একজন লেখক চেতনশক্তির জোরে বোধের ক্ষমতাকে ক্রমাগত শাণিত করেন এবং গঠনমূলক ভাবনায় এগিয়ে চলার নির্দেশ দেন সমাজ সংসারকে। যুগে যুগে বিভিন্ন সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে লেখকের তীক্ষ্ণ লেখনীর ছোঁয়ায়। যা সাহিত্যের গৌরব। বাংলা সাহিত্যের ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষলগ্নে আবির্ভূত মহামানবদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। স্বকীয় চেতনায় একাধারে সৃষ্টিশীল কর্মের বিভিন্ন ধারায় - যেমন, কবিতা, নাটক, সংগীত ও অন্যান্য বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পেরেছিলেন বলেই বাংলা সাহিত্য জগতে গবেষকদের চিন্তাজগতের নানান দিকে নানানভাবে তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন। জন্ম মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করে দেখা যায়, ২৪ শে মে, ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগস্ট পর্যন্তই জীবনদশা। ফলস্বরূপ, ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যজীবনে দুইটি দিক বিশেষভাবে কাজী নজরুল ইসলামকে প্রতিবন্ধকতায় জর্জরিত করেছে। প্রথমত, ব্যক্তিজীবনে পর্যায়ক্রমে- শৈশব, কৈশোর, যৌবন অতিক্রান্ত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উৎশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে। ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অবস্থায় জাগতিক জীবনের নিদারুণ দুর্দশার ছবি কবির নিজ ভাবাদর্শকে শানিত করেছে পুনঃ পুনঃ। পৃথিবী সংসারের বিশৃঙ্খল রূপকে নিরীক্ষণ করে জনজীবনের প্রতি তীব্র ক্ষোভকে পুঞ্জিভূত করেছেন নিজের ভেতর। দ্বিতীয়ত, সৃজনশীল ভাবনার বীজ কবির ভেতর ঘরে জন্ম থেকেই পোঁতা ছিল বলে, জ্ঞান আয়ত্ত করার সাথে সাথে নিজস্ব প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু তৎকালীন বাংলা সাহিত্য জগৎ রবীন্দ্র ভাবনায় এমন আচ্ছন্ন ছিল যে, রবীন্দ্র সাহিত্য ধারার আবেগে আপ্লুত পাঠক মনকে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ভাবনায় মোহিত করা সম্ভবপর ছিল না। কিন্তু তিনি কলম থামিয়ে দেননি প্রতিকূল পরিবেশের চাপে পড়ে। বরং নিজের ভেতর সত্তাকে বিকশিত করে গেছেন আত্মগৌরবের আলো জ্বালিয়ে। রবীন্দ্র ভাবধারায় আবর্তিত বাংলা সাহিত্য জগতে (১৮৬১-১৯৪১) তীব্র হুঙ্কার ধ্বনি বাজিয়ে পদার্পণ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবহাওয়ায় জর্জরিত মানুষের বর্বরতা, অন্ন- বস্ত্র- বাসস্থানের টানাপোড়েন, নর- নারীর লিঙ্গ বৈষম্য জনিত লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, সমাজের উত্থান- পতন, উৎশৃঙ্খল রাজনীতির ভয়াবহতা সবকিছুকে বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে পুঞ্জিভূত জ্ঞান চক্ষুর দ্বারা যাচাই করে তীক্ষ্ণ প্রতিবাদী ভাষায় অবলীলাক্রমে তুলে আনেন কবিতা, গান, নাটক ও সাময়িক পত্রে। ব্যক্তি মননের তীব্র আবেগ, উৎসাহ, উদ্দীপনাই কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীতে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল। তাই তিনি 'বিদ্রোহী' অভিধায় ভূষিত হন। বৃটিশ রক্তচক্ষুকে অবহেলা করে কারারুদ্ধ জীবনকে মেনে নিয়ে বাস্তব দুঃখ দুর্দশা থেকে উত্তরণের জন্য 'কান্ডারী হুঁশিয়ার' কবিতায় জনজীবনের প্রতি সাবধানতার বাণী উচ্চারণ করেছিলেন--
"দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।
........... .......... ........... .....
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।(কান্ডারী হুঁশিয়ার, কাজী নজরুল ইসলাম) এই 'যাত্রী' বলতে জীবনযাত্রীকে সম্বোধন করেছেন কবি। যারা যুগে যুগে হেঁটে যাচ্ছেন পৃথিবীর অনন্ত পথের পথিক হয়ে। হুঁশিয়ার বা সাবধানতা-ই মানুষকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। বিপদ আসন্ন হলে হতভম্ব হলেই মৃত্যু অনিবার্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সে কথাই বলে গেছেন 'রাজসিংহ' উপন্যাসে- 'বিপদকালে যে ইতস্তত করে, সেই মারা যায়।' অতএব সচেতনভাবেই এগিয়ে যেতে হবে সমূহ বিপদে। আরেকটি দিক কবি উল্লেখ করেছেন কবিতায়, 'জোয়ান' দের আহ্বান জানিয়ে। অর্থাৎ যুবসমাজই পারে পৃথিবীকে সুন্দর করতে, তাদের প্রাণোচ্ছ্বল মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে। এই বার্তা সর্বকালের এবং ত্রিকালেই প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখে। এই বার্তার ক্ষয় নেই। যুব সমাজ পৃথিবীর প্রধান শক্তি।এছাড়া- 'সাম্যবাদী' কাব্যগ্রন্থে 'নারী' কবিতায় নারী পুরুষের যে জয়গান গেয়েছেন তা সমাজ তথা পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতির মননে নারী- পুরুষের মধ্যে সমতা বিধান করার মানসিকতাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মানবজাতির অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, ততদিন এই ভাবনা বহাল থাকবে। "বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির- কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
....... ........ ....... ......... ......
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি।"(নারী, কাজী নজরুল ইসলাম)লিঙ্গ ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের জয়গান গেয়েছেন তিনি। মানুষ পরিচয় নিয়েই পৃথিবীর মানুষ যাতে বেঁচে থাকতে পারে এই আশা ব্যক্ত করেছেন কবি। কাজী নজরুল ইসলাম গানের ভুবনেও রেখে গেছেন এক দিগন্তের বিস্তার। বিদ্রোহী চেতনায় মানুষের চেতনার জগতে আঘাত এনে মানুষকে যেমন সচেতন করতে চেয়েছিলেন, তেমনি প্রেমের অনুভবে সিক্ত করতে সচেষ্ট হয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। কারণ, প্রেমহীন সংসার নয়। সংসার মানেই প্রেমের অনুভূতি মনে লালন করে পরস্পর কাছাকাছি হেঁটে চলা। 'হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে' গানে সেই ভাবনাকেই নিহিত করেছেন প্রেমিক কাজী নজরুল ইসলাম।"হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে/কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি,/তুমি কেন হায় আসিলে হেথায়/সুখের স্বরগ হইতে নামি।" হৃদয়ের দোলায় মানুষ হেঁটে চলে বলেই ভালোবাসা খুঁজে নিরন্তর। কিন্তু মানুষকে পৃথিবী সংসারে আসতে হয় একা এবং যেতেও হয় একা। মাঝখানে ভালোবাসার স্পর্শ পেয়ে গেলে হেঁটে চলে দীর্ঘপথ হাতে হাত রেখে। সেই ভালোবাসার স্পর্শ স্বর্গ থেকে নেমে আসে প্রেমের অনুভূতি নিয়ে। পথের ধুলো থেকে হেঁটে চলা মানুষ একবার স্বর্গ থেকে নেমে আসা প্রেমের অনুভূতিকে হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারলেই ধুলোমাখা গায়ে জীবনের কষ্টকথাকে চোখের জলে ভাসিয়েও ভালোবাসার উষ্ণ অনুভবকে বুকে আগলে রেখে পৃথিবীর কোলে ঘুমিয়ে যেতে চায় নীরবে। সংগীতের স্বরলিপিতে জীবন ভাবনার এই সূক্ষ্ম অনুভূতিকে নিহিত করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম-- "এলে অবেলায় পথিক বেভুল/বিঁধিছে কাঁটা নাহি যাবে ফুল/কি দিয়ে বরণ করি ও চরণ/নিভিছে জীবন, জীবন স্বামী।" প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, কাজী নজরুল ইসলামের জীবন প্রসঙ্গ নিয়ে বলতে গেলে বলা যায়-- তিনি যেমন মানুষকে সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে, মানুষ পরিচয়ে বেঁচে থাকার কথা বলে গেছেন, তেমনি ভালোবাসার সমস্ত সম্পর্ক সুন্দর হোক এই বার্তাও দিয়ে গেছেন বিভিন্ন সাহিত্য কর্মে এবং পৃথিবীর মূল সম্পদ যে মানুষ, সেই মানবজাতি ভেদাভেদ ভুলে একত্র পা মিলিয়ে অগ্রসর হতে পারলেই যে পৃথিবীর সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব সেই সুদূর প্রসারী বার্তাকে স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করে গেছেন-- "সেই দিন সুদূর নয়-/যে দিন ধরনী গাহিবে পুরুষের সাথে নারীরও জয়।"
রণিতা নাথ
পানিসাগর,উত্তর ত্রিপুরা
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
২৬শে মে ২০২২