মায়ের আঁচল ধরেই সন্তান বেড়ে ওঠে। মায়ের শরীরের গন্ধে শিশু সন্তানের কান্না থামে। মায়ের স্বভাব ও আচরণেই গড়ে ওঠে সাধারণত অধিকাংশ সন্তানের স্বভাব চরিত্র। চিন্তা ও মানসিকতা। তাই সন্তান গঠনে মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। মা চাইলেই একটি সন্তানকে আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। হয়ে ওঠতে পারেন আদর্শ।
একটি শিশুর জন্মের পর তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মায়ের কোল। মা পরম যত্ন ও ভালোবাসায় সিক্ত করে, সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যখন সন্তান আধো আধো কথা বলা শুরু করে, মা তখন চারপাশের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। কথা ফোটার সময় থেকেই মা যদি ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলার শিক্ষা শিশুর মগজে গেঁথে দেন, তাহলে আশা করা যায় এই সন্তানটি চরিত্রবান সৎ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে। তাই একথায় কোনো সন্দেহ নেই যে, মা হলেন সন্তানের নৈতিক শিক্ষার প্রধান শিক্ষক।
মায়েরা সৎ মানুষের কাহিনী সন্তানদের প্রতিনিয়ত শোনাবেন। সন্তানদেরকে সত্য বলার, সৎ পথে চলার উৎসাহী করার পাশাপাশি এর দ্বারা সমাজে তার প্রশংসামূলক অবস্থান, উপকারিতা তুলে ধরবেন প্রতিনিয়ত।
ছোট শিশুরা কাদা মাটির মতো নরম। তাকে যা শিখাবেন তাই শিখবে। যা দেখবে তাই তার কচি মনে ছবির মতো ভাসবে।
প্রতিটি মায়ের অবশ্য কর্তব্য সন্তানের নৈতিক শিক্ষার প্রতি খেয়াল রাখা। নৈতিক শিক্ষার বীজ যদি যথাসময়ে সন্তানের মনে রোপন করতে পারি, তবেই ভবিষ্যতে ঈশ্বর বিশ্বাসী চরিত্রবান ও দেশদরদী নাগরিক তৈরি হবে।
তবে আমার মনে হয় সবকিছুরই শুরু হয় বাড়ি থেকে। তাই বাসাটা হতে হবে সবচেয়ে বেশি আবেগের অনুভূতিতে ভরা এবং একটি শিশু যাতে নিরাপদ ভাবে এবং মনের আনন্দে খুশিতে তার বাড়িতে অবাক আচরণ করতে পারে চলাফেরা করতে পারে সেটার দিকে মাকে যত্নবান হতে হবে।
আজকাল প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে শিশুর মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা এটার কারণ হিসেবে দাম্পত্য কলহকে মুখ্য বলে বিবেচনা করা হচ্ছে এক্ষেত্রে শিশুকে সুস্থ ভাবে মানুষ করার জন্য মায়ের বিশেষ ভূমিকা থাকা উচিত বলে মনে করি। তাছাড়া দাম্পত্য জীবনে সুখ সমৃদ্ধি শান্তি বজায় রাখার জন্যও মায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছোটখাট মানঅভিমান কিংবা হাসি ঠাট্টা প্রেম ভালবাসাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। জীবনে অনেক কিছু করার অনুপ্রেরণা দেয়। কিন্তু অনেক সময়ই শোনা যায় সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা। শোনা যায় দাম্পত্য কলহের কথা, যা পারিবারিক জীবনকে একদম বিষিয়ে তুলে। দাম্পত্য কলহের রয়েছে অসংখ্য ক্ষতিকর দিক। এর ফলে স্বামী বা স্ত্রী কেউই ভালো থাকতে পারে না। আর যদি সন্তান থাকে তাইলে তো আরও বিপদ। কারণ এতে করে সন্তানের মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হয়। বেড়ে উঠতে গিয়ে নানাভাবে মানসিক প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হয়।
ধৈর্য মেয়েদের চিরাচরিত গুণ সেটাকে বজায় রাখতে পারলে সংসারে অনেক সমস্যা সমাধান খুব সহজেই হয়ে যায় এবং নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মায়েদের বিশেষত পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখা খুবই দরকার।
আমাদের জীবনের সবথেকে হাসিখুশি দিনগুলি উদযাপিত হয় ছোটবেলায়। এই সময় মন থাকে নিষ্পাপ। জগতের যাবতীয় মারপ্যাঁচ থাকে যোজন খানেক দূরে। ফলে অকৃত্রিম আনন্দে আলোকিত হয় জীবন। বন্ধুদের সঙ্গে হেসেখেলে, খেলার মাঠে ধুলো উড়িয়ে সময়কে উপভোগ করার সুযোগ মেলে।
তবে আমাদের জীবনযাত্রায় যত আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে,, ততই নিত্যনতুন সমস্যা এসে আঘাত হানছে শিশু মনে। জগতের নানান কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে না পেরে সময়ের আগেই শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে। খেলার মাঠের বদলে তাঁদের সঙ্গী হচ্ছে ভিডিওগেম। শান্ত বিকেলে আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে ‘ভো-কাট্টা’ বলার পরিবর্তে তাঁরা মোবাইলেই ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।
এরসঙ্গে আবার গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড় চলছে। সেই কোন ছোটবেলা থেকেই ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হওয়ার বাসনা শিশুদের মধ্যে রোপন করে দেওয়া হচ্ছে। আর যখনই সেই কাঙ্খিত ফল মিলছে না, তখন জুটছে তিরস্কার।
এই রকম দমবন্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে শিশুর শৈশব। তাদের মনেও বাসা বাঁধছে অবসাদ। আর যদি সঠিক সময়ে বাবা-মায়েরা এই সমস্যার লক্ষণ চিনে উঠতে না পারেন, তাহলে সাড়়ে সর্বনাশ! কারণ তাতে বিপদের আশঙ্কা বাড়বে ১৬ গুণ।
কোনও একটি কারণ নয়, বরং অনেকগুলি কারণ মিলেমিশে ছোটদের মধ্যে অবসাদ তৈরি করছে। এক্ষেত্রে শারীরিকভাবে ফিটনেসের অভাব, বন্ধুবান্ধবের অভাব, পিতামাতার খারাপ ব্যবহার, নিয়মিত লাঞ্চনা, মারধোর এবং বাড়িতে আগেও কারও এমন সমস্যা থাকলে,বাবা মায়ের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঝগড়াঝাঁটি অশান্তি এগুলোর জন্য ছোটরা অবসাদে আক্রান্ত হতে পারে। তাই প্রত্যেক বাবা-মাকেই এই বিষয়গুলি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
মাকে খুব সচেতন থাকতে হবে এবং প্রতি নিয়ত সন্তানের বিকাশে ওর সহায়ক হতে হবে। তবেই শিশুকে এই জটিল অসুখ থেকে বাঁচাতে পারবেন।
ড. হৈমন্তী ভট্টাচার্য
সহকারী অধিকর্তা, কৃষি দপ্তর, ত্রিপুরা সরকার
১২ই মে ২০২৪