Type Here to Get Search Results !

মন-খারাপের জাদুঘর " ......... আমেরিকা থেকে জবা চৌধুরী

শ্রাবণের মেঘলা আকাশের ভার বয়ে নেওয়া তারিখগুলো ক্যালেন্ডারে ভাদ্রের পাতা ছুঁই ছুঁই করতেই মনে কেমন যেন একটা খুশির হাওয়া বয়ে যায়। সেই হাওয়ায় মিশে থাকে আমার মন কেড়ে নেওয়া মিষ্টি কিছু শিউলি ফুল, আর নরম পাপড়ি মেলা হালকা গন্ধ ছড়ানো কিছু স্থলপদ্ম। সেই ককটেল গন্ধে আরও কতো ফুল মিশে থাকে, সে সব নাম আর মনে নেই ! মনে পড়ে আমার ছোটবেলার ইট-বাঁধানো সেই উঠোন, শরতের ফুলের ভারে নুয়ে পড়া বিশাল শিউলি গাছটা, কলতলার গা ঘেঁষে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়ানো খুশি খুশি একটা গোলাপি আর একটা সাদা স্থলপদ্মের গাছ। গোলাপ আর বেশ কয়েক রকমের জবা তো থাকতোই  --ওরাই যে সারা বছর ধরে হেসে খেলে বাগানের মানটা বাঁচিয়ে রাখতো।  সেই কতগুলো যুগ আগের কথা ! তবু, প্রতি বছরই বর্ষার হাত ধরে শ্রাবণ বিদায় নিলেই সেই ফুলগুলো যেন এখনো আমায় ডাকে । 
আহ্! কুয়াশায় ঢাকা সেই ভোরগুলো ! আর কেউ বিছানা ছেড়ে উঠুক, না উঠুক,খাটের  তলায়  লুকিয়ে রাখা একটা বড় মাপের সাঁঝি নিয়ে আমি ঠিক চলে যেতাম উঠোনে। শিউলি ফুল কুড়িয়ে সাঁঝি ভরতে হবে আমাকে। সাঁঝিটা আমাকে লুকিয়ে রাখতেই হতো খাটের তলায়। মা'র খুব ভয় ছিল, ভোরে বাইরে গেলেই আমার ঠান্ডা লেগে যাবে। সেই ভোরগুলোতে আরও একটা নিয়মের হেরফের হতো না কখনো -- মর্নিং-ওয়াকে বেরোবার আগে ঠিক মনে রেখে আমার মাথায় স্কার্ফ বেঁধে দিয়ে যেত বাবা। 
বাড়ির ভেতর থেকে দেখলে বিশাল বড় আম গাছটার ডানদিকেই ছিলো আমাদের বাড়ির গেইট। মর্নিং-ওয়াকে বেরিয়ে যাবার সময় বাইরে থেকে কী করে যেন বাবা গেইটটা লক করে যেতো। আর ঠিক তক্ষুনি একটা না একটা আমপাতা টুপ্ করে রোজ ঝরে পড়তো মাটিতে। মুখ তুলে তাকাতে হতো না। ওই শব্দ ছিল আমার খুব চেনা।  আমি ঠিক বুঝে যেতাম বাবা বেরিয়ে পড়েছে। শান্ত ভোরে কান পাতলে পাখিদের ভোরের মিষ্টি ডাক থেকে শুরু করে কতো কী শোনা যায় ! ভোরে না উঠলে এসব হয়তো কখনো জানাই হতো না।
 প্রবাসী জীবন বেছে নেবার পর থেকে দেশের শরৎকালটা শুধুই স্মৃতিতে। বিদেশে 'পূজোর ছুটি'র কোনো সুযোগ নেই। একবার অনেক চেষ্টা করে দু'সপ্তাহের জন্য পূজোর সময়টা দেশে কাটাতে গেছিলাম। কিন্তু আমার চেনা শরৎ ততদিনে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। শিউলি গাছটাও আমাকে না জানিয়েই বিদায় নিয়েছে। সেই জায়গাটা জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে কয়েকটা নতুন ঘর। সুন্দর বাগানটা হারিয়ে যাওয়াতে ওই ঘরগুলোতে আমার মন লাগেনি কোনোদিন। তবু -- জীবনের প্রয়োজনকে বাদ দেওয়া কঠিন।
তারপর প্রতি বছর দেশে যাওয়া-আসা চলতেই থাকলো আর জীবনের সাথে জুড়তে থাকলো বয়স আর নানা রোগ-শোক। দেখতে দেখতে কখন যেন হৈ-হুল্লোড়ে ভরা সেই ঘরের ভেতরগুলো খালি হতে হতে একসময় কেমন  নিঃশ্চুপ হয়ে পড়লো। ঘরের অনেকগুলো মানুষ চুপ হয়ে দেওয়ালে ছবির ফ্রেমে বন্দি হয়ে গেলো। অসহনীয় সেই নীরবতা। 

এখনো দেশে যাই। দরজা পেরিয়ে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে হাঁটতে গিয়ে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াই। বাবা, কাকু, কাকুমনি, একমাত্র ভাই, আমার প্রিয় কাকি --- সবাই কেমন শুধু তাকিয়েই থাকে নানা ফ্রেমের ভেতর থেকে। ওদেরকে দেখি আর মনের ভেতরে জেগে ওঠা সব স্মৃতিগুলোকে সামলাই। জীবনের প্রয়োজনে বানানো ঘরগুলোকে আবার ফ্যাকাশে লাগে। চোখগুলো ভরে ওঠে জলে।  

ধীরে ধীরে আবার শরতের কুয়াশা-ঢাকা, ফেলে আসা ভোরগুলো স্পষ্ট হয়। শিউলি ফুলগুলোর তাজা গন্ধে মন ভরে যায়। দেখি, এক সাঁঝিভরা ফুল নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে --- মাথার স্কার্ফটা ঠেলে কোঁকড়া চুলগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে।  মুখে একটা অমলিন হাসি --- যে ছবি আর কোথাও নেই, থাকবেও না --- থাকবে শুধুই আমার মনজুড়ে....আমার মনখারাপের জাদুঘরে।









জবা চৌধুরী, আটলান্টা 

ছবিঋণঃ ইন্টারনেটের সৌজন্যে 

৩১শে আগস্ট ২০১৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.