বরাবরের মতোই পাহাড় আমাকে টানে তাই যখনই ভ্রমণের পরিকল্পনাটা মাথায় এলো প্রথম পছন্দ ছিলো মেঘের রাজ্য সাজেক ভ্যালি।
দিনক্ষণ ঠিক করতে করতে অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হলো। ফেনী থেকে সোজা খাগড়াছড়ির বাস শান্তি পরিবহন ধরতে কাকডাকা ভোরেই রওনা দিলাম লক্ষ্মীপুর থেকে।
বেশী তাড়াহুড়া করতে গিয়ে অনেকটা আগেই ফেনী বাস কাউন্টারে পৌঁছে গেলো আমাদের দশ জনের দল। সেখান থেকে সকালের নাস্তা সেরে একটু অপেক্ষা করতেই এসে গেলো আমাদের বাহন। বাসে উঠেই কানে হেডফোন দিয়ে চোখ বুজে গান শুনতে থাকলেও কিছুক্ষণ পরে বাইরের অপরুপ দৃশ্য এক পলক দেখে আর চোখ ফেরানো গেলো না।
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ী, কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু। এরই মধ্যে পৌঁছে গেলাম খাগড়াছড়ি, বাস থেকে নেমে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। তারপর সাজেক যাওয়ার জন্য আমাদের ঠিক করতে হলো পাহাড়ী রাস্তার অবলম্বন চান্দের গাড়ী।
অতপরঃ চান্দের গাড়িতে করে আমাদের মেঘের রাজ্যে যাত্রা শুরু, তবে প্রকৃতির স্বাদটা পুরোপুরি আস্বাদন করার জন্য আমরা দুজন গাড়ীর ছাদে ওঠে বসে ছিলাম। তবে গাড়ির ছাদে বসাটা বিপজ্জনক এবং সবসময় সতর্ক থাকতে হয়।
পাহাড়ের উঁচুনিচু সুন্দর ভয়ঙ্কর রাস্তা দিয়ে যেতে ভয় লাগলেও আশেপাশের মনোরম দৃশ্য সব ভুলিয়ে দিলো। প্রকৃতির এতো সুন্দর রূপ আগে কখনও দেখিনি।
মাঝে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে বিরতি দেওয়া হয় সেখান থেকে সেনাবাহিনীর ফোর্স আমাদের নিয়ে যাবে সাজেকে। কারন সাজেক দূর্গম পাহাড়ী এলাকা বিধায় সেখানে একা কোন দর্শনার্থীকে যেতে দেওয়া হয় না, সকাল ১০টা ও বিকাল ৩টা এই দুই সময় সাজেকে ঢুকতে হয়। তাই আপনাকে সাজেক যেতে হলে অবশ্যই সকাল ১০টার আগে অথবা বিকাল ৩টার আগে বাঘাইছড়ি সেনাবাহিনী ক্যাম্পে পৌঁছতে হবে।
আমরাও যাত্রাবিরতি পেয়ে রাস্তার পাশের দোকান থেকে পাহাড়ী পাকা কলা খেয়ে পেট পূজো করে নিই। বিরতি শেষে আবার যাত্রা শুরু আমাদের সাজেকের উদ্যেশ্যে। সাজেক ভ্যালিতে আসার পথটা অসাধারণ থেকে একটু বেশি। দুই পাশে সবুজ গাছ গাছালি। দূরে রয়েছে বড় বড় পাহাড়।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক আসার সারা পথে প্রচুর ছোট আধিবাসী ছেলে মেয়ে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে হাত নাড়তে থাকবে। হাত নাড়ার মানে হচ্ছে তাদেরকে চকলেট দেওয়া। বিষয়টা আমরা আগে থেকেই জানতাম তাই চকলেট কিনে নিয়ে ছিলাম। যারাই আমাদের দেখে হাত নাড়ল, আমরা তাদেরকেই চকলেট ছুঁড়ে মারলাম। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। গল্প করতে করতে আর প্রকৃতি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম মেঘের শহর সাজেকে।
সাজেক মূলত লুসাই আধিবাসীদের একটি গ্রাম যার নাম রুইলুই পাড়া। রাস্তার পাশে পাহাড়ের ঢালে লুসাই আদিবাসীদের বৈচিত্রময় জীবন যাত্রা দেখে বিস্মিত ও হতবাক হয়ে যাই। উঁচু মাচার ঘরে গাছের গুড়ি কেঁটে বানানো সিঁড়ি, ঘরের ছাউনী বাঁশের পাতার। ঘরের সামনে ফুলের বাগান, মাঝে মাঝেই ক্যাকটাস ও অর্কিড শোভা পাচ্ছে। অনেক পরিষ্কার এবং গোছানো একটি জায়গা।
সাজেক গিয়ে প্রথমেই থাকার জন্য হোটেল ঠিক করলাম পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত সুন্দর একটি হোটেল ঠিক করে ফেললাম দুদিনে জন্য। আমরা যখন গিয়েছি তখন সাজেকে তেমন ট্যুরিস্ট ছিলো না তাই কম রেটে রুম পেয়ে গেলাম। তারপর বেরিয়ে হালকা নাস্তা করতে করতে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো পাহাড়ের বুকে। সারাদিন গরম লাগলেও সন্ধ্যার পরপরই শীত ঝাঁকিয়ে বসলো। সন্ধ্যার পর সাজেকের সত্যিকারের সৌন্দর্য দেখা যায়। আকাশের তারা গুলো এত কাছে মনে হয়। এত পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়। গুণা শুরু করা যাবে, চারপাশ আলোকিত হয়ে গিয়েছে জোছনার আলোতে। রাতের খাবারে খেলাম রুটি আর এখানকার পাহাড়ী ব্যাম্বো চিকেন। আমার কাছে ব্যম্বো চিকেনের স্বাদটা ভালোই লেগেছে। বলে রাখা ভালো এখানে আপনি হোটেলে গিয়েই তৈরি করা খাবার পাবেন না, আপনাকে আগে থেকে অর্ডার করতে হবে তাহলে তারা বানিয়ে দিবে। পরদিন ভোরে আমরা সূর্যদয় দেখতে চলে গেলাম হেলিপ্যাডে, সেখানে গিয়ে অন্য রকম এক দৃশ্য। পুরো হেলিপ্যাডে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে গায়ে এসে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে নরম মেঘ। হেলিপ্যাড দেখা শেষ করে হোটেলে এসে নাস্তা সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমাদের যাত্রা কংলাক ঝর্ণার উদ্দেশ্যে, ঝর্ণাটিতে যাওয়ার রাস্তা অত্যন্ত দূর্গম হওয়ায় আমরা একজন গাইড নিলাম। ঝর্ণাটির রাস্তা অনেক দূর্গম হলেও ঝর্নাটি সত্যই অনেক সুন্দর ছিলো। তবে আসার সময় অনেক কস্ট হয়েছিলো কারন আমাদের সাথে ছোট একটি বাচ্চা ছিলো। তবে আমাদের গাইড সুখিল খুব সহযোগিতা করেছে। সে কোন ক্লান্তি ছাড়াই বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে পুরো পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাদের অবস্থা অবশ্য কাহিল হয়ে গিয়েছিলো। রুমে ফিরে মেঘ দেখতে বের হলাম। আমাদের চারিপাশে শুভ্র মেঘ, আমাদের থেকে নিচে ভেলার মত মেঘ। ভাগ্য ভালো বলতে হবে। কারণ আমরা বর্ষায় গিয়েছি। শীতে এতো মেঘের দেখা পাওয়া যায় না। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুমিয়ে বিকালে আমরা চলে গেলাম কংলাক পাহাড়ে। সাজেকের মূল পয়েন্ট থেকে আরো উপরে কংলাক পাহাড়, এখানেও আধিবাসীদের ছোট একটি গ্রাম আছে যার নাম কংলাক পাড়া। কংলাক যাওয়ার পথে অনেক কমলা বাগান পড়ে। ঐখান থেকে চারপাশ অনেক সুন্দর ভাবে দেখা যায়, তবে এখানে আধিবাসীদের ছবি তোলার ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হবে এবং তাদের বিরক্তি হয় এমন কোন কাজ না করাই বাঞ্চনীয়। কংলাক থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিলো। সন্ধ্যায় নাস্তা করলাম পাহাড়ী বাঁশের কচি অংশের বড়া যাকে বলে বাঁশের কোড়ল। নাস্তার পর্ব শেষ হলো ব্যাম্বো চা দিয়ে, এটি মূলত বাঁশের ভিতর চা পরিবেশন করা হয়। পরদিন আমরা ফিরে এলাম খাগড়াছড়ি শহরে। একটা হোটেলে রুম নিয়ে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে আমরা চলে গেলাম বৌদ্ধ মন্দির, ঝুলন্ত ব্রীজ, আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে। আলুটিলা ছিলো রহস্যময় গুহা। গুহার এক পাশ দিয়ে ঢুকে হয়ে অন্য পাশ দিয়ে বের হওয়া যায়। গুহার ভেতর দিয়ে অল্প অল্প করে পানি প্রবাহিত হয়। গুহার ভেতর মশাল নিয়ে আমরা সবাই ঢুকেছি। তারপর হোটেলে ফেরার সময় শহরের তাঁত মেলা থেকে ঘুরে এলাম সবাই। রাতেই আমরা খাগড়াছড়ি থেকে ফেনীর অগ্রিম টিকেট কিনে নিলাম। পরদিন ভোরেই বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়িতে চেপে বসলাম।
পলাশ সাহা, বাংলাদেশ
ছবিঃ সৌজন্যে লেখক
১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৯