বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে কয়েকজন বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা-এভাবে বলা উচিত নয়, কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ছিল দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্রের ফল-এমনটাই দাবি করেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও মানবাধিকার নেতারা। তাঁরা বলেছেন, সামনে চিহ্নিত ঘাতকরা থাকলেও তাত্ত্বিক ‘গডফাদার’ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। আর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছে পাকিস্তান। কমিশন গঠন করে দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ইন্ডিয়ান মিডিয়া করেসপন্ডেন্টস এসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ইমক্যাব) আয়োজনে ‘১৫ আগস্ট : আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ইমক্যাব সভাপতি বাসুদেব ধরের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক হারুণ হাবীব, বিএফইউজে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, বিএফইউজে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব দীপ আজাদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, ইমক্যাব নির্বাহী সদস্য রফিকুল ইসলাম সবুজ ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি মানিক লাল ঘোষ। ইমক্যাব সাধারণ সম্পাদক মাছুম বিল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আলি উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. মিজানুর রহমান বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার চেষ্টা করেছেন বলেই বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাসখানেক আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো সারগোদায় সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আগামি এক মাসের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে কাজ করেছেন হেনরি কিসিঞ্জার, হত্যাকান্ডের পর তিনি বলেছিলেন, আজ আমি অনেক খুশি, আর কোন সংবাদে এতো খুশি হইনি। এই হত্যা ষড়যন্ত্রে আরও কাজ করেছে চীন, চীনের বুলেটেই বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে চীনের বুলেটে শহীদ হয়েছেন ত্রিশ লাখ মানুষ, আহত হয়েছেন লাখ লাখ বাঙালি। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়ায় জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বলেছিলেন, বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত। শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। এই বক্তব্যের পর ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, আজ থেকে একটি বুলেট তোমাকে তাড়া করবে। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল মানবসৃষ্ট, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন গবেষণায় দেখিয়েছেন সেই বছরে উত্তরবঙ্গে রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়েছে। মূলত দুর্ভিক্ষ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পিএল ৪৮০ এর চাল নিয়ে আসা জাহাজকে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে না দেয়ার কারণে। ততিনি বলেন, কয়েকজন বিপথগামী এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল বলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকে হালকা করে দেখা হয়। কিন্তু আসলে এটা ছিল পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ভারত সাবধান করেছিল, আমাদের গোয়েন্দারা কি করেছে ? হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে একটি গুলিও বর্ষিত হলো না, আশ্চর্য্য ব্যাপার। সামরিক বাহিনীর শীর্ষপদে যারা ছিলেন তারা কি করলেন ? পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকে তো আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্যও হয়েছেন। অর্থাৎ পুরস্কৃত হয়েছেন। সরাসরি খুনের সঙ্গে জড়িতদের কূটনৈতিক চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে যেসব রাজনৈতিক নেতা ডুগডুগি বাজানোর কথা বলেছিলেন, তারাও পুরস্কৃত হয়েছেন। মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, বাংলাদেশের চক্রান্তকারীরা পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। লক্ষণীয়, চীন ও সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ রুখতে চীন তিনবার ভেটো দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্মে বাধাদান ও বঙ্গবন্ধু হত্যায় চীন জড়িত, এ সম্পর্কে দ্বিধার কোন অবকাশ নেই। অন্যদিকে একাত্তরেই ভারত ইচ্ছে করলে বাংলাদেশ দখল করে নিতে পারতো। কিন্তু ভারত তা না করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে, এক কোটিরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু অনুরোধ জানাতেই তিন মাসের মধ্যেই সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে এ ধরনের নজির নেই। তিনি বলেন, পাকিস্তানি গণমাধ্যমকে ১৫ আগস্টের আগে আভাস দেয়া হয়েছিল, ঐদিন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এ থেকেই ষড়যন্ত্রের ধারণা পাওয়া যায়। হারুণ হাবীব বলেন, ইতিহাসের সত্যিকে মাটি চাপা দেয়া যায় না। বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল দেশিয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীদের বিচার হয়েছে, কিন্তু পেছনের দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা হয়নি। কমিশনের কথা বলা হয়েছে, কবে হবে আমরা জানি না। কমিশনে শুধু বাংলাদেশের ষড়যন্ত্রকারীরা নয়, বিদেশি শক্তির ভূমিকাও তুলে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি এখনো নির্মূল হয়নি। তিনি বলেন, কমিউনিস্ট চীনের বুলেট বাংলাদেশের মানুষের বুকে বিঁধেছে। বাংলাদেশের মানুষ একথা ভুলতে পারে না।
আরশিকথা বাংলাদেশ সংবাদ
২৯শে আগস্ট,২০২২