জীবনে চলার পথে চেনা-অচেনার হাজার ভিড়ের মধ্যেও কেউ কেউ আমাদের মনে জায়গা করে নেয় অকপটে। ওরা আসে নিজেদের মতো করে, আবার হয়তো চলেও যায়। শুধু ব্যক্তিত্বের গুনে স্মৃতিতে বেঁচে থাকে ওরা দীর্ঘ দিনের পরিচিত হয়ে। আমার প্রায় তিন যুগ কাটানো আমেরিকার জীবনে এমনিতরো মানুষের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। এদের সাথে পরিচয়ে আর কিছু না হোক অশেষ অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই আমি। জীবনকে দেখতে হয়তো শিখি অন্য ধারণার আঙ্গিকে।
মাস ছয়েক আগের ঘটনা। সেদিনটা ছিল শুক্রবার। আমাদের ছেলে তুতাই -এর মার্শাল আর্ট স্কুলের মান্থলি টেস্ট। Grandmaster Seo'র কড়া নির্দেশ পরীক্ষার দিনগুলোতে স্টুডেন্টদের অভিভাবক কাউকে স্কুলে উপস্থিত থাকতেই হবে। অনেক ভেবে-চিন্তে তাই তিনি টেস্ট শুধু শুক্রবার সন্ধ্যায় নেবার প্ল্যান করেছেন, যাতে অভিভাবকদের আসাটা সহজ হয়। সপ্তাহ-শেষের অফিস ফেরৎ ক্লান্ত চেহারা নিয়ে আটলান্টার শুক্রবারের ভয়ঙ্কর ট্রাফিক পেরিয়ে যখন বাবা-মা' রা Master Seo'র স্কুলের দরজার চৌকাঠ পেরোয়, ওদেরকে Carl Lewis, Michael Jhonson,বা আমাদের P. T. Usha'র থেকে কম মনে হয় না। কারণ, আটলান্টার ট্রাফিক হলো পৃথিবীর সবচে' খারাপ ট্রাফিক এর অন্যতম একটি। সেই যানজট পেরিয়ে সময় মতো কোথাও পৌঁছানো চাট্টিখানি কথা নয়। আর Master Seo এক কথার মানুষ।ঠিক সাতটায় তার হলে ঝোলানো বিশাল বড় Gong বাজিয়ে সকলকে জানিয়ে দেন --- টেস্ট শুরু। ওই সাতটায় যে অভিভাবকরা হলে পৌঁছাবেন না তাদের ছেলে মেয়েদের সেই মাসের পরীক্ষা দেওয়া বন্ধ। এই কঠোর ডিসিপ্লিনের সামনে কেউ কথা বলে না।
যাইহোক, আমরা ক'জন 'হোম-মেকার' মায়েরা সময়মতো পৌঁছে গেছি সেদিনও। তড়িঘড়ি অফিস ফেরৎ বাবা-মায়েরাও ঢুকলো পরপর। সবার শেষে দুজন ঢুকলো প্রায় দৌড়ে -- দরজা বন্ধ হবার ঠিক আগে। নিক (Nick) কে দেখে বুঝলাম সাথের বয়স্ক লোকটি ওর কোনো অভিভাবক হবেন। যাইহোক, আমাদের উৎসাহকে আর বাড়তে না দিয়ে পাশের সিটে বসতে বসতে ভদ্রলোক নিজেই বললেন, "Hi, I am Richard, Nick's grandfather!" বললেন, উনি আর কখনো এই স্কুলে আসেননি। অবশ্য আমি সেটা অনুমান করতে পেরেছিলাম -- যখন উনি জুতো পড়েই ভেতরে চলে এসেছিলেন। এই স্কুলে জুতো পায়ে ভেতরে যাওয়া বারন। কাজেই ওটা উনাকে জানানো হলো।
মিঃ রিচার্ড কয়েক মিনিটের মধ্যে বাইরে জুতো রেখে দিয়ে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাতে জানাতে ফিরলে আমি জিজ্ঞেস করলাম,” কি হয়েছে মিঃ রিচার্ড?" একগাল হাসি নিয়ে গলার স্বর নামিয়ে দিয়ে বললেন, "ভাগ্যিস আজ পায়ের আঙ্গুল বের হয়ে যাওয়া ছেঁড়া মোজা পড়ে আসিনি"! আমরা সবাই হেসে ফেললাম।
ওদিকে পরীক্ষার জন্য স্টুডেন্টরা তৈরী হচ্ছে আর আমরা শুনে যাচ্ছি মিঃ রিচার্ডের নন-স্টপ কথার ফুলঝুরি। হলের ভেতরের ক্লান্তির হাওয়াটা ততক্ষণে কেটে বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। মিঃ রিচার্ড ঘুরে ফিরে সকলের সাথেই কথা বলছেন। হঠাৎ তিনি ঘোষণা করলেন আগামীকাল দুটো কারণে উনার একটি স্পেশাল দিন।কাল উনার বাহাত্তরতম জন্মদিন আর কালই উনি দ্বিতীয়বারের মত বিয়ে করতে চলেছেন চুয়ান্ন বছর বয়সী তার প্রেমিকা আন্দ্রিয়াকে (Andrea)! তার ঠিক দু'দিন পরই হানিমুনে বেরিয়ে পড়বেন প্যারিসের উদ্দেশ্যে।
দুই বা আরও বেশি জেনারেশন ধরে যারা আমেরিকায় আছেন, তাদের কাছে এমনি গল্প খুবই স্বাভাবিক মনে হলেও এক্সট্রা ডানা-না-গজানো প্রথম জেনারেশনের কাছে বাহাত্তর বছর বয়সে দ্বিতীয়বার বিয়ে, হানিমুন -- সত্যি জেনেও কেমন যেন গল্পের মতো শোনালো। আমি আর আমার ক'জন দেশি আর চাইনীজ বান্ধবীর গলা থেকে সমস্বরে বেরিয়ে এলো "ওয়াও !"
ঘন্টা দেড়েক ধরে চললো মার্শাল আর্টস স্কুলের পরীক্ষা। হল থেকে বেরিয়ে আসার আগে সকলে মিলে অগ্রিম অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা জানালাম মিঃ রিচার্ড এর জন্মদিন আর তার আগামী দিনগুলোর জন্য। হাত তুলে সকলকে বিদায় জানিয়ে নাতিকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মিঃ রিচার্ড। আমরা বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করলাম পরের সপ্তাহের ক্লাসের দিনে নিক-এর হাতে তার গ্রান্ডফাদারের বিয়ের একটি উপহার পাঠিয়ে দেব।
ছেলে তুতাইকে নিয়ে বাড়ি আসার পথে বারবার মনে পড়ছিলো প্রাণোচ্ছল মিঃ রিচার্ডের কথা। যিনি অচেনা হয়েও আমাদের সকলের চির চেনা হয়ে গেলেন মাত্র দু 'ঘন্টার পরিচয়ে। খুশিতে, আনন্দে চলার আশায় জীবনকে বয়সের হিসেবে না দেখেও কত সাবলীল ভাবে চলা যেতে পারে --- তার উদাহরণ হয়তো মিঃ রিচার্ডের মতো লোকেরাই !
জবা চৌধুরী, আটলান্টা
১৮ই জানুয়ারি ২০১৯ইং