Type Here to Get Search Results !

দেবী সরস্বতী এর যৌগিক ব্যাখ্যা ।। প্রদীপ কুমার পাল,কোলকাতা

।। দেবী সরস্বতী এর যৌগিক ব্যাখ্যা ।। 
 


পরমপুরুষের প্রথম অবতার ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তি। এ তিনের গুণাবতার হল বৈষ্ণবী, ব্রহ্মাণী ও রুদ্রাণী। ঋগ্বেদে বাগদেবী এই ত্রয়ীমূর্তিতে প্রতীয়ামানা। এই বিশ্বভুবনের প্রকাশ তাঁরই জ্যোতিতে। যোগীর হৃদয়ে সেই আলোকবর্তিকার আলোয় অজ্ঞানতার রূপ অন্ধকার দূর হয়ে যায়। সেই অবস্থায় সাধকের উপলব্ধি ঘটে অন্তরে-বাইরে; সব জায়গাতেই। সেই জ্যোতির জ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, সেই জ্যোতিই প্রণব, সেই জ্যোতিই সরস্বতী। আলোকময়ী বলে তিনি সর্বশুক্লা। অনন্ত জ্ঞানময় ঈশ্বরের বাক্শক্তির প্রতীক এই সরস্বতী, তাই তিনি বাগ্দেবী। তিনিই বক্র ও সুমেধার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। গতিময় জ্ঞানের জন্যই ঋগ্বেদে তাঁকে নদীরূপা বলা হয়েছে। তিনি প্রবাহরূপে কর্মের দ্বারা মহার্ণব বা অনন্ত সমুদ্রে মিলিত হয়েছেন। দেবী সরস্বতীর জ্যোতি বিভূতি এবং নদী সরস্বতীর নিষ্কলুষতার সমন্বয়ে দেবী শ্বেতবর্ণা। কল্যাণময়ী নদীর তটে সাম গায়করা বেদমন্ত্র উচ্চারণে সাধনে নিমগ্ন হতো।

সরস্বতী আরাধনার ক্রমবিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে তার রূপকল্পনাও বহুবৈচিত্র্য লাভ করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেবীর বাহুর সংখ্যা অধিকতর হলেও সাধারণত তিনি চতুর্ভুজা, পদ্মাসনা, শুক্লাবর্ণা, শুভ্রবর্ণা, বীণা-পুস্তক, জপমালা, সুধাকলস ধারিণী, চন্দ্রশেখরা, ত্রিলোচনা। কখনও দেবী দ্বিভুজা। তন্ত্রে সরস্বতী বাগীশ্বরী-বর্ণেশ্বরী সারদা। 

সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা, জ্ঞানের প্রকৃত কর্ত্রী তো দেবী সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর রূপান্তর হয়েছে পৃথিবীতে নদীরূপে এবং সরস্বতীই অগ্নি-ইন্দ্র-মরুৎ অশ্বিদ্বয়ের সংস্পর্শে শত্রুঘাতিনী, ধনদাত্রী এবং বৃহস্পতি-ব্রহ্মাণস্পতির বিদ্যাবত্তার সংযোগে নদী সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্নরূপে সরস্বতী তীরে উচ্চারিত বৈদিকমন্ত্রে সংশ্লিষ্ট হয়ে পুরাণে বিদ্যা ও জ্ঞান ভিন্ন অপর জ্ঞানগুলো অন্যত্র স্থাপন করে হলেন বিদ্যাধিষ্ঠাত্রী।

অনেকে মনে করেন , ঋগ্বেদে সরস্বতীর নদী হিসেবে যে বন্দনা করা হয়েছে , সে সরস্বতী সত্য সত্যই স্থূল জগতের কোনাে নদী নয় । এর একটি গভীর অন্তনিহিত তাৎপর্য আছে । গঙ্গার মতাে সরস্বতীও দেহের বিশেষ একটি নাড়ির প্রতীক হিসেবে কাজ করে । সেই নাড়ির নাম সুষুম্না । এই নদী হল জ্ঞানের নদী । এই জ্ঞান তটিনীই ষটচক্র ভেদ করে অগ্রসর হয় । অনেকে সরস্বতীকে আকাশের ছায়াপথ বলেও মনে করেন । কিন্তু এ সরস্বতী শুধু আকাশের ছায়াপথ নন । অন্তরে তিনি সৎ চৈতন্য - নদী যা বাইরে প্রকাশিত হয়েছে। 

দেবী 'বাক' এর সঙ্গেও যুক্ত হয়ে গেছেন । বাক্ হলেন বাক্যের দেবী । সেই দেবী হিসেবে সরস্বতী বাকদেবী হিসেবেও পরিচিত বাক্ হল মহাশূন্য। প্রথম বিস্ফোরণজাত ধ্বনি । এই হল Big Bang- এর শব্দ । ভারতীয় শাস্ত্রে এই হল ওঁ । এ থেকেই সংস্কৃত একান্নটি বর্ণের সৃষ্টি ।

এই  ' ওঁ ' থেকেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি । এই যে ওঁ শব্দ শোনা যায় যদি কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে সুষুম্না নাড়ি দিয়ে সহস্রারে ওঠানাে যায় । অনাহত চক্রের অঞ্চলে এই শক্তি উঠলেই অদ্ভুত মনােমুগ্ধকর শব্দ ওঠে — অ - উ - ম , অ - উ- ম , অ - উ - ম

সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হল জলবতী অর্থাৎ নদী। বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা। তিনি বাকপতিও। ইন্দ ও বাকপতি। বৃহস্পতি-পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সব জ্ঞানের ভাণ্ড তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু ও মহেশ্বরের। তাদেরই শক্তিতে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে লাভ করেছিলেন বেদ, ঋগমন্ত্র। ফলে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন। দিনে দিনে সরস্বতী তার অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞানের দেবীতে পরিণত হলেন।

বাক্যের দ্বারাও জ্ঞান অর্জন করা যায় বলে তাঁকে জ্ঞানের দেবী হিসেবেও কল্পনা করা হয় । এর ফলে শিল্পীর দৃষ্টিতে তিনি যেভাবে ফুটে উঠেছেন তাতে তার বর্ণ হল সাদা । কখনও তার দুই বাহু , কখনও চার বাহু । দুই বাহুতে তাঁকে বীণাবাদনরত অবস্থায় দেখা যায় । চার বাহুতে , তার দক্ষিণ করের একটিতে আছে পদ্ম , অপরটিতে জপের মাপা । বাম করের এক করে পুস্তক এবং অপর করে দণ্ড । এইসব প্রতীক । পদ্ম হল সৃষ্টির উৎসের প্রতীক । জপের মালা হল সময়ের উদ্ভব ও তার গতির প্রতীক । পুস্তক জ্ঞানের প্রতীক।  দণ্ড সম্ভবত সৃষ্টিদণ্ড বা মেরুদণ্ডের প্রতীক । প্রাচীন ভারতবর্ষে সরস্বতী মূর্তিও ছিল । সেখানে পাঁচ মাথা ও দশ বাহু । তবে আধুনিক ভাস্কর্যে বা মৃৎশিল্পে দেবী বীণাবাদনরতা ও দ্বিবাহুযুক্ত । তাঁর বাহন হংস।  গীতবাদ্য কাব্যাদি সব কিছুরই দেবী তিনি । সেইজন্য তার হাতে বীণা রয়েছে । বীণা দ্বারা সুরসঙ্গতি বােঝায় যা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে । তার কোথাও একটু সাড়া পড়লে সমগ্র বিশ্বব্যাপী তা অনুরণিত হয়।

পৃথিবী ও স্বর্গের সকল স্থান তিনি নিজের দীপ্তি দ্বারা পূর্ণ করেছেন । এমন কোনাে নদী নেই , যা পৃথিবী ও স্বর্গ উভয় প্রান্তকে স্পর্শ করে আছে । সুতরাং এ নদী কোনাে স্থূল নদী নয় । মেরুদণ্ডের মধ্যে সুষুম্মা নাড়ি দিয়ে এই কুলকুণ্ডলিনী প্রবাহিত হন । জলের পথ যেমন নদীবক্ষ , কুলকুণ্ডলিনীর পথ তেমনই সুষুম্না । এই সুষুম্নাকেই মরমিয়ারা সরস্বতী নদী হিসেবে কল্পনা করেছেন । সুষুম্না নাড়ি দিয়ে কুলকুণ্ডলিনী প্রবাহিত হলে দেহের চক্রে চলে বিভিন্ন বর্ণের দীপ্তি প্রকাশ পায় । সেইজন্যই বলা হয়েছে পৃথিবী ও স্বর্গের সকল বিস্তীর্ণ প্রদেশ তিনি নিজের দীপ্তি দ্বারা পূর্ন করেন ।

' কুলকুণ্ডলিনী যেমন মানুষের দেহের মধ্যে রয়েছে , তেমনই সকল বিশ্বব্যাপী তিনিই ছড়িয়ে রয়েছেন। কুলকুণ্ডলিনীরূপী সরস্বতী ত্রিলােকব্যাপিনী । তিনি মানবদেহের এবং একইভাবে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি স্তর ব্যাপ্ত করে আছে। কুলকুণ্ডলিনী দ্বারাই তারা প্রাণশক্তি লাভ করে আছে ।

ব্রহ্মস্বরূপা দেবী সরস্বতী যোগীগণের অনুভূতিলব্ধ ৷ মানবদেহে যে পঞ্চকোষের অবস্থান, তার বিজ্ঞানময় কোষে দেবী সরস্বতীর অবস্থান ৷অন্নময়কোষ থেকে মনোময় কোষ হয়ে বিজ্ঞানময় কোষে পৌঁছতে দেবী কালিকাকে স্মরণ করার মাধ্যমে দেবী সরস্বতীর বন্দনা পরিলক্ষিত হয় ৷অন্যদিকে ইড়া-পিঙ্গলা-সুষম্না নাড়ীর মধ্যে সুষম্না নাড়ীতেই দেবী সরস্বতীর অবস্থান ৷ কাজেই সেই সূক্ষ্মনাড়ী যা অনুভতিসাপেক্ষ সেইস্থানেই দেবী সরস্বতী আপন প্রভায় প্রভায়িত ৷বলা হয়েছে অপর ভগ্নীদের অতিক্রম করে সূর্যের মত দিনকে তিনি বিলম্বিত করুন । ' এই অপর ভগ্নীরা হলেন ইড়া ও পিঙ্গলা। 

সপ্তচক্র হল দেহের সাতটি সুর ।


প্রদীপ কুমার পাল,কোলকাতা


ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট

২৬ জানুয়ারি ২০২৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.