Type Here to Get Search Results !

একটি অনুরোধ......



কিছু কিছু মানুষ গ্রামবাসী হন। আবার কোনও কোনও মানুষের মধ্যে গ্রাম বসবাস করে। সদ্যপ্রয়াত তবলাশিল্পী হরেকৃষ্ণ রায়কে দেখলেই এই কথা মনে হত। এঁর সঙ্গে দু-একদিন কথা হয়েছে। শ্রোতা হিসেবেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। কেমন সরল, সুমিষ্ট বাজনা। look at me ভাবটা নেই। চালাকি নেই, সংগত করার সময় সঙ্গীকে অকারণ ছাপিয়ে যাবার হুংকার নেই। একটা ঝিমধরানো গ্রামীণ সরলতা আছে। আর লহরার সঙ্গে যে নগমা করতেন, সেটার তুল্য জিনিস আমি আর কারও হাতে শুনিনি ত্রিপুরায়। যেন একটা পরি এসে মূল বাদককে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। 

তাঁর বাজনার মত তিনিও। দেখতে গ্রামীণ। কৃষিলগ্ন মানুষ। আত্মম্ভরিতা নেই। এই লোকগুলি নিয়ে কিছু মুশকিল আছে। নাগরিক ডেফিনেশনের আওতায় এঁদের ভিড়িয়ে ফেলা যায় না। যেমন, সারা রাজ্যে তাঁর ছাত্র আছে অথচ তাঁর কোনও ইশকুল নেই। সারা রাজ্যে ঘুরছেন। খালি দিতে চাইছেন, দিতে চাইছেন। ভারত-বিখ্যাত সব শিল্পীর সঙ্গে বাজাচ্ছেন আবার রেডিওতে কচিকাঁচাদের সঙ্গেও আসন পেতে বসে বাজিয়ে দিচ্ছেন। অনুষ্ঠানে ডেকে আয়োজক গাড়ি পাঠায়নি, সমস্যা নেই। শিল্পী অটো ধরে, এই করে সেই করে, ঘেমেনেয়ে উপস্থিত। ফলে এঁদের অনেকেই টেকেন ফর গ্রান্টেড হিসেব করেন। এঁরা তাতে কিছু মনে করেন না। কারণ তাঁদের মনে আছে গ্রাম, কুটো-ওড়ানো মাতৃবাতাস
উদয়পুরে তাঁর এক মেয়ের বাড়ি আছে। সে কন্যাটি অকালপ্রয়াতা। তিনি সে মেয়ে জামাইকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আবার বিয়ে করিয়েছেন এখানে এলে, ‘মাইয়ার বাড়িত যাইবলে সে বাড়িতে যেতেন। কেবল তিনিই জানতেন সে-বাড়ি আর তাঁর মাইয়ার বাড়ি নাই
এরকম মানুষগুলি দুঃখবাদী হন। বেদনা লুকিয়ে রাখেন। প্রতিযোগিতায় নামেন না। ফলে এঁদের জীবনের চাহিদা বোঝা যায় না। চাহিদা বোঝা না গেলে মানুষকে বোঝা যায় না। তাই তো কোনও আগন্তুককে দেখলে গৃহস্থের প্রথম প্রশ্ন, ‘কী চাই’? এঁরা কিছু চায় না তাই এঁদের ঠিক মত বোঝা যায় না। এঁরা নিজের স্থির করা শর্তে বাঁচেন এবং মরে যান
চিত্রকর এমএফ হুসেন খালি পায়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে হাতে নিতেন একটি ব্রাশ। যেন ধারণ করে আছেন। দামি সামার কোট, হাবিবের করা চুলদাড়ি, চশমার কাচ শূন্যের মত স্বচ্ছ। সব মিলিয়ে একটা তৈরি করা ডাউন টু আর্থ থাকা। কী আর, শিল্পীর খেয়াল... এদিকে আমাদের হরেকৃষ্ণ রায়ের কোমরে গোঁজা থাকত তবলা সুর করার ছোট্ট হাতুরি। সেটাও তিনি ধারণ করতেন। সেটা দেখা যেত না, এই যা। প্রয়োজনে বের করে তবলার অন্তরে সুরের প্রেরণা ঢুকিয়ে দিতেন।  



হরেকৃষ্ণ রায় নেই। হয়তো তাঁর অনেক স্মরণসভা হবে। বক্তৃতা হবে। পুষ্পার্ঘ্য প্রদান করা হবে। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বটি চারিয়ে দেওয়া যাবে না নতুন প্রজন্মের কাছে। তাঁর ফেলে যাওয়া সারল্যের উত্তরাধিকার থাকবে না। সারা রাজ্যে যদি একদিন অন্তত তাঁর ছাত্ররা নিজেদের ছাত্রদের কাছে সেই সরলতার গল্প করেন... যদি তাঁর দেবার প্রবণতাকে স্মরণ করেন, কী ভালো হয়। জীবনে তো মাত্র দুটি চরম, জন্ম আর মৃত্যু। মাঝখানে পড়ে থাকে সুর ছুটে যাওয়া এক বাদ্যযন্ত্র। তাতে সুরযোজনার চেষ্টাই তো সবাই করে যাচ্ছি আমরা... শুধু আমরা ধারণ করতে পারিনি সেই হাতুরিটা...।


প্রতিবেদনঃ অশোক দেব,বিশিষ্ট লেখক,ত্রিপুরা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. আমার সঙ্গীত জীবনের শুরু(1969) থেকেই হরেকৃষ্ণ বাবুর সঙ্গে পরিচয় আমার প্রথম তবলা শিক্ষক স্ব:গৌরাঙ্গ শীল মহাশয়ের মাধ্যমে।পরে তা আরো গভীর হয় যখন প:যুগল সরকারের কাছে আসা যাওয়া হতে থাকে আমার ।হরেকৃষ্ণ বাবু নিতান্তই সহজ সরল একটি মানুষ ছিলেন। এবং সত্যি কথা ওঁর বাড়িতে যতবার ই গেছি সেটা যেন আরো বেশি করে ধরা পড়েছে । আমার মূল বিষয় কন্থসঙ্গীত এবং হরেকৃষ্ণ বাবুর অপূর্ব সঙ্গত বহুবার শ্রোতাবন্ধুদের প্রশংসা পাবার পথে সহায়ক হয়ে উঠেছে । আগরতলা দুরদর্শনের বিরুদ্ধে তপনরায় প্রধান থাকালীন সাম্মানিক নিয়ে যখন আমি আইনের দ্বারস্থ হয় তখন এই হরেকৃষ্ণ বাবুই ছিলেন আমার বড় সাপোর্টার । আর সকল শিল্পী বন্ধুরাই পিছিয়ে গেছিলেন দুরদর্ধন কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হবেন এই ভয়ে ।এহেন মানুষটি আজ আমাদের মধ্যে নেই ।পেশাগত ব্যস্ততার জন্যে যোগাযোগটা ক্ষীণ ছিল কিন্তু তবু ও ছিল।কিন্তু আজ তিনি যেখানে আছেন সেখানে যোগাযোগ রাখার কোন উপায় ই নেই ।তবু তাঁর আত্মার সদগতি কামনা করি ও নমস্কার জানাই।

    উত্তরমুছুন