২০২২ এ দাড়িয়ে আজকের দিনে আমরা গণমাধ্যমে অনেক দেশের ফার্স্ট লেডিকে দেখি, রাজনৈতিক নেতাদের পরিবারের অনেক সদস্যের ব্যয়বহুল বিলাসিতা ও আত্মপ্রচারণা যেন চোখ পড়ারই মত।
কিন্তু সেই হিসাবে বাংলাদেশের প্রথম ফাস্ট লেডি বঙ্গমাতা বেগম মুজিব তথা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব (বঙ্গবন্ধুর রেণু) ছিলেন একেবারে অন্য সকলের চেয়ে আলাদা ও ভিন্ন ধাচের একজন মানুষ।
একজন আদর্শ বাঙালি পরিবারের স্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, এমনকি একজন মা হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্যা, তুলনাহীন। আবার একজন দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী ও জনগণমন অধিনায়ক রাজনৈতিক নেতার স্ত্রী হিসেবে ছিলেন যোগ্যতম সহকর্মী। সরল জীবন, দূরদর্শী মন, কোমলে-কঠোরে তিনি শক্তিশালী বাঙালী নারীর অনুকরণীয় প্রতীকে পরিণত করেছেন নিজেকে।
টুঙ্গিপাড়ার সাধারণ গ্রাম থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি জাতির জনক হয়ে ওঠার পেছনে এই মহীয়সী নারীর অবদান অপরিসীম। তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবনে ছিলেন বলেই পরিবার নিয়ে নির্ভয়ে থাকতে পেরেছেন জাতির পিতা।
এমনকি ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু যখনই জেলে গেছেন, তখন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ করতেন এই মহিয়সী নারী আর তার অসংখ্য প্রমান পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখনীতে। এই সাহসী নারী বঙ্গবন্ধুর বার্তা নিয়মিত পৌছে দিতেন দলের গুরুত্বপূর্ন নেতাকর্মীদের কাছে।
বেগম ফজিলাতুন নেছা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চাচাতো বোন। শৈশবে পিতৃহীন হওয়ায় দাদা শেখ কাশেম দ্রুতই বিয়ে দিয়ে দেন কিশোরী ফজিলাতুন নেছাকে।
ফজিলাতুন নেছার বয়স তখন মাত্র তিন বছর, শেখ মুজিবের তেরো বছর। পাঁচ বছর বয়সে তার মা মারা গেলে শেখ মুজিবের স্নেহময়ী মা সায়েরা খাতুন ছেলের বউকে কোলে পিঠে করে বড় করেন। শেখ পরিবারের যৌথ পরিবারে অনেকের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠেন তিনি। তখন থেকেই তার মধ্যে ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা গড়ে ওঠে। সেইসঙ্গে আত্মত্যাগের শুদ্ধতা তাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
ফজিলাতুন নেছা অল্প বয়স থেকেই স্বামীর জীবনাদর্শের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাই স্বামীর স্নেহ-ভালোবাসায় ভরপুর এই নারী সর্বদা স্বামীর প্রতি উদারহস্ত ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি তিনটি শিশুসন্তানকে নিয়ে ঢাকা শহরে এসে বাড়ি ভাড়া করে বসবাস করতে থাকেন। স্বামী রাজনীতি করেন তাই বাড়ি ভাড়া পাওয়াও ছিল কঠিন, ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাও ছিল কঠিন। তারপরও তিনি সামলেছেন ঘর-সংসার। সন্তানদের আদর্শবাদী হিসেবে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আবার রাজবন্দি স্বামীর মামলার তদারকি করতে আইনজীবীদের কাছেও ছুটেছেন। নিজের গহনা বিক্রি করে মামলা চালিয়েছেন। জমির ধান বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করেছেন। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ছাত্রনেতারা তার কাছ থেকে পরামর্শও নিয়ে যেতো। এমনকি বঙ্গবন্ধুকেও সবসময় অবিচল থাকার পরামর্শ দিতেন তিনি।
৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যেদিন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিলেন, সেদিন যাবার আগে বেগম মুজিব তাকে একাকি বিশ্রাম করতে দেন। সেদিনও তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘সারা দেশের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তুমি তাদের নিরাশ করবে না। তোমার মনে যা বলে তুমি তাই বলবে।’
এর আগে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ছয় দফার সময়েও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠাঙ্গিনী। কোমল হৃদয়ের বঙ্গমাতা এসব সময়ে কঠিন না হলে, হয়তো ষড়যন্ত্রকারীরা গণআন্দেআন্দোলনকে বানচাল করতে সমর্থ হতো। কিন্তু বাইরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জেলখানায় বঙ্গবন্ধুকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রভাবিত করেছেন তিনি। তার কঠোর অবস্থানের কারণেই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ছয় দফাকে নষ্ট করে আট দফা করতে পারেনি কিছু রাজনীতিবিদ, তেমনি তার কারণেই বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্যারোলে মুক্তি নিয়ে পাকিস্তানি জান্তাদের সাথে বৈঠক করতে অস্বীকৃতি জানান।
শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে বঙ্গমাতার ভূমিকা অপরিসীম।
বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি। বাঙালি নারীদের জন্য তিনি এক অনুপ্রেরণা ও শক্তির প্রতীক।
লেখক :
আজম পাটোয়ারী,বাংলাদেশ
প্রকাশক ও কলামিস্ট
আরশিকথা হাইলাইটস
৮ই আগস্ট ২০২২
কবি সুকান্তের উপর আমার লেখা প্রকাশিত হওয়ায় আমি গর্বিত। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা - র জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল -- এই পোস্টটা যেন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের পরম্পরা। আরশি কথা পরিবারের এই ধরনের প্রতিটি শুভ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এই পরিবারের সদস্য হতে পেরে আমি আনন্দিত।
উত্তরমুছুন