কিছু কিছু মানুষের ইতিবাচক ভাবনা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়।সেই ভাবনাগুলো সবার ভালো চেয়ে,হিতার্থে।তাদের নিজের জন্য নয় আজীবন থাকেন সকলের সাথে।যৌথ পরিবারে একটু একটু করে কাজ হলেও,তা হয় গোটা সমাজের জন্যই। পরিবারের সদস্যরা বয়জেষ্ঠ দের নিয়ে ভাবলে বৃদ্ধ বয়সটাকে উদযাপন করা যায়।ফ্রেব্রুযারী মাসে আন্তরিক ভাবে সেনগুপ্ত পরিবার পালন করলো তাদের( মা,ঠাকুমা,বড়মা) সরকার শ্রদ্ধেয় শান্তি সেনগুপ্ত র শততম জন্মদিন।প্রখর স্মৃতির অধিকারিনী শান্তি সেনগুপ্ত র সাথে তার উদয়পুরের বাড়িতে কথোপকথনে নন্দিতা দত্ত।
১) আপনি একজন শতবর্ষের মানুষ আপনার নিজেকে নিজে কিভাবে দেখেন আপনার অনুভব এর কথা যদি আমাদের বলেনঃ
উত্তর: দেখুন শতবছর বাঁচার ইচ্ছে সেই অর্থে কোন মানুষেরই হয়তো থাকে না। কিন্তু ভাগ্য আর ঈশ্বরের দেওয়া আয়ু খুব কম মানুষকেই এই দীর্ঘজীবন দিয়ে থাকে। তাই এই এতবছরের জীবনে যেমন বহু আনন্দের স্মৃতি রয়েছে তেমনি বহু দুঃখ এমনকী সন্তান হারানোর শোকও বয়ে নিয়ে চলেছি। তাই নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করতে পারিনা। তবে হ্যাঁ চিঠি লেখার যুগ থেকে আজকের মোবাইল ফোনের যুগের দাড়িয়ে সেইসময়ের নারী হিসেবে আজকের দিনের মহিলাদের সামাজিক অবস্থানের যে বিবর্তন তা স্ব-চক্ষে দেখা সত্যি এক আলাদা অনুভূতি।
২) আপনার জীবনে এমনকি ঘটনা আছে যার জন্য নিজেকে ধন্য মনে করেন?
উত্তর: আমার যিনি গুরুদেব শ্রীশ্রী রামঠাকুর, উনি তাঁর জীবনদশায় আমাকে শ্রীনাম দিয়েছিলেন। আমি এবং আমার ননদ দুজনে বিয়ে ঠিক পরেই ফেনীতে শ্রীঠাকুরের শ্রীমুখ থেকে দীক্ষা ও শ্রীনাম গ্রহণ করেছিলাম। গুরুদেবের এই সান্নিধ্য পেয়ে আমি মনে করি আমার জীবন ধন্য কারন পরম সৌভাগ্য না হলে এই সুযোগ সবাই পায় না। তাছাড়া দেশসেবায় যুদ্ধের সময়ে যতটুকু পেরেছি আমি দেশের সেবায় নিয়োজিত থাকার চেষ্টা করেছি। এটাও আমার পরম পাওয়া।
৩) আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে পড়াশোনা ভাই-বোন এ সম্পর্কে যদি বলেন?
উত্তর: আমাদের বাড়ি ছিল নোয়াখালী জেলার স্বল্পমান্দারী গ্রামে। আমাদের বাড়ির নাম ছিল সরকার বাড়ি। আমরা চার ভাই আর দু-বোন। বড়দিকে আমি বড়ো হয়ে এক-দুবারই দেখেছি। আমার জন্মের আগেই উনার বিয়ে হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ চার দাদার মধ্যে আমি ছিলাম সবার ছোট এবং দাদাদের আদরের। দাদা-বৌদি ভাইপোদের নিয়েই ছোটবেলা কেটে গেছে। তবে তখনকার দিনের মেয়েদের ইংরেজী পড়ার চল ছিলনা বললেই চলে, শুধুই বাংলায় বাল্যশিক্ষা থেকে ব্যাকরণচর্চা আর হিসেবনিকেশের অঙ্ক এই অব্দি। পাঠশালায় দাদার সঙ্গে আমিও পড়েছি তবে ঘরের প্রচুর কাজ যেমন রান্না করা, বাটনা বাটা, মাছকাটা, ধান সেদ্ধ করা সঙ্গে নিত্য পুজোর কাজ সবই করতে হয়েছে।দুর্ভিক্ষের সময় আধপেটে কেটেছে দিনের পর দিন। পুজোতে সেবার কারোর কপালে কাপড় জোটেনি। তবু ঘরের চাল আর পুকুরের মাছ থাকাতে কোনরকমে প্রাণে বাঁচা গেছে। তারমধ্যে হঠাৎই বাবা চলে গেলেন। যদিও দাদারা চাকরি করতেন, বড়দা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন বলে সংসার টা চালানো গেছে। মনে আছে দাদার ডিসপেন্সারিতে আমিও যেতাম দাদাকে সাহায্য করতে। অনেকসময় ঔষধ ফুরিয়ে গেলে দাদা আমাকে বাড়ি পাঠাত ঔষধ নেওয়ার জন্য। এই করে করে ইংরেজী হলেও বেশ কয়েকটা ঔষধের নাম আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জাপানের বোমা হামলা এইসবে পড়াশোনা সব বন্ধ করে যে যার প্রান নিয়ে ছোটাছুটি শুরু হলো, আমিও বৌদিদের সঙ্গে চলে গেলাম বিলোনীয়াতে।
৪) জন্মস্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরায় এই দুই জায়গায় সমাজ প্রকৃতি কে আপনি কিভাবে দেখেন বা দুটোর মধ্যে মিল-অমিল কোথায় ?
উত্তর: যদিও আমি যখন জন্মেছি তখন পুরোটাই ভারত তবে এখন যেটা বাংলাদেশ সেটা হলো মূলত গ্রাম কৃষি এবং নদী প্রধান দেশ। ফসল-কৃষি এইসবই তখন জীবিকা ছিল। আর নদী, দীঘি, খালে ভরা থাকত চারিদিক। নৌকা ছিল চলাচলের অন্যতম মাধ্যম। বিয়ে হোক, পার্বণ হোক মানুষের নৌকা দিয়েই যাতায়াত বেশী ছিল কারন রাস্তাঘাট সেরকম ছিল না। আর নাহলে গরুর গাড়ির চল ছিল। মূলত শহরেই ছিল রেলের ব্যবস্থা। তবে গাছপালা, ফলফুলে চারিদিক ভরা থাকত। সব বাড়িতেই ফল, ফুলের গাছ থাকত। পুকুরের মাছ, জমির চাল এইগুলিই ছিল গ্রামের মানুষের জীবন। এই যেমন চৈত্রমাসে ঢেঁকিতে ছাতু তৈরী করা। পুজোর সময় নারকেল নাড়ু, সন্দেশ বানানো, শীতে চালের গুড়া দিয়ে অনেকরকমের পিঠেপুলি, এইসবই ছিল। অনেক তেহর-পার্বণে কিংবা বিয়েতে গ্রামের সবাই একসঙ্গে আনন্দে, সুখে দুঃখে মিলেমিশে থাকত। তবে ত্রিপুরায় বিয়ে হয়ে আসার পরে অনেকটা সেসব বদলেছে যদিও বাঙালির ঐতিহ্য একই ছিল। তবু ত্রিপুরা হলো পাহাড়-পর্বতের রাজ্য, এটার আবার অন্যরকম সৌন্দর্য্য। উঁচুনীচু পাহাড়ি পথ, ছোট ছোট নদী, বিভিন্ন মন্দির, সব মিলিয়ে বিভিন্ন জাতি-উপজাতির বাস। বিয়ে হয়ে যখন এসেছি তখনও রাজন্য শাসন চলছে।মহারানী তারপরেই ভারতে যোগদান করলেন। মনে আছে বিয়ে হয়ে আসার পরপরই তখন নতুন যুবরাজ উনার বোন রাজকুমারীদের সঙ্গে মাতাবাড়িতে পুজো দিতে এসেছিলেন। বিশাল গেইট করা হয়েছিল। হাতির পিঠে বসে উনারা এসেছিলেন।
৫) আপনার ছোটবেলার এমন কোন ঘটনা যা আপনার মনে দাগ কেটে রয়েছে?
উত্তর: আমি বিয়ের আগে কিশোরী অবস্থায় দেখেছি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম। গ্রামবাংলার মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে বা বউ হিসেবে সরাসরি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ন হতে না পারলেও সাহায্যের হাত পরোক্ষে চিরকাল যথাসম্ভব বাড়িয়ে দিয়েছি।শরণার্থীদের সেবার কাজ হোক বা শরণার্থী শিশুদের লালন-পালন সেইসময়ের সকল মা-বোনেরাই পর্দার আড়ালে থেকে দেশ সেবায় নীরবে নিযুক্ত ছিল। সেইসময় বাড়ির জামাইবাবু থেকে দাদারা এবং বাড়ির যুবক ছেলেরা কমবেশী সকলেই স্বাধীনতার লড়াইয়ে কিংবা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণায় দেশ সেবায় যুক্ত ছিল।রায়ট- হানাহানি এইসবের মধ্যেই যখন দেশ স্বাধীন হলো, ঠিক সেই সময়ই আমার বিয়ে হয় এবং আমি নোয়াখালী থেকে ত্রিপুরার উদয়পুরে চলে আসি। তখনও কাঁটাতার বসেনি। তার একবছর পরে আমার বড়ছেলে হবার পরে আমরা শেষবারের মতো বাংলাদেশ গিয়েছিলাম। মনে আছে আসার সময় বর্ডারে দুষ্কৃতীদের কবলে পরেছিলাম।তখন এই আক্রমণ খুব বেড়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে গায়ের সব গয়না খুলে এমনকী আমার ছেলেকে দেওয়া উপহার গুলি অব্দি তাদের দিতে হয়েছিল প্রাণে ফিরে আসার জন্য। এই শেষবার আর যাওয়া হয়নি। মূলত নোয়াখালী রায়টের পরপরই সেখানে থাকা বিপদজনক হয়ে উঠেছিল মূলত হিন্দু মেয়েদের জন্য। মনে আছে রায়টের সময় রাস্তায় গাড়ি আটকে দেখত কোনো হিন্দু মেয়ে আছে কিনা। পেলে তাদের তুলে নিয়ে যেত। রায়টে পালিয়ে বিলোনীয়া যাওয়ার সময় রাস্তায় ওরা ধরে ফেলার ভয়ে কাপড়ের বড় থলের ভিতর আমরা ঢুকে লুকিয়ে ছিলাম, আমাদের পরিচিত এক মুসলিম রিক্সাচালক ভাই আমাদের পৌঁছে দিয়েছিল। যদিও রাস্তায় আমাদের আটকে ছিল। সে আল্লাহ্ এর নামে দিব্যি করে সেদিন বলেছিল যে ওর গাড়িতে কাপড় ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই ওরা সেইদিন অজান্তে আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল। এই ঘটনা গুলিই আজও ভীষণ মনে গেঁথে আছে যে একশ্রেনীর মানুষ যেখানে উগ্রবাদী হয়ে মানুষ মারছিল, ঠিক সেইসময় একই জাতের মানুষই নিজের ঠাকুরের নামে মিথ্যে দিব্যি করে হলেও আমাদের প্রাণে বাঁচিয়েছিল। তাই খুব খারাপ মানুষ এবং ঘটনা যেমন দেখেছি, তেমনি এরকম ভালো মানুষও তো পেয়েছি। তাই জীবনে এগুলি খুব দাগ কেটে গেছে।
৬) খুব দুষ্টু ছিলেন কি না শান্ত ছিলেন?
উত্তর: আমি বরাবরই শান্ত আর নরম। তাই হয়তো বিয়ের পরে আমার নাম দয়ামহী থেকে পাল্টে শান্তি রাখা হয়েছিল। ঝগড়া-বিবাদ করতে কোনদিনই পারতাম না। যখন আমার স্বামী হঠাৎ চলে গেলেন তখন অনেক ভেঙ্গে পড়েছিলাম, আজ প্রায় ২৬ বছর হলো।তারপরেও মা হয়ে এইবয়সে দুই-মেয়ে আর বড় ছেলের চলে যাওয়ার শোকও আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। তাই সহ্যশক্তি হয়তো আমার বরাবরই বেশী।
৭) এক জীবনে অনেক কিছুই দেখেছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনাদের পরিবার শরনার্থীদের জন্য অনেক কিছু করেছিলেন সেই অভিজ্ঞতা র কথা কিছু বলুন ঃ
উত্তর: যেটা আগেই বললাম স্বাধীনতা সংগ্রামে আমার বা আমার মতো মেয়েদের তখনকার সময় মূলত পরোক্ষ ভূমিকাই ছিল বেশী। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা প্রায় মধ্যবয়সী।আমার বড়ছেলে তখন যুবক, কলেজে পড়ে, সে এবং তার সঙ্গের সমস্ত যুবকরাই তখন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের রিলিফের কাছে যুক্ত হয়। সেইসময় বহু শরণার্থী আমাদের বাড়িতেও এসেছিল তার মধ্যে আত্মীয়স্বজন ছাড়াও বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। মনে আছে ছোট ছোট কচিকাঁচাদের সঙ্গে নিয়ে মায়েরা আমাদের উঠোনে বসেছিল। এক বিশাল বড়ো হাঁড়িতে ভাত রান্না করা হয়েছিল, বাজারের আকাল কী খেতে দেব এতজনকে! শেষমেশ বাড়িতে থাকা সবধরনের সব্জি এর সঙ্গে পুকুর ধার থেকে তুলে আনা বিভিন্ন শাকপাতা দিয়েই একবেলার ভাত আর সব্জি রান্না করেছিলাম। কলাপতায় করে শরণার্থী মায়েরা তাদের সন্তানদের আগে খাওয়াচ্ছিল। শিশুগুলির অভুক্ত চেহারা আর তাদের মায়ের অসহায় মুখগুলি আজও আমার চোখে ভাসে। আমার বড়ছেলে রিলিফ ক্যাম্পে হিসেবের দায়িত্বে ছিল। তার ক-দিন পরে আমাদের বাড়ি থেকেই তাদের শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এইরকম বহু ক্যাম্প ও অস্থায়ী হাসপাতাল সরকারী ভাবে বানানো হলেও শরণার্থী এত বেশী ছিল যে বসতবাড়িতেই তাদের আশ্রয় দিতে হয়েছে। আর যুদ্ধের সময় তো সাইরেনের শব্দ শুনেই সবাই বাঙ্কারে আশ্রয় নিতাম। আমাদের উদয়পুরে গোমতীর উপরে যে সুভাষ সেতুটি রয়েছে পাকিস্তানের সেনারা সেটি উড়িয়ে দেওয়ারও বহু চেষ্টা করেছে।যদিও সফল হয়নি।
7) আপনার স্মরণশক্তি এখনো ভীষণ ভালো সব কিছু মনে রাখার ব্যাপার টা কি করে সম্ভব ?
উত্তর: স্মরণ শক্তি যদিও আগের মতো নেই। কারন এখন বয়সের কারনে গুলিয়ে ফেলি। তবে এই কথা ঠিক যে বহুআগের মানে আমার বালিকা-কিশোরী অবস্থার স্মরণীয় ঘটনাগুলি এখনও আমার সম্পূর্ণ মনে আছে। এটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব নয় তবে তারসাথে শুভ-চিন্তা আর ধ্যানের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কারন ঈশ্বরের আরাধনার সময় আমরা যে নাম-জপ এবং ধ্যান করি সেটা স্মৃতি শক্তি ভালো রাখতে অতন্ত কার্যকরী এবং বৈজ্ঞানিক ভাবেও এর গুরুত্ব রয়েছে। যদিও বর্তমানে মানুষ যোগাসন-ধ্যান এগুলি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে যা উচিৎ নয়। তাছাড়া স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াটাও একটা বিষয়। টাটকা খাবার সে যাইহোক না কেন আমরা কোন ভেজাল ছাড়াই সবধরনের খাবার খেয়েছি।তাই হয়তো এখনও আমি কোনরকম চশমা ছাড়াই পত্রিকা পড়তে পারি। যদিও উনি চলে যাওয়ার পর প্রায় ২৬ বছর চলছে আমি নিরামিষ খাই। তবে আজকাল মাছ-মাংস থেকে ফল- শাকসব্জি অব্দি কিছুই আর স্বাস্থ্যকর নেই বেশিরভাগই বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে তৈরী। তাই মানুষকে সচেতন হতে হবে।
৮) নাতি নাতনীর মধ্যে ঠাকুমা দাদুর একটা ছায়া থাকে আপনার নাতি নাতনীর মধ্যে কার মধ্যে সেটা দেখতে পানঃ
উত্তর: নাতিনাতনীরা হচ্ছে শেষবয়সের লাঠি। আমার সব নাতিনাতনীরাই দেখতে দেখতে তাদের শৈশব কাটিয়ে সবাই বড় হয়ে গিয়েছে। অনেকেরা চাকরি করছে আর বাকিরা এখনও কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। কয়েকজনের বিয়েও হয়ে গিয়েছে, নাতি-বউরা চলে এসেছে, তাদের সন্তানরা আমার প্রপৌত্র হয়ে ঠাকুমা-দিদা থেকে এখন আমাকে বড়মা করে দিয়েছে। জীবনের স্রোতে তা এগিয়ে চলেছে। তবে আমার নাতিনাতনীরা সবাই আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। তারা সবাই আমার হাতেই বড় হয়েছে। তবে আজকে যখন তাদের স্ব-ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি তখন খুব ভালো লাগে।এখন তো ওরাই এই নতুন যুগের দূত হয়ে আমায় আগলে রেখেছে।তাই ওদের সঙ্গ পেয়ে আমি বেশ আনন্দেই আছি।
৯) একশ বছরের জন্মদিনে কেক কাটলেন কেমন লাগলো ছোটবেলার জন্মদিনে আপনার মা কি করতেন?
উত্তর: এটা বেশ মজার কথাই। কারন বুড়ো বয়সে এসে জন্মদিন পালন।তবে নাতিনাতনীদের হাত ধরেই প্রথমবার বড়ো করে আমার জন্মদিন পালন হল। আসলে এই জন্মদিনে যতটুকু আনন্দ তারা পেয়েছে তার চাইতেও অনেক বেশী সম্মান ওরা নিজের অজান্তেই আমায় দিয়েছে। দুধ দিয়ে স্নান করানো, গায়ে হলুদ, পায়েস করা এগুলি আমার ভাবনার বাইরে। সেইযুগের মেয়ে হিসেবে জন্মদিন পালন তো দুরস্থ জন্মদিন কবে ছিল তাই ঠিক মতো জানতাম না। তাই ছোটবেলায় জন্মদিন কথাটা এক-দুবার শুনেছি কিনা মনে নেই।এমনকী বিয়ের পরেও সংসারের কাজে নিজের জন্মদিন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। তবে আমার ছেলে-বউমা নাতিনাতনীরা এই দীর্ঘজীবনে সেই অর্থে আমার জন্মদিন পালনের মাধ্যমে যত্নসহকারে আমাকে অকৃত্রিম সম্মানে সম্মানিত করল। আজকের দিনে দাড়িয়ে সেই অবহেলিত যুগের নারী হিসেবে এটাও এক পরম প্রাপ্তি।
১০) আপনি কোথায় কোথায় বেড়াতে গেছেন বাড়ি ছেড়ে বাইরে গিয়ে থাকার অভিজ্ঞতা কিরকম ?
উত্তর: ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় আমার ছেলেই আমাদের নিয়ে গেছে। প্রথমবারের যাত্রায় আমি, আমার স্বামী এবং আমার বড়ছেলে সহ আরো দু-একজন গয়া, কাশি-বৃন্দাবন এই ধর্মীয় স্থানে মূলত পূর্বপুরুষদের পারলৌকিক কাজের জন্য গিয়েছিলাম। তাছাড়াও দক্ষিনভারতের প্রায় সিংহভাগ বিখ্যাত স্থানগুলি দেখার সুযোগ হয়েছিল। শুধু বাকি থেকেছে রামেশ্বরম। কিছু গোলযোগের কারণে যাওয়া যায়নি। যদিও দ্বিতীয় বারের যাত্রায় উত্তর ভারতের দর্শনীয়স্থান যেমন তাজমহল, কতুব মিনার, রাষ্ট্রপতি ভবন, সংসদে ভবন এগুলি দেখেছিলাম।আর পশ্চিমবঙ্গে অর্থাৎ কলকাতায় আমার বড় মেয়ের বিয়ে হওয়াতে ওখানে প্রায়ই যাতায়াত ছিল।সেই সুবাদে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে পুরীর শ্রীক্ষেত্র থেকে কোনারকের সূর্য মন্দির সমেত সব দর্শনীয় স্থান গুলি দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। ঠিক তেমনি আবার একলা বিমানযাত্রার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। যদিও সেইসময় সব মেয়েদের সেই সুযোগ ছিলনা।
১১) নিজের জীবন কে কিভাবে দেখেন _ ভালো মন্দ মিলিয়ে জীবনঃ
উত্তর: আগেই বলেছিলাম আমি খুব শান্ত ছিলাম।কোনদিনও কোনো বিবাদ ছিলনা আমার। তেমনি সেই সময়ের নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির বউ হিসেবে কিছু অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে পারিনি। তাই বিয়ের আগে হোক বা পরে এই দুর্বলতার কারনে সাংসারিক যন্ত্রনা আর পাঁচটা মেয়ের থেকে আমাকে অনেকটা বেশীই হয়তো সহ্য করতে হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে সব কষ্ট শেষে যেমন সুখ আসে, আমার জীবনেও এসেছে। আমার মেয়েদের সবার বিয়ে হয়েছে।ছেলেরা স্ব-ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের হাত ধরে বৌমারা এসেছে। সময়ের সঙ্গে নাতিনাতনী থেকে শুরু করে আজ পন্তী অব্দি দেখেছি।
আর এইবয়সেও যে আপনার সঙ্গে এতো কথা বলতে পারছি এটা আমার ছেলে,বৌমা আর নাতিনাতিনীদের সেবা-শুশ্রুষা না থাকলে কখনোই হতো না। তাই বলবো সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমি বেশ ভালোই আছি। এবং আজ যখন আমার নাতনীদের, নাত-বৌদের বা আমার বৌমাদের স্ব-ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এগিয়ে যেতে দেখি তখন গর্ব হয় এইভেবে যে মেয়েরাও আজ সংসারে পিছিয়ে নেই।মহিলারা সব কিছু করতে পারে, এখন ওরা কারোর উপর নির্ভরশীল নয়। এটাও মনকে শান্তি দেয়। তাই শুধু এটাই বলব যে ঐতিহ্য-সংস্কৃতিটাও যেন নারী-পুরুষ সবাই একসঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর ঠাকুরের কৃপায় সবাই যেন ভালো থাকে সুস্থ থাকে।
নন্দিতা দত্ত, আগরতলা
আরশিকথা
২৩শে জুন ২০২২