Type Here to Get Search Results !

বিদ্যাসাগরের মহত্ত্ব ।। তু ল সী দা স মা ই তি ।। আরশিকথা হাইলাইটস

"ধন্য তোমরা, তোমাদের তপস্যা ব্যর্থ হয়নি, তোমরা একদিন সত্যের সংগ্রামে নির্ভয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলে বলেই আমাদের অগোচরে পাষাণের প্রাচীরে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। তোমরা একদিন স্বদেশবাসীদের তিরস্কৃত হয়েছিলে, মনে হয়েছিল বুঝি তোমাদের জীবন নিস্ফল হয়েছে, কিন্তু জানি সেই ব্যর্থতার অন্তরালে তোমাদের কীর্তি অক্ষয়রূপ ধারণ করছিল।" বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদিন এমন কথা বলেছিলেন । কথাটির তারপর্য অনেকটাই গভীরে নিহিত। ওইদিনই রবীন্দ্রনাথ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন যার মূল্য অপরিসীম। দেশবাসীর বিদ্যাসাগর স্মরণের উদ্দেশ্যকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে সেদিন তিনি বলেছিলেন- "বিদ্যাসাগর তাঁর চরিত্রের যে মহত্ত্বগুণে দেশাচারের দুর্গ নির্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন সেটাকে কেবলমাত্র তাঁর দয়া-দক্ষিণ্যের খ্যাতির দ্বারা তাঁরা ঢেকে রাখতে চান। বিদ্যাসাগরের যেটি সকলের চেয়ে বড়ো পরিচয় সেইটিই তাঁর দেশবাসীর তিরস্করণীর দ্বারা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।"(প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩২৯)। এই প্রসঙ্গটির নিবিড় ব্যাখ্যার জন্যই এই প্রতিবেদনের অবতারণা।

বিদ্যাসাগরের মহত্ত্বটি প্রকৃতপক্ষে কোথায় বা তাঁর আসল পরিচয়টি কি তা নিয়ে আজো আলোচনা জরুরি হয়ে পড়ছে। প্রকৃত প্রস্তাবে আধুনিক ভারত নির্মাণের জন্য যে প্রত্যয় বৃক্ষের বীজ উনিশ শতকের বঙ্গভূমি তে প্রোথিত হয়েছিল রামমোহন হাতে, বিদ্যাসাগরের হাতে তার লালন। এর জন্য যে মহৎ শক্তির প্রয়োজন তা বিদ্যাসাগরের ছিল। একটা সংঘাত ময় জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি এই শক্তি দিয়ে। 

বিদ্যাসাগরের বহুবিধ কাজের প্রধানত তিনটি  দিকঃ 

এক ।। ধর্ম বাদ দিয়ে সমাজ সংস্কার আন্দোলন।।

বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ প্রথার বিলোপ ইত্যাদি এই শ্রেণির কাজের মধ্যে পড়ে।

যে সময়কালে বিদ্যাসাগর তাঁর কাজ গুলি করছেন তখন সমস্ত সমাজ ধর্মের বেড়াজাল কুসংস্কার ও কুপ্রথায় জর্জরিত। ধর্মকে বাদ দিয়ে সমাজসংস্কার কিভাবে সম্ভব। রামমোহন রায় তাঁর পূর্বসূরী। তিনি ধর্মকে আশ্রয় করেই সমাজসংস্কারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর সে পথে হাঁটেন নি। ধর্ম ও ঈশ্বর-এসবের প্রতি তিনি উৎসাহী ছিলেন না। অবশ্য ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদও ঘোষণা করেননি।তাঁর কাছের মানুষজন অনেকেই রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । অনেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন। বিদ্যাসাগর বিচলিত হননি। প্রতিক্রিয়াও দেখান নি। তিনি বুঝেছিলেন বিধবাবিবাহ প্রচলন,বহুবিবাহ প্রথা রদ, বাল্যবিবাহ প্রথার লোপ-এই সব কাজের জন্য ধর্ম থেকে দূরে থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাধারমণ মিত্র বলেছেন- "বিদ্যাসাগর ধর্ম বিষয়ে উৎসুক্য দেখাননি। সমাজসংস্কার করতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন যে ধর্ম সমাজকে রক্ষা করছে না। বরং পীড়ন করছে। সেটা ধর্মের দোষ নয়, যারা ধর্মব্যবসায়ী, ব্রাহ্মণ-পান্ডা-পুরোহিত - তারাই এই কাণ্ডটা ঘটাচ্ছেন। এজন্য তিনি সরাসরি ধর্ম প্রসঙ্গটাই বাদ দিয়ে দিলেন। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন যে, বিদ্যাসাগর পুরোপুরি নাস্তিক ছিলেন।"  স্বাভাবিকভাবেই তিনি শত্রু হলেন একশ্রেণির মানুষের কাছে। এমন কি ক্রমশ একা হয়ে গেলেন। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর কাজ তিনি করে গেছেন। কখনো আদর্শ-চ্যুত হননি। আর এখানেই বিদ্যাসাগরের চরিত্রের মহত্ত্ব। এখানেই তিনি অন্যদের থেকে ভিন্ন, স্বতন্ত্র।


দুই ।। শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন। নতুন নতুন  বিদ্যালয় স্থাপন, নারী শিক্ষার নানান আয়োজন ইত্যাদি।।

যে আদর্শে বিদ্যাসাগর সমাজসংস্কার আন্দোলন করেছিলেন সেই পথেই তিনি শিক্ষাসংস্কারের প্রতিও মনোনিবেশ করেন। এখানেও তাঁর লড়াইটা ছিল গভীর। ছাত্রজীবন ও শিক্ষকতাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছিলেন বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজন। পাঠক্রম ,শিক্ষাপদ্ধতি- সবকিছুর আমূল পরিবর্তন দরকার। সংস্কৃত কলেজে তিনি কয়েকবছর চাকরি করেন মাঝে তাকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল ওই একটাই কারণে। তিনি পাঠ্যসংস্কার করতে চেয়েছিলেন এবং শিক্ষাপ্রণালীর পরিবর্তন চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। আদর্শহীন রসময় দত্ত মেনে নেননি। আদর্শপরায়ণ বিদ্যাসাগর ইস্তফা দেন। পরে অবশ্য আবার আসেন এখানে চাকরিতে।

নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের ভূমিকা কমবেশি সবার জানা। বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল। বিদ্যালয়গুলো চালু রাখা এবং সংস্কার করার জন্য তিনি কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন নি। অবশ্য বিডন সাহেব কিছু সাহায্য করতেন। সংস্কারমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে প্রকৃত শিক্ষার প্রয়োজন- এটা তিনি অন্তর দিয়ে বুঝেছিলেন বলেই তাঁর এই লড়াই।


তিন ।। গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ।।

গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ বিদ্যাসাগরের এক উল্লেখযোগ্য কাজ। বাংলা সাহিত্যে প্রথম শিল্পিত গদ্যের তিনিই প্রথম স্রষ্টা বলে মনে করা হয়। রামমোহনের কেজো গদ্যকে তিনিই প্রথম সাহিত্যপদবাচ্য করে তোলেন। অবশ্য আধুনিক কালের বহু গবেষক অক্ষয়কুমার দত্তের ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত ভূগোল গ্রন্থের গদ্যকে প্রথম সাহিত্যিক গদ্য বলে মনে করে থাকেন। সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, এক অনন্য গদ্যশিল্পী ছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগরের গ্রন্থ রচনার উদেশ্য তাঁর জীবনের অন্যান্য উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য চাই বাংলা বই এবং স্কুল চালানোর জন্য চাই অর্থ। গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রেও তিনি ওই একই আদর্শকে মেনে চলেছেন।। কোথাও ধর্মীয় আবেগকে প্রশ্রয় দেননি। বিধবাদের যাতনা ও নারীর দুঃখের মতোই দেশের বালক-বালিকাদের শিক্ষা নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন। শিক্ষা সংস্কারের অন্যতম এককও ছিল তাঁর রচিত গ্রন্থ। এ প্রসঙ্গে শিশু উপযোগী পাঠ্যপুস্তক বর্ণপরিচয়,প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ বই দুটির কথা বলতেই হয়। বলাবাহুল্য, বর্ণ পরিচয় ( ১৮৫৮)- এর আগে বিদ্যাসাগর অনেকগুলি পুস্তক রচনা করেছিলেন। 'বেতাল পঞ্চাবিংশতি' 'বাংলার ইতিহাস', 'জীবনচরিত' 'শকুন্তলা' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনার উদ্যেশ্যের সাথে বর্ণপিরিচায়ের উদেশ্য পুরোপুরি এক নয় । শিক্ষাসংস্কারের কাজে বিদ্যাসাগর শিশুর প্রথম শিক্ষার জন্য বিজ্ঞান সম্মত বইয়ের প্রয়োজন উপলব্ধি করেছিলেন। তার আগে যে বই ছিল না তা নয়।  ১৮৪৯-৫০ সালে প্রকাশিত মদনমোহন  তর্কালংকারের লেখা 'শিশুশিক্ষা' '( প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ) বইটি ছিলই।  ছিল ১৮৫৩ তে লেখা স্কুল বুক সোসাইটির বই 'বর্ণমালা', হিন্দু কলেজের বাংলা পাঠশালার সম্পাদক ক্ষেত্রমোহন দত্তের 'শিশুসেবধি'.অক্ষয় কুমার দত্তের 'চারুপাঠ 'ইত্যাদি বই ছিলই। কিন্তু কোনোটাই শিশুদের বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার করে নির্মিত ছিল না এই পুস্তকেই বিদ্যাসাগর বর্ণমালার আমূল পরিবর্তন করেন। এখানে তিনি পূর্বের ৪৮ টি বর্ণের বদলে তিনি আনেন ৫২ টি বর্ণ। দীর্ঘ 'ঋ' এবং দীর্ঘ '৯'-কার বাংলাভাষায় ব্যবহৃত হয় না বলে বাদ দিয়েছেন। অনুস্বার ও বিসর্গ কে ব্যঞ্জনবর্ণে নিয়ে আসেন। চন্দ্রবিন্দু কে অক্ষরের মধ্যে রাখা হয়। আগে স্বতন্ত্র মর্যাদা ছিল না। ক্ষ কে যুক্তবর্ণ থেকে তুলে এনে ব্যঞ্জন বর্ণে রাখেন। সংস্কৃত বর্ণমালায় থাকা ড় ঢ়, য় কে বাংলা ভাষার নিজস্ব হরফের স্বীকৃতি দেন বিদ্যাসাগরই।

বর্ণপরিচয় লিখতে হয়েছিল সহজ সরল ভাবে শেখানোর উদ্দেশ্যেই। এখানে খুব গুরুত্বের সাথে একটি কথা বলতেই হয়, যে বর্ণ পরিচয় এর বর্ণ ,শব্দ, বাক্য, এসবের ক্রমে একটা বিজ্ঞানসম্মত ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিদ্যাসাগর এই পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে প্রথমে বর্ণপরিচয় পরে প্রকৃতি পরিচয় এবং শেষে সমাজের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। আর এই সম্পূর্ণ পর্যায়ে কোথাও ঈশ্বর ও ধর্মের প্রসঙ্গ আনেন নি। তৎকালীন সময়ে যা ছিল খুব কঠিন। এখানেও বিদ্যাসাগর তাঁর আদর্শকে অটুট রেখেছেন। এখানেই বিদ্যাসাগরের মহত্ত্ব।

দীর্ঘ দুশো বছর দেশবাসী বিদ্যাসাগরের মহত্ত্বের আলোতে স্নান করে চলেছে। কিন্তু তারা 'আধুনিকতম মানুষ'টির এই মহত্বকে কতটুকু চিনতে পেরেছে? আজ তাঁর ২০৪তম জন্মবার্ষিকীতে প্রকৃতরূপে তাঁকে যদি আমরা চিনে নিতে পারি, তবেই এই স্মরণ-কাল হবে সার্থক।


তু ল সী দা স   মা ই তি


আরশিকথা হাইলাইটস

২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২৩

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.