Type Here to Get Search Results !

মানবতার সংজ্ঞা কি আটলান্টিকের এপারে ওপারে ভিন্ন? - আরশিকথা অতিথি কলাম

মানবতা কিংবা মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে বরাবরই দ্বৈতনীতি পশ্চিমা রাষ্ট্রের। হোক ফিলিস্তিন, আফ্রিকা কিংবা এশিয়া অথবা বাংলাদেশ। নিজেদের দেশে যে অপরাধের জন্য শূন্য সহিষ্ণুতা দেখায় তারা, অন্যদেশে সেই একই অপরাধের জন্য সাজা হলে সেটিকে ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টায় মাতে তারা। আমেরিকা কিংবা ইউরোপের এ ছলনায় প্রশ্ন ওঠে, মানবতার সংজ্ঞা কী তবে আটলান্টিকের এপারে ওপারে ভিন্ন?

অর্থ বিত্ত সম্পদ শৌর্য বীর্য সভ্যতা ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি ভাষা কিংবা নৃতত্ত্ব– পৃথিবী বহুভাগে বিভক্ত সৃষ্টির শুরু থেকেই। এসব পার্থক্যের মাঝেও একটি জিনিস হওয়া উচিত ছিল সার্বজনীন – তার নাম মানবতা কিংবা মানবাধিকার। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর এগিয়ে যাওয়া পৃথিবীতেও মানবতা, মানবাধিকারের সংজ্ঞা এখনও ভিন্ন। আরও পরিস্কার করে বললে, আটলান্টিকের এপারে আর ওপারে মানবাধিকারের সংজ্ঞায় যেন যোজন যোজন দূর। সুবিধাবাদের এ মানবাধিকারের প্রবক্তা পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলো। যাদের হাতে আছে বিশ্বের সেরা প্রযুক্তি, জ্ঞান বিজ্ঞান, সমরাস্ত্র আর অর্থের শক্তি। নিজেদের দেশে যেটি মানবতার লঙ্ঘন বলে ভাবে তারা, অন্য দেশে সেই একই ধরনের বিষয়ের জন্য তাদের চোখ দেখে ভিন্ন কিছু।
 
কয়েক দশক ধরে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়ছেন ফিলিস্তিনি নাগরিকরা। নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের এ আন্দোলনকে পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলো বরাবরই দেখেছে বিদ্বেষের চোখে। এমনকি ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতকে সন্ত্রাসী বলতেও ছাড়েনি ইউরোপ কিংবা আমেরিকা। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনের নগর গ্রামে ইসরাইলের গোলার আঘাতে মারা যায় নারী শিশুসহ বহু মানুষ। নিজ দেশে হয় তারা বাস্তুচ্যুত। তবুও ইসরাইলের এই নীপিড়নকে মানবতার লঙ্ঘন বলে মনে হয় না মানবতার ধ্বজাধারী পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলোর কাছে।

কিন্তু দীর্ঘদিনের নীপিড়নে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর জন্ম নেয়া পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস যখন রুখে দাঁড়ায়, তখন তাদের কাছে সেটি হয় মানবতার লঙ্ঘন।
 
দখলদার ইসরাইলের পক্ষে হুঙ্কার দেয় ইউরোপ আমেরিকা। শুধু বক্তৃতা বিবৃতি নয়, জাতিসংঘে পাস করিয়ে নিতে চায় নিন্দা প্রস্তাব। অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে পাশে দাঁড়ায় ইসরাইলের।
 
২০১৩ সাল। ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে কয়েক ঘণ্টার জন্য সমাবেশের অনুমতি পেয়ে অবস্থান নিয়ে বসে হেফাজতে ইসলাম। রাত বাড়ে, শুরু হয় হেফাজত কর্মীদের নির্বিচার তাণ্ডব। নগর এবং নগরের মানুষকে জিম্মি করে সৃষ্টি করে যুদ্ধপীড়িত অবস্থা। ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা থেকে বাদ যায় না পবিত্র কোরআন শরীফও। উগ্র, বেসামাল হেফাজত কর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়। রাতের মধ্যেই মুক্ত করা হয় শাপলা চত্বর।
 
আর তখন মানবাধিকারের নামে কিছু অপতথ্য নিয়ে হাজির হয় অধিকার নামে একটি সংগঠন। দাবি করে ৫ মে শাপলা চত্বরে নিহত হয়েছেন ৬৩ জন মানুষ। সরকার জানায়, মারা গেছেন ১৩ জন। সরকারের পক্ষ থেকে ৬৩ জনের তালিকা চাওয়া হয় তাদের কাছে। কিন্তু তালিকা দিতে অস্বীকার করে অধিকার। ওদিকে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়, অধিকার যাদের মৃত বলে দাবি করেছে তাদের বেশিরভাগই জীবিত।
 
পরে এ নিয়ে প্রথমে থানায় জিডি হয়, পরে মামলা। মামলায় আদালতের রায়ে ‘অধিকার’ এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানের জেল হলে মানবতা লঙ্ঘিত হয়েছে বলে শোরগোল তোলে ইইউ পার্লামেন্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গলায়ও একই সুর।
 
তবে ব্যতিক্রমও আছে। ইইউ পার্লামেন্টেই আছেন এমন মানুষ যাদের কাছে রাষ্ট্র, মহাদেশ কিংবা ভৌগোলিক সীমানাভেদে মানবাধিকারের সংজ্ঞা ভিন্ন নয়। ইইউ পার্লামেন্ট সদস্য ম্যাক্সিমিলান ক্রাহ গণমাধমকে বলেন, আদিলুর ইস্যুতে তিনি ইইউ পার্লামেন্টের নিন্দা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে।
 
ম্যাক্সিমিলান ক্রাহ বলেন, হেফাজতের সেই সময় বাংলাদেশে ৬৩ জনকে মেরে ফেলা হয়েছে এমন দাবি করে রাষ্ট্রকে দায়ী করেন একজন এনজিও ব্যবস্থাপক। সেই মিথ্যা ছড়ানোর কারণে দাঙ্গা হতে পারত। এমন অবস্থায় রাষ্ট্র অবশ্যই মিথ্যা ছড়ানো রোধ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে। অন্য দেশের ওপর প্রভাব খাটাতে মানবাধিকারকে পশ্চিমা বিশ্ব রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। কোনো সরকার যদি পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে একমত না হয় সেক্ষেত্রে মানবাধিকার নিয়ে তারা সবক দিতে থাকে।

গত বছর বাংলাদেশের গুম খুনের একটি তালিকা প্রকাশ করে জাতিসংঘ। সেখানে এমন কিছু ব্যক্তির নাম ছিল যারা প্রকৃত পক্ষে কখনোই নিখোঁজ ছিলেন না। বরং বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার ছিলেন এবং নিরাপত্তা হেফাজতে থাকার পুরোটা সময় পরিবারের গোচরেই ছিলেন।
 
বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল ওই সময় গণমাধ্যমে বলেছিলেন, জাতিসংঘের মতো সংস্থা যখন প্রকৃত তথ্য না জেনেই কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন শুধু বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে না, ভুক্তভোগীদের ন্যায় বিচারের পথও রুদ্ধ হয়।
 
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশ মানবাধিকার রক্ষার সব সূচক নিশ্চিত করতে পেরেছে এমনটা নয়। তাছাড়া মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ায় হাঁটা উচিত সকলেরই। কিন্তু যদি বিভিন্ন সময় মানবাধিকার নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন হয়, কিংবা ভৌগৌলিক ও রাষ্ট্রীয় সীমানা ভেদে মানবাধিকারের সংজ্ঞা ভিন্ন হয়, তখন সেটি শুধু বিভ্রান্তিই ছড়ায় না রবং মানবাধিকার বাস্তবায়নের পথকে রুদ্ধ করে দেয়।


গ্রন্থনাঃ আর আক্তার


আরশিকথা অতিথি কলাম

১৫ অক্টোবর ২০২৩
 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.