমময়, তিনি ঈশ্বর হউন বা না হউন, আমি তাঁহাকে নমস্কার করি। বঙ্কিমচন্দ্র প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতিসত্তা তথা ভারতীয় জাতিসত্তার পথিকৃত অগ্রণী প্রাণপুরুষ,নবজাগরণের অগ্রদূত, আপোষহীন এক শুদ্ধতার অভিযাত্রী। তাঁর প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষার উত্তরাধিকার আজ আমাদের হাতে। অতিমারির আগ্রাসনে ছন্দহীন আমরা। আসুন তাঁর ১২৯ তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে নতুন করে বাংলা ভাষার ঐতিহ্য ও পরম্পরা  রক্ষার শপথ নিই। শিকড় না বাঁচলে মহীরুহ বাঁচেনা, আমরা চর্যাপদের গৌরবময় উত্তরাধিকার কে মানবহিতে লালন ও প্রসারিত করি, শান্তি মৈত্রী ও মানবতার বার্তা  ছড়িয়ে দিই মানুষের কাছে।

 
জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা 

(লেখক একজন বাঙালি বিশ্বের বিশিষ্ট কবি, ঋষি বঙ্কিম পরিবারের পঞ্চম প্রজন্ম)



৮ই এপ্রিল ২০২২

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.