মুখবন্ধ: খনা কিংবদন্তীর অন্তরাল থেকে উঠে আসা বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। ইতিহাসের কাছে তার থাকার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। শুধু লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে তার বচন। সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের জন্য বলে যাওয়া কিছু কথা। এমন কথা যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে চলতে সাহায্য করে। সময়ের ধারা বেয়ে তার রূপ পরিবর্তন হয়েছে, অনেক কিছু তার মধ্যে এসে মিশে গেছে। আজকের যুগের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তার অনেক কিছুই খেলো মনে হয়। তবু কিছু বচন আছে যা কৃষিভিত্তিক এবং হয়ত আজ ও কৃষক দের কাছে তার কিছু গুরুত্ব থাকতে পারে। সেই বচনের দায়বদ্ধতা আমার না। আমার বিনীত প্রয়াস শুধু প্রাচীন বাংলার আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক বিদুষী নারীর অস্তিত্বের লড়াই কে তুলে ধরা। যে সেচ্ছায় নিজের বাকরুদ্ধ করেছিল তার কথা কে গল্পের ছলে সবার কাছে নিয়ে আসা। যে বচনকে তখনকার সমাজ রুদ্ধ করতে চেয়েছিল, সেই বচন সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও কিছু অংশে বেঁচে আছে। এটাই হয়ত সেই অভিমানীনির বড় প্রাপ্তি। হয়ত এটাই সে চেয়েছিল।
দৃশ্য ১:
(কথক ঠাকুরের প্রবেশ| বন্দনা ও মুখবন্ধ|)
কথক ঠাকুর:
প্রথমে বন্দনা করি দেব নারায়ণ|
তাহার পরেতে বন্দি উপস্থিত জন||
ওপরে মালিক যার দুনিয়া জাহান|
জমীনের পরে মোরা তাহার সন্তান||
পূব আকাশে যেমন ভানুর উদয়|
পুরাতন কথা আমি বর্নিব নিশ্চয়||
(গ্রামের মেয়েরা কলসি কাঁখে নিয়ে জল ভরিতে যায়)
কথক ঠাকুর: ও কইন্ন্যা সকল| কই চললা? বসি দুখান গল্প শুনি যাও গো|
(একক এবং সমবেত কন্ঠের গান|)
গান:
গাগরী লইয়া কইন্ন্যা নদীর ঘাটে যায়|
কথকের ডাক শুইন্ন্যা পিছন পানে চায়||
কথক ঠাকুর কহে শুন কইন্ন্যা গণ|
পুরাতন কথা আমি বর্নিব এখন||
(মেয়েরা এসে কথক ঠাকুরের সামনে বসে পরে| কথক ঠাকুর গল্প বলা শুরু করেন|)
একদা আছিলা রাজা নাম চন্দ্রকেতু|
চন্দ্রকেতুগড় নাম তাহারই হেতু||
চন্দ্রকেতু রাজার যে ছিল এক নাতি|
চক্রকেতু নাম তার গুনের মুরতি||
অবন্তী নগরে প্রভু বিক্রম আদিত্য|
তাহার প্রতি রাজার ছিল আনুগত্য||
বিক্রমাদিত্যের ছিল নবরত্ন সভা|
বরাহ পন্ডিত ছিলা তাহাদের শোভা||
মানস করিলা তিনি বঙ্গদেশে আসা|
চক্রকেতু করিলেন আয়োজন খাসা||
তাহার পরেতে কিবা হইল ঘটনা|
করিতে বর্ণনা তাহা পালার রচনা||
বরাহ পন্ডিত তো আইস্যে পড়লেন চন্দ্রকেতুগড়|সঙ্গে তার স্ত্রী সরমা| তার পরেতে কি হইল শুনেন গো সবাই|
আনন্দিত চক্রকেতু বরাহের সনে|
আহ্বান করিলা তাহে চরণ বন্দনে||
নৃত্যগীত কতরূপ হইল সভায়|
পন্ডিতেরে লয়ে রাজা গৃহপানে যায়||
তাহার পরেতে কিবা হইল ঘটনা|
ধৈর্য ধরি তিষ্ঠ সুধী, করিব বর্ণনা||
(নেপথ্য সংগীত)
(রাজা এবং বরাহ পন্ডিত আরাম গৃহে প্রবেশ করেন এবং উপবিষ্ট হন)
রাজা: আশা করি পন্ডিত মহাশয়ের আপ্যায়নের কোনো প্রকার ত্রূটি ঘটে নি?
বরাহ পন্ডিত: অবশ্যই নয়| ব্যক্তিগত ভাবে আমি অতি অল্পেই তুষ্ট| তা ছাড়া আমি তো এই বঙ্গ দেশেরই সন্তান| জ্ঞানলাভার্থে আর্যাবর্তের বিভিন্ন প্রদেশে ভ্রমন| তবে নিজ দেশে ফিরে মনে অনবদ্য আনন্দসঞ্চার হয়েছে|
রাজা: শুনে মনে শান্তি অনুভব করলাম| আপনি যে বঙ্গ দেশেরই সন্তান তা জানা থাকলেও আগে কখনো সাক্ষ্যাতলাভের সৌভাগ্য হয় নি তো|
বরাহ পন্ডিত: তা অবশ্য ঘটে নি| আপনার পিতামহ পরম ভট্টারক মহারাজ শ্রী শ্রী চন্দ্রকেতু মহাশয়ের রাজত্য কালেই আমি বঙ্গ দেশ হতে নিস্ক্রান্ত হই| সে আজ থেকে প্রায় পঞ্চবিংশতি বছর আগের কথা|
রাজা: আমাদের অত্যন্ত গর্বের কথা যে বঙ্গ দেশের এক সন্তান আজ আর্যাবর্তের দিকপাল জ্যোতিষ শাস্ত্রের পন্ডিত| কি ভাবে সম্পাদন হল এই দুরুহ কার্য?
বরাহ পন্ডিত: সহজে নয়| আর্যাবর্তের বহু জনপদ ঘুরে অনেক জ্ঞান সঞ্চয় করে অবশেষে অবনীত হই আমি বিদিশা নগরী তে, সম্রাট বিক্রমাদিত্যের রাজসভায়| আপনি হয়ত অবগত আছেন যে বরাহ পন্ডিত আমার পিতৃদত্ত নাম নয়| এই নাম প্রাপ্তির সাথেই যুক্ত হয়ে আছে আমার নবরত্ন সভায় স্থান পাওয়ার কাহিনী|
রাজা: আপনি পথশ্রমে ক্লান্ত| তবু আপনার কথা শুনে সে কাহিনী জানতে বড়ই আগ্রহ হচ্ছে|
বরাহ পন্ডিত: দূর পথযাত্রার আমার বহুকালের অভ্যাস| তাই পথস্রম গাত্রসহ| শ্রবণ করুন তবে সে কাহিনী|
তখন আমি সম্রাট বিক্রমাদিত্যের সভায় নিতান্তই নুতন|একদিন তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন তার পুত্র চঞ্চলগুপ্তের ভাগ্য গণনা করবার জন্য| ভাগ্য গণনা করে আমি প্রমাদ গনলাম| রাজকুমারের আয়ুরেখা যে অতি হ্রস্ব|
তবু সত্য তো গোপন করা যায় না| আমি সম্রাট সমীপে অভিজ্ঞাপন করলাম যে রাজকুমার আগামী আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর রাতে এক বরাহের হাতে প্রাণ দেবে|
রাজা: আপনার কাহিনী শ্রবণ করেই যে আমার শিহরণ জাগছে| তার পর কি হল?
বরাহ পন্ডিত: সম্রাট আমার গণনা শ্রবণ করে পুত্রকে এক সপ্ততল প্রাসাদ এর সর্বোপরি প্রকোষ্ঠে বাস করবার জন্য পাঠালেন| সেই প্রাসাদে বসালেন নিশ্ছিদ্র প্রহরা| সেখানে শুধু কুমার আর তার কিছু বিশেষ সঙ্গী গণ ব্যতিরেকে আর কারো যাওয়ার উপায় ছিল না|
আশ্বিন মাসের সেই ভয়ংকর তিথি এসে গেল দেখতে দেখতে| আমার স্পষ্ট স্মরণ আছে যে সেদিন রাত্রি পর্যন্ত সমস্ত সভাসদ গণ সভায় উপস্থিত ছিলেন|রাত্রি প্রায় শেষ হওয়ার মুখে সম্রাট আমাকে বললেন হে পণ্ডিতবর এ যাত্রা বোধহয় আপনার গণনা মিথ্যা হল| আমি বললাম, সম্রাট এ অতি দুঃখের বিষয় তবে মিথ্যা স্তোকবাক্য দেবো না| গণনা আমার মিথ্যা হয় না| আপনি কুমারের প্রাসাদে খবর নিন|
(বরাহ পন্ডিত উঠে পায়চারী করেন)
রাজা: তারপর কি হল পণ্ডিতমশায়?
বরাহ পন্ডিত: তারপর আর কি| যা ভবিতব্য তাই হল|
রাজা: অর্থাৎ?
বরাহ পন্ডিত: অর্থাৎ বরাহের হাতে কুমারের মৃত্যু|
রাজা: কিন্তু সে কি ভাবে?
বরাহ পন্ডিত: কুমার তার শয্যায় নিদ্রিত ছিলেন| অকস্মাত সামান্য ভূমিকম্প হয় এবং অলিন্দের উপর থেকে ধাতব কুলচিহ্ন কুমার এর উপর পড়ে এবং তার ধারালো অংশ কুমার এর বক্ষ বিদীর্ণ করে|
রাজা: কিন্তু এতে বরাহ কি ভাবে ....
বরাহ পন্ডিত: যুক্ত, তাই তো? গুপ্ত রাজবংশের কুলদেবতা বিষ্ণু এবং কুলচিহ্ন তার তৃতীয় অবতারের প্রতিকৃতি... অর্থাৎ কুমার এর নিধন বরাহের হাতে|
(রাজা চক্রকেতুর বিস্ময়ে দুই চক্ষু বিস্ফারিত)
সেই থেকে আমাকে লোকে বরাহ পন্ডিত বলেই জানে|
রাজা: যদিও দুঃখজনক ঘটনা তবে অতীব রোমহর্ষক বটে| তা পন্ডিত মহাশয়ের পিতৃদত্ত নামটি কি জানতে পারি?
বরাহ পন্ডিত: অবশ্যই| আমার পিতৃদত্ত নাম মিহির|
রাজা: মিহির? সে কি? সে তো.....
বরাহ পন্ডিত: কি বিষয় মহারাজ? আমার পিতৃদত্ত নাম শুনে আপনার এইরূপ চমকের কারণ?
রাজা: না মানে এই রাজ্যে বর্তমানে এক জ্যোতিষী দম্পতি রয়েছেন – খনা এবং মিহির| তাই আর কি|
বরাহ পন্ডিত: (অট্টহাস্য) এই ব্যাপার মাত্র| মিহির নাম টি আমার পিতৃদত্ত, পিতৃ অধিকৃত নয়| থাকতেই পারে আর একজন মিহির|
রাজা: তা অবশ্যই, তা অবশ্যই...
বরাহ পন্ডিত: তবে এরা জ্যোতিষ শাস্ত্র বিদ শুনে জানতে আগ্রহ হচ্ছে এদের বিষয়ে| মহারাজ যদি কিছু আলোকপাত করেন এই বিষয়ে...
রাজা: অবশ্যই| খনা এবং মিহির সিংহল হতে আগত| খনা সিংহল রাজদুহিতা| মিহির এর ব্যাপারে আমি বিশদ অবগত নই| যতদুর জানি, সে সিংহলের রাজ জ্যোতিষীর পালিত পুত্র| সিংহল রাজ বিক্রম সিংহ শ্রী বিজয় সিংহের বংশধর – যিনি একদা এই বঙ্গ দেশ হতেই সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন| ইদানিং সিংহল উদ্ভূত রক্ষ জাতির প্রজা দের সহিত সিংহল রাজের অসদ্ভাব ঘটেছিল| সিংহলে রাষ্ট্র বিপ্লব এর সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় সিংহল রাজ আমার সাথে যোগাযোগ করেন এবং ওদের কে এখানে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন| আমি তাদের কে রাজ প্রাসাদেই থাকার ব্যবস্থা করে দেই কিন্তু তারা তাতে অসম্মত হন এবং প্রজা সাধারণের মাঝেই এক ক্ষুদ্র কুটীর নির্মান করে থাকবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন| ইদানিং শুনেছি প্রজা গণের মাঝে তারা তাদের জ্যোতির্বিদ্যার দরুন অতিশয় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন|
বরাহ মিহির: এত অতি অদ্ভুত যোগাযোগ| সিংহল রাজ দুহিতা এবং এক অজ্ঞাতকুলশীল যুবক| যাই হোক এদের জ্যোতিশ্চর্চা সম্বন্ধে জানার আগ্রহ রইলো|
রাজা: অবশ্যই অবশ্যই.. সে সুযোগ নিশ্চই হবে| তবে এবার আপনি বিশ্রাম গ্রহণ করুন|
(রাজার প্রণাম এবং গাত্রোত্থান)
============================== =============
ক্রমশ ......
রবিরশ্মি ঘোষ, অস্ট্রেলিয়া
ছবিঋণঃ ইন্টারনেটের সৌজন্যে
১লা সেপ্টেম্বর ২০১৯