Type Here to Get Search Results !

"নারী এবার জেগে ওঠো, স্বাবলম্বী হও’ ...... যশোর থেকে সালমা তালুকদার

এখনো দিনে রাতে স্ত্রীরা তাদের স্বামীর হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে যাচ্ছে। কারণ এখনো তারা স্ত্রী, মানে কারো অধীনে থাকা কেউ। যার নিজেকে চালানোর মতো  কোনো যোগ্যতা নেই। স্বামীর টাকার ওপর যার বসবাস। সুতরাং স্বামী তার সেই সব স্ত্রীর ওপর নির্যাতন করবে, এটাই স্বাভাবিক! আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী একজন নারী কখনো শুধু স্ত্রী হয় না। তার একটা পরিচয় থাকে। সে একজন মানুষ। নারী সুযোগ করে দিচ্ছে নির্যাতনের। এখানে পুরুষের দোষ কোথায়!

ঘরে একজন গৃহপরিচারিকা রাখলেও তাকে কাজের বিনিময়ে টাকা দেয়া হয়। সেই গৃহপরিচারিকার যখন ইচ্ছে কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার অধিকার থাকে। আর একজন নারী তো কেবল স্বামী বেচারার টাকায় ভাগ বসাতেই থাকে। সেটা নিজের চাহিদার কারণে হোক অথবা বছর বছর সন্তান জন্মদানের মধ্য দিয়ে হোক। একটা মানুষ নিজের অর্জিত টাকা দিয়ে কত ভালোভাবে জীবন পার করতে পারতো। নিজের সব চাহিদা মেটাতে পারতো। সেখানে পরিবারে তার স্ত্রী ,সন্তানকে দেখতে গিয়ে তাকে অনেক বড় কিছু করতে হচ্ছে। এটা কয়জন পুরুষের মানতে ইচ্ছে করে! 

অবশ্যই একজন পুরুষ তার নিশ্চিত একটা ঘর চায়। দিনশেষে এসে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চায়। কিন্তু যখন সেই ঘরে অনেকগুলো মুখ তার একার উপার্জনের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন কি আর তার ভালো লাগার কথা। নাকি নিজের টাকায় খাইয়ে পড়িয়ে কারো কথা শোনার কথা? স্ত্রী যদি কোনো ব্যপারে মতের অমিল দেখায় তখন গায়ের জোড়ে হলেও স্ত্রীকে দাবানোর চেষ্টা করে স্বামী। 

অনেক সময় স্বামী স্ত্রীতে যখন কথা কাটাকাটি হয়,তখন দেখবেন ঝগড়ার এক পর্যায়ে স্বামী বলে বসে, আমার টাকায় খেয়ে পড়ে আবার আমার মুখের উপর কথা বলো! অথবা এটা আমার ঘর। তুমি বের হয়ে যাও। এসব কথা একজন স্বামী যখন বলে তখন সেই রক্তমাংসের স্ত্রীটির কেমন লাগে,সেই খোঁজ কি কেউ রাখে! 

আমার খুব কাছের একজনের সাথে সেদিন গল্পে গল্পে একটা ঘটনা শুনলাম। তাদের নিজেদের বাড়িতে এমন এক ভাড়াটিয়া থাকে যে লোক তার স্ত্রীকে কথায় কথায় খুব বাজে ভাবে মারে। তো বাড়ির মালিক খালাম্মা সেই ভাড়াটিয়া লোকের এসব কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। আর লোকটি বলে, ‘এটা আমার পারিবারিক বিষয়। আমি আমার বউকে মারবো, কাটবো তাতে আপনার কি!’ তখন খালাম্মা বলেন, ‘আমার বাড়িতে এসব চলবে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে নারী নির্যাতন মামলায় জেলে ঢুকাবো।’ লোকটি ভয় পেয়ে আর বাড়াবাড়ি করেনি সত্যি। 

তবে বলেছে, ‘আমি আর এই বাড়িতে থাকবোই না।’ বাড়ির মালিকও বলেছেন, ‘চলে যাও। আমি বেঁচে যাই।’

কিন্তু এটা কোনো সমাধান হলো না। সেই লোক অন্য কোথাও বাসা ভাড়া নেবে এবং এভাবেই বউ পেটাবে। কারণ স্ত্রীর উপর স্বামীর পূর্ণ অধিকার আছে। স্ত্রীকে খাওয়াবে,পড়াবে আবার অন্যায় করুক বা না করুক শাসন করার অধিকার স্বামীর আছে। আবার স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তান কিন্তু শুধু তার। তার টাকায় বড় হওয়া সন্তানকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখে বৃদ্ধ বয়সে এই সন্তান তাকে লালন পালন করবে। কারণ স্ত্রী, সন্তানকে সে দেখভাল করেছে। সুতরাং এই চাওয়া তার নৈতিক চাওয়া।

এখন কথা হলো, তার চাওয়ার মাঝে কোনো ভেজাল নেই। ভেজাল তার জীবনযাপনের পদ্ধতিতে। সে জানেই না, প্রতিটি মানুষের একটা স্বকীয়তা আছে। প্রতিটা মানুষের নিজস্বতা বলে কিছু আছে। মান সম্মান আছে। প্রতিটা মানুষের নিজের বিচার বিবেচনা একত্রিত করে কথা বলার স্বাধীনতা আছে। এসব কিছু চিন্তা না করে সে শুধু চিন্তা করে, আমি স্বামী আর সে আমার গৃহপালিত স্ত্রী। তাকে যেমন ইচ্ছে তেমনি করে পরিচালিত করার অধিকার আমি রাখি।

এখানে আর একটা ব্যাপার আছে। এখনো আমাদের দেশের অনেক স্বামী  চায়না তার স্ত্রী চাকরি করুক। এ ব্যাপারে তার যুক্তি হচ্ছে, সংসার সন্তান দেখবে কে! বলার সময় একবার ও স্বামীর মাথায় আসে না কতবড় একটা দায়িত্ব সে তার স্ত্রীর উপর সমর্পণ করছে। আর এই দায়িত্বের বোঝা বাইরে গিয়ে টাকা উপার্জনের চেয়েও অনেক বড়।

তবে এখানে একটা কথা আছে, একজন স্ত্রী যখন সংসারের সব দায়িত্ব কাঁধে নেবেন তখন একজন স্বামী পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন। এবং পঙ্গু হয়ে যাবেন। তিনি শুধু উপার্জন করবেন। নিজের জরুরি কাজগুলোও তার স্ত্রী করে দিবে। যদি কোনো দুর্ঘটনায় স্ত্রীর মৃত্যু হয়,তখন স্বামীর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। এবং তিনি তখন আরেকটা বিয়ে করেন। যুক্তি হিসেবে সমাজের মানুষও বলে,’আহা! বেচারার কাজগুলো করার জন্য হলেও তো একজন বৌ জরুরি প্রয়োজন।’ আর এভাবেই আমাদের সমাজে নারীদের স্বামীর দাসী হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। যাই হোক এটা অন্য প্রসঙ্গ। 

বলছিলাম স্ত্রীকে স্বামীর যখন তখন শারীরিকভাবে নির্যাতন করা প্রসঙ্গে। স্বাবলম্বী হওয়ার পথে বাঁধা দিয়ে, সংসার সামলানোর দায়িত্ব অর্পণ করে আবার সাংসারিক অথবা ব্যক্তিগত ঝামেলার কারণে যখন তখন স্ত্রীর শরীরে আঘাত করা ঘোরতর অন্যায় কাজ। এই শারীরিক নির্যাতনের কারণে একজন স্ত্রী যে শুধু শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা কিন্তু নয়। মানসিকভাবে ও ভীষণ ভেঙে পড়ে। এবং বর্তমানের এই পরিস্থিতির জন্য প্রতিনিয়ত সে নিজেকে দায়ী ভাবতে শুরু করে। আর একজন নির্যাতিত স্ত্রী যখন একজন মা তখন তার এই মানসিক বিপর্যয় তার সন্তানের ওপর চরম প্রভাব ফেলে। আর সেই সন্তান যখন বড় হয়ে সমাজে প্রবেশ করে তখন সমাজ একজন নৈতিকতা বিবর্জিত মানব সন্তান পায়। যে কিনা সমাজ,রাষ্ট্রের জন্য কখনো কখনো ক্ষতিকারক।

সুতরাং সমাজে, রাষ্ট্রের উন্নতিতে একটা পরিবারের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আজকে শুধু পুরুষের উপর আঙ্গুল তুলে কলম ধরেছি বলে, পুরুষদের অনুরোধ করবো রাগ,জিদ এগুলো মানুষের স্বভাবগত আচরণ। এসব আচরণকে কোনোভাবেই ভালো বলা যাবে না। আর মানবের ধর্ম হওয়া উচিৎ খারাপ কিছু থেকে নিজেকে বিরত রেখে ভালো আচরণের অনুশীলন করা।

 হঠাৎ রাগ হলেই যে সাথে থাকা স্ত্রীর গায়ে একটা হাত উঠাতে হবে। অথবা নিজের বলিষ্ঠ  অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা একজন কোমল নারীকে নির্যাতন করতে হবে এটা ঠিক না। প্রতিটা মানুষের একটা পরিচয় হচ্ছে সে মানুষ। জন্মগতভাবে একজন পুরুষের গঠন অনেক বলিষ্ঠ। আর নারীর শারীরিক গঠন অনেক কোমল। সন্তান জন্ম দেয়ার ফলে নারীদের শরীরে আরো অনেক পরিবর্তন হয়। যার ফলে একজন মাকে বাকি জীবন সুস্থভাবে বাঁচতে হলে অনেক নিয়ম মেনে, সাবধানে চলতে হয়।

 যেমন সিজারিয়ান একজন মা তার বাকি জীবনে কখনো ভারী কিছু তুলতে পারবেন না। অথবা নরমাল ডেলিভারিতে যেসব মায়েরা সন্তান জন্ম দেন তারাও যদি ভারী জিনিস তোলেন তাহলে একটা সময়ে তাদের জরায়ু নিচের দিকে নেমে যায়। অথচ পৃথিবী সচল রাখতে হলে নারীদের সন্তান জন্ম দিতেই হবে। সেই নারীদের শরীরে,মনে আঘাত করার আগে একটা বার কি নিজের ছোটবেলা,নিজের মায়ের কথা,বোনের সাথে একসাথে খেলা করার কথা মনে আসে না?

শেষ কথা হচ্ছে, আমাদের সবারই উচিৎ নিজের পরিবারকে আপন করে নেয়া। শারীরিক মানসিক নির্যাতনকে না বলে একটা সুস্থ ও সুন্দর পরিবার গঠন করা।


সালমা তালুকদার 
স্পেশালএডুকেটর
প্রয়াস,যশোর অঞ্চল,
বাংলাদেশ

সম্পাদনা: প্রভাষ চৌধুরী, ঢাকা ব্যুরো এডিটর

২৪শে আগস্ট ২০১৯ 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.