বামপাশের ছেলেটা উরুর উপর চড়ে বসেছে । তার শরীরের চাপে বহু পুরনো ব্যথাটা যেন চাগিয়ে উঠেছে । ডাক্তার সাহেব গুলিটা কি বের করতে পেরেছিলেন ? আজকাল কিছু মনে থাকেনা । বয়স তো আর কম হলনা বাষট্টি চলছে বোধ হয় । কিন্তু ছেলেটি পায়ের উপর বসল কেন তিনি সেটা বুঝতে পারছেন না । তাদের কাজে তো কোন বাঁধা দেওয়া হয়নি । ছেলেটাকে কি উরুর ব্যথাটার কথা বলবে ? না থাক , যত কম বলা যায় তত ভাল ।
ডান পাশের ছেলেটার একহাত আজমল সাহেবের গলায় সাঁড়াশির মত চেপে আছে অন্য হাত দিয়ে তার পাঁজরে ছুরি ঠেকিয়ে আছে ।
বামপাশের ছেলেটা তার ব্যগ জামার পকেট এমন কি পাজামার ফিতার ঘর পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজছে ।
আমাদের কাছে খবর আছে আপনার কাছে আশি হাজার টাকা আছে । সেটা কোথায় ? বের করেন । ডানের ছেলেটা ভাঙ্গা খরখরে গলায় বলে উঠল । তার ছুরিটা মনে হল চামড়া ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে ।
আজমল সাহেব যন্ত্রণায় উহ করে উঠলেন ।
ফ্যসফ্যস করে বললেন , বাবারা আমি এত টাকা কোথায় পাব ? আমি নয় হাজার সাতশ টাকা এনেছি সেটা তো ব্যাগেই আছে ।
বুড়ো হয়ে মরতে বসেছেন এখনো মিথ্যা বলছেন ?
গলার হাতের চাপে শ্বাস আঁটকে আসছে । তিনি কি মারা যাচ্ছেন ?
সিএনজির একটানা ভটভট আওয়াজের মধ্যে কেমন একটা ঘুমঘুম ভাব । আজমল সাহেবের ঘুম আসছে , গভীর ঘুম । হটাৎ করে মনে হল তিনি কে ? এরা কারা ? এসব কি হচ্ছে ? কিছুক্ষণের মধ্যে ব্রেনের মেমোরী সেল স্মরণ করিয়ে দিল , তিনি আজমল হোসেন , বেসরকারি বরেন্দ্র বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী বিএসসি শিক্ষক । সারাজীবনে একবারও প্রমোশন পাননি । একশত টাকা বাড়ি ভাড়া আর দেড়শত টাকা চিকিৎসা ভাতা সহ সরকার থেকে সর্বমোট বেতন পেতেন আট হাজার তিনশত পঞ্চাশ টাকা । তিনি সার্টিফিকেট ধারী একজন মুক্তিযোদ্ধা ।
তিনদিন আগে কাউন্টারে কোন টিকেট না পেয়ে আজ ব্ল্যাকে চড়া দামে তৃতীয় শ্রেণীর একটি টিকেট কিনে রাজশাহী থেকে ট্রেনে চড়েছিলেন । ট্রেন চার ঘণ্টা লেট ।
ব্যাগে যে টাকাগুলো আছে সেটা তিনি ঘুষ দিতে নিয়ে যাচ্ছেন । কারণ ঘুষের অভাবে তার অবসর ভাতার ফাইল একবছর ধরে এক টেবিলেই পড়ে আছে । রাজ্যের কাগজপত্র দিয়েও কোন কূলকিনারা করতে পারেননি ।
তার শরীর থেকে একচল্লিশ বছর আগে একবার রক্ত ঝরেছিল আজ আবারো পাজর ছিদ্র হয়ে টুপ টুপ করে রক্ত ঝরছে । সেদিনের সেই রক্তের সাথে আজকের এই রক্তের যোজন যোজন ব্যবধান । ছুরিটা বোধ হয় পাঁজরের আরও গভীরে গেল আহ !
আফজাল সাহেবের প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে তিনি বর্তমান ভুলে যাচ্ছেন তার মেমোরি সেল তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে সেই মাহেন্দ্রক্ষনে ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ............
তিনি এখন আর কোন বেসরকারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত বিএসসি শিক্ষক না । তিনি এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের ২য় বর্ষের মেধাবী ছাত্র মোহাম্মদ আজমল হোসেন । এক শীতের সকালে তার মা টিনের বাক্স্যে কিছু খাবারদাবার আর কাপড়চোপড় গুছিয়ে চোখ মুছেছিলেন ,ছেলে শহরে যাবে ভার্সিটিতে পড়বে বড় অফিসার হবে ।
নিতান্ত আটপৌরে জীবনে অভ্যস্ত ছিল আজমল । পড়ালেখা , বিকালের একটু আয়েশি ঘুম আর বড় জোর মোড়ের চায়ের দোকানে বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা । কিন্তু পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাত , রাস্তায় রাস্তায় ট্যাঙ্ক , আগুন ,মৃত্যু লাশ তার সব কিছু বদলে দিল । জীবনের সহজ অংক গুলো জটিল সমীকরণে রূপ নিল । কে যেন কানের কাচ্ছে নিরন্তর গুনগুন করে একই সুর বাঁজাতে লাগলো । তোর মায়ের আঁচলে টান পড়েছে এখনো কেন এই নির্লিপ্ততা ? বিশ্ববীণার সেই সুরে ছিল মৃত্যুকে পাড়ি দেবার আহ্বান ।
বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অনেক ছেলেকে পাক হানাদারেরা ধরে নিয়ে গিয়েছে । তাদের ভাগ্যে কি হয়েছে কেও জানেনা । আজমল আরও কয়েক ছাত্রের সাথে পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট চলে যায় ।
সেখানে আরও হাজার যুবকের সাথে যেদিন প্রথম কাঁধে অস্ত্র তুলে নিল সেদিন আচমকা সিনা টানটান হয়ে গিয়েছিল ।চোখের সবুজ রঙের স্বপনের সাথে মিশে গিয়েছিল রক্তের রঙ । সাধারণ আজমল হটাৎ করেই অসধারন হয়ে হয়ে উঠেছিল ।
ভারত থেকে একমাসের ট্রেনিং শেষে আজমলকে প্রথমে পাঠানো হয়েছিল তার নিজের থানা নিয়ামতপুরে সাথে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরও পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা ।
এখানে এসে দেখল রাজাকারেরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে ।এমন কোন বাড়ি নেই যে বাড়িতে তারা লুঠতরাজ চালায়নি । অস্ত্রের মুখে এলাকার যুবকদেরকে তাদের দলে যোগ দিতে বাধ্য করছে । আর এদের নাটের গুরু জামায়াত নেতা আলফাজ চৌধুরী ।
পাক আর্মিরা নিয়ামতপুর থানায় ঘাঁটি গেড়েছে সেখানে বিশাল বাঙ্কার খুঁড়েছে আর ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস বাঙ্গালী যুবক বৃদ্ধরাই অস্ত্রের মুখে এই বাঙ্কার খুঁড়তে বাধ্য হয়েছে । এ যেন নিজের কবর নিজেই খোড়ার আয়োজন । আজমল দিব্য চোখে দেখতে পেল তার বৃদ্ধ বাবা মাটির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে যাচ্ছেন আর অসহায়ের মত সবার অলক্ষ্যে হাত উলটিয়ে চোখ মুছছেন । আজমলের দুই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় , মুখ দিয়ে গালি বের হয়ে আসে , শালা বেজন্মারা ......।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ের একটা বর্ষণমুখর রাত । আকাশে চাঁদ নেই , আলো দেখানোর জন্য তারা ও নেই । প্রচণ্ড ঝড়ে যেন বাইরের সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে । চণ্ডী পুরের একটি বাড়ি । তারই একটি কক্ষে একটি প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে আর সে প্রদীপকে ঘিরে মেঝেতে গোল হয়ে বসে আছে জনা পঁচিশ যুবক । উসকোখুসকো চুল , উদ্ভ্রান্ত চেহারা , না জানি কত রাত বিনিদ্র কেটেছে , কত দিন কেটে গিয়েছে পরিশ্রমে । মাটির দেওয়ালে যুবকদের ছায়া গুলো তিরতির করে কাঁপছে । তবে একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে সবার চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক রকমের তীক্ষ্ণ এবং ভয় শুন্য ।
কিছুক্ষণ আগেই তারা রাজাকার নেতা আলফাজ চৌধুরীর বাড়িতে অপারেশন করে এসেছে । সেখান থেকে কিছু অস্ত্র লুট করে এনেছে । তারা বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা আছি । রাজাকারেরা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালাতে পারে । সেই বিষয়ে পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে আজমল সবার মতামত নিচ্ছে । একটা বিষয়ে সবাই একমত হল যে এখানে পাক আর্মিদের সংখ্যা খুব কম তারা মুলত রাজাকার আর কিছু বিহারী দেরকে সংগঠিত করে বাঙ্গালিদের পিছনে লেলিয়ে দিয়েছে । রাজাকারদের কে যদি কোণঠাসা করা যায় তাহলে পাক হানাদারেরা লেজ গুটাবে ।
রাত আরও গভীর হয় । চারদিকে সুনসান নিরবতা । অনেক আগেই ঝড়বৃষ্টি থেমে গিয়েছে । ছোট্ট মফস্বল শহর টি যেন কালো ভালুকের মত মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে । হঠাৎ করে পাড়ার কুকুর গুলোর ঘেউ ঘেউ আওয়াজে ঘরের সবাই সতর্ক হয়ে যায় । আজমল বিপদ আঁচ করতে পেরে চোখের ইশারায় যার যার অবস্থানে চলে যেতে বলে । বাইরে থেকে গুলি শুরু হয়েছে । শত্রুরা তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে । বাড়িটা মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা দরোজা ভিতর থেকে বন্ধ । মুক্তি সৈনিকেরা পাল্টা গুলি ছোড়ে । থেমে থেমে কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলে ।
ইতিমধ্যে আজমল বুঝতে পারে ভারী কিছু দিয়ে শত্রু পক্ষ দরোজা ভাঙার চেষ্টা করছে আজমল দরোজার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় দরোজা ভাঙার সাথে সাথে সে গুলি চালায় । তার চোখের সামনেই দুইটা লাশ পড়ে যায় । শত্রুরা পিছনে হটে যাচ্ছে আজমলের পিছনে অন্যরা বেরিয়ে এসে আক্রমণ শুরু করেছে আজমল আরও সামনে এগিয়ে যায় হঠাৎ করে একটা গুলি তার উরুতে এসে লাগে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে দেখতে পেল ওরা পালাচ্ছে অদূরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা লাশ পড়ে আছে । আজমল একদলা থুতু ফেলে চিৎকার করে বলে ,
পালাস কেন ? দাঁড়া , শালা ............।
মিজান তার কোমর থেকে গামছা খুলে আজমলের গুলিবিদ্ধ উরুতে শক্ত করে বেঁধে দেয়। ধীরে ধীরে সবুজ রঙের গামছা রক্ত বর্ণ ধারণ করে ।
এখানে আর থাকা নিরাপদ নয় আজমল পায়ের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সহযোদ্ধাদের সাথে রাস্তায় নেমে পড়ে । কিন্তু সাংশৈল হাটে এসে আর চলতে পারলনা মাটিতেই শুয়ে পড়ল । পা থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে সে রক্তে মাটির অনেকটা অংশ ভিজে গেল ।
পরদিন রুদ্রপুরের মানুষ দেখল , রক্তের বৃত্ত আঁকা পরিত্যাক্ত একটি সবুজ গামছা, রক্তে ভেজা সোঁদা মাটি আর শায়লা নামের কোন এক যুবতীকে লেখা আজমলের চিঠি । তারা বুঝল এ পথেই হেঁটে গিয়েছে তাদের পবিত্র ছেলেরা । শ্রদ্ধায় তাদের মাথা অবনত হয়ে আসে । ঝাপসা হয়ে আসে কারো কারো বিনম্র দৃষ্টি ।
হাত বাড়ালেই যে মাকে ছোঁয়া যেত তার মুখখানি দেখা হলনা , গুলিবিদ্ধ পায়ের দগদগে ক্ষত নিয়েই আর এক মাকে বাঁচাতে সে এক রণাঙ্গন থেকে আর এক রণাঙ্গনে ছুটে বেড়িয়েছে । মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছে কিন্তু ভেঙে পড়েনি কারণ তখন তার সামনে একটাই ব্রত দেশ মাকে বাঁচাতে হবে । এরিস্টটলের একটা বাণী প্রতিনিয়ত তাকে সাহস যুগিয়েছে, “He who has overcome his fears will truly be free.”
১৬ই ডিসেম্বর , আজমল তখন নওগাঁ ইতোমধ্যে তারা জেনে ফেলেছে পাক হানাদারেরা লেজ গুটিয়ে নিয়েছে । ঢাকা সহ বিভিন্ন জায়গায় মারণাস্ত্রের অস্ত্রের আর্তনাদ থেমে গিয়েছে । চারদিকে বিজয় উল্লাস , আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে ‘জয়বাংলা’ ।
সে কি বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত হবে নাকি শোকের বেদনায় আপ্লুত হবে , সেটা বুঝতে পারছেনা আজমল । স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্র থেকে শোনা একটি গানের কলি তার বারবার করে মনে পড়ছে ,
তারা ফাঁসির কাঠে জীবন দিয়ে
প্রাণ পেয়েছে ,প্রাণ পেয়েছে ।
তারা গুলির ঘায়ে কলজে ছিঁড়ে প্রাণ পেয়েছে ।
১৮ই ডিসেম্বর নওগাঁ হানাদার মুক্ত হয় । প্রায় সাত মাস ধরে মনের যেসব দরোজা জানালা বন্ধ রেখেছিল ‘জয়বাংলা’ শব্দের সাথে সাথে যেন সেগুলো সব খুলে গেল ; আর জগতের সব মায়া হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল সে মনের ঘরে ।
একবুক স্বপ্ন নিয়ে ছুটে গিয়েছিল তার প্রিয় রুদ্রপুরে । মা ছেলেকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠবে , বোন খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে আর মুক্তির বিজয়ী সৈনিক বেশে প্রিয় সন্তানকে দেখে আনন্দে বাবার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠবে । যে চিঠি শায়লার কাছে পাঠানো হয়নি তার প্রতিটি কথা সে অভিমানিনীর কানে কানে বলবে ।
কিন্তু এরকম কোন ঘটনা ঘটলো না । যুদ্ধের আগুনে পুড়ে যাওয়া উঠানে শুধু হাহাকার আর শুন্যতা । পাকবাহিনী তার বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে তার ভাগ্যে কি ঘটেছে কেও জানেনা । দুই মাস আগে অন্তঃসত্ত্বা কুমারী বোন গলায় ফাঁস দিয়ে তার গ্লানি জুড়িয়েছে । শায়লা নামের কোন মেয়ে তার অপেক্ষায় নেই ।
মা তার চোখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন আর বার বার এক প্রশ্ন করেন , বা , আমার বেটা আজমল রে দেখছ ? কতদিন তার চোখমুখ দেখিনা ।
রক্ত আর অস্ত্রের সাথে থাকতে থাকতে আজমলের হৃদয় পাথর হয়ে গিয়েছিল । চারদিকে এত কান্না দেখতে দেখতে তার চোখের পানিও শুকিয়ে গিয়েছিল ।
পাশের বাড়ীর চাচী বলেছিলেন , বেটা একটু কাঁদ মন হাল্কা হবে।
কিন্তু আজমল সেদিন একটুও কাঁদেনি । যোদ্ধাদের কাঁদতে নেই ।
আস্তে আস্তে সবকিছু বদলে যেতে লাগলো । ফিকে হয়ে আসতে লাগলো স্বপ্নের রং । স্বঘোষিত রাজাকারদের গাড়িতে পতপত করে জাতীয় পতাকা ওড়ে । দেশভক্ত হিসেবে তারা পুরস্কৃত হয় । চারদিকে ঘুষ , দুর্নীতি ছলচাতুরি ।
যে আলফাজ চৌধুরীর জন্য সে বাবাকে হারিয়েছে বোনকে হারিয়েছে তার কোন বিচার হয়নি । সে আজ তার স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি । বিজয় দিবসে , স্বাধীনতা দিবসে আলফাজ চৌধুরী যখন ষ্টেজে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকা উঠায় আজমল বিভ্রান্ত হয় ।তার পাথর হৃদয়ে রক্ত ঝরে , লজ্জায় ঘৃণায় শুকনা চোখ পানিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে , তার গুলিবিদ্ধ পা টা ব্যথায় টনটন করে , মুখ দিয়ে একরাশ হতাশা ঝড়ে পড়ে ,
কি পেলাম ?
হেই চাচা মিয়া , ঘুমায়া পড়লেন নাকি ?
যুবকের কর্কশ আওয়াজ নিউরনে আলোড়ন তোলে । আজমল সাহেব আবারো বর্তমানে ফিরে আসেন । তিনি আজমল হোসেন অবসর প্রাপ্ত সহকারী বিএসসি শিক্ষ্ক , আলো ঝলমলে কালো পীচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন পিছনে দুই ছায়া মূর্তি । তাদের মুখ দেখা যাচ্ছেনা । সিএনজি থেকে ক্রমাগত ভটভট আওয়াজ আসছে ।
শুনেন চাচা মিয়া , আপনি মুরব্বি বলে চোখে মলম লাগালাম না ।এখান থেকে সোজা সামনের দিকে চলে যাবেন পিছন ফিরে দেখবেন না । পিছন ফিরলেই পেট চিরে নাড়ীভুঁড়ি বের করে ফেলব ।
আজমল সাহেব পিছনে ফিরে দেখেন না । কিন্তু সামনেও এগোতে পারেন না । তিনি সেখানেই হাঁটু ভেঙে বসে পড়েন ।ছোটবড় গাড়ী গুলো তাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলেছে । পায়ে চলা পথিকেরা তাঁকে এক নজর দেখে হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে । যেন কিছুই ঘটেনি তারা কিছুই দেখেনি । ব্যাগটা ওরা নিয়ে গিয়েছে সাথে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট । যাক , সার্টিফিকেট দিয়ে কি হবে ?
আহ ! পা টা ব্যথায় টনটন করছে । গুলিটা কি ভিতরে ছিল ? তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে । মেমোরি সেল থেকে সব ছবি মুছে যাচ্ছে । সেখানে একটা রক্তাক্ত ছবি স্থির হয়ে আছে । কোথায় যেন একটা কবিতা পড়েছিলেন ,
আমার চেতনা ঘিরে বিচ্ছুরিত এক কণা
গড়ে তোলে আর এক রক্তিম চেতনা
পৃথিবীর সব কথা ম্লান ভেবে , অনেক বিস্মৃত্র
মুছে ফেলে আজ জেগে থাক রক্তাক্ত স্মৃতি ।
পাঁজর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে সে রক্তে কাল পীচের রাস্তা লাল হয়ে উঠছে আজমল সাহেব হাতড়ে হাতড়ে একটা গামছা খুঁজছেন । সবুজ রঙের একটা গামছা । তিনি সে গামছায় আবারো লাল রঙের একটা বৃত্ত আঁকতে চান ‘রক্তের বৃত্ত’ ।
-- ম্যারিনা নাসরিন সীমা,বাংলাদেশ
১২ই মে ২০১৯ইং