Type Here to Get Search Results !

মুক্তির স্বাদ" ......বাংলাদেশ থেকে রীতা আক্তার এর ছোট গল্প

রাত নেমে এসেছে মুনাদের জীর্ণ ঘরটিতে। দুই কামরার ঘর মুনাদের। একটিতে বাবা, মা থাকে অন্যটিতে মুনা ও তার দশ বছরের ছোট বোন। মফস্বল শহরে ভাড়া বাড়িতেই মুনাদের বাস। মুনার বাবা শফিক সাহেব ছিলেন তৃতীয় শ্রেণীর সরকারী কর্মচারী। দুই মেয়ে, স্ত্রী নিয়ে চলে যাচ্ছিলো তার সংসার। সংসারে সাচ্ছন্দ্য ছিলোনা ঠিকই তবু কারো মুখে দুখের ছাপ ছিলো না। সময়ের সাথে সকল অভাব অনটন মেনে নিয়ে চলতো সকলে। মুনা তখন ইন্টারমিডিয়েটের ফাইনাল পরীক্ষা দিবে। আর মাত্র তিন মাস বাকি ফাইনাল পরীক্ষার। প্রায় বিকেল হয়ে এসেছিলো সেদিন,মুনা কলেজ থেকে ফিরছে বাড়ি মেইন দরজার কাছে আসতেই দেখলো বাড়িতে পাড়া প্রতিবেশীদের ভিড়। মুনা দৌড়ে গেলো বাড়ির ভিতর।মা, বোন কেঁদে চলেছে, রক্তে ভিজে গেছে বিছানার চাদর, খাটের উপর শুয়ে আছে তার আহত বাবা।আজ অফিস থেকে বাড়ী ফিরবার পথে এসিডেন্ট করে তার বাবা।বাম পায়ের উপর দিয়ে চলে গিয়েছিলো চলন্ত মোটর সাইকেল। একসিডেন্টের পর শফিক সাহেব পঙ্গু হয়ে গেলেন। অপারেশন করে বাম পায়ের হাঁটু অবধি কেটে ফেলে দিতে হয়েছিলো। বাবার একসিডেন্টের পর মুনার হতে হয় কঠিন এক বাস্তবের মুখমুখি।এমনিই অভাবের সংসার টাকা পয়সার টানাটানি। বোনের পড়াশুনা, বাবার ঔষধপত্র, ঘর ভাড়া, সংসার খরচ, নিজের পড়লেখা চালাতে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছিলো মুনা। এইচ এস সি তে ভালো রেজাল্ট করেও অনার্সে ভর্তি হতে পারলো না শুধু মাত্র টাকার অভাবে। সংসারের হাল ধরতে মুনা চাকরি নিলো একটি শপিং মলে সেলস্ গার্ল হিসেবে। প্রতিদিন  সকাল দশটা থেকে  দুপুর দুটো অবধি ওখানে কাজ শেষে মুনা কিছু টিউশনি করা শুরু করে। মাস শেষে যা টাকা পায় তা থেকে নিজের হাত খরচা রেখে বাকি টাকাটা তুলে দেয় মায়ের হাতে। এভাবেই চলে যাচ্ছিলো সময়। একদিন পাশের বাড়ীর রুনার মা একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে মুনার জন্য। ছেলে পক্ষের কোন চাওয়া পাওয়া নাই। তারা চায় তাদের একমাত্র ছেলের একটা বৌ। প্রথমে মুনা রাজি হলো না বিয়ে জন্য। বাবা মায়ের অনুরোধে সে এক প্রকার বাধ্য হয়ে যায় বিয়ের জন্য।

 
পাঁচ ননদের এক মাত্র ভাবী মুনা। বড় দুই ননদের বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি তিন ননদ পড়ালেখা করে। শশুর শাশুড়ী রয়েছেন মুনার। বেশ রক্ষণশীল পরিবার মুনার শশুর বাড়ি। একমাত্র ছেলের বৌয়ের কাছে তাদের চাওয়া পাওয়া অনেক। মুনার স্বামী বাবা মায়ের ভীষন ভক্ত। সংসারে বাবা মার কথার উপর সে বা বোনেরা কোন কথা বলার সাহস রাখে না। 

দিন যত যেতে লাগলো মুনাও চিনতে লাগলো তার শশুর বাড়ির মানুষদের।কথায় কথায় বাপের বাড়ি নিয়ে খোটা শুনতে হতো তাকে। গরিব ঘরের মেয়ে বলে তার কোন সম্মান নেই এই বাড়িতে।মুনা বিয়ে হয়ে আসার পরই বিদায় করে দেয়া হয় কাজের লোকদের। মুনাকে যেনো তাদের পুত্র বধূ নয়, বরং একটা কাজের বুয়া হিসেবে এনেছে বাড়িতে।শাশুড়ীর মুখ ঝামটা খেতে হয় রোজ, কাজের সামান্য ভুল ত্রুটির জন্য।স্বামিকেও বলতে পারেনা তার খারাপ লাগার কথা গুলো। মুখ বুজে সহ্য করে যায় মুনা।   মুনার উপর তারা এতোটাই মানুষিক ও শারীরিক নির্যতন করতো যে মুনার মনে হতো আজকের রাতটাই বুঝি তার জীবনের শেষ রাত।একেক সময় ভেবেছিলো ডিভোর্স দিয়ে চলে আসবে কিন্তু পারেনি। বাবার অভাবের সংসার, ছোট বোনটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে পড়ে রয় এখানে। প্রতিটি রাত মুনা কেঁদে বুক ভাসায়। শহরের সবাই যখন গভীর ঘুমে অচেতন, মুনা তখন পাশে শুয়ে থাকা স্বামিকে ছেড়ে চলে আসে খোলা জানালার পাশে। দাঁড়িয়ে থাকে একলা। দূর আকাশে আধ ভাঙা চাঁদ মুনার মলিন মুখটাকে করে আরো মায়াময়। এই রাতই কেবল মুনার মনের ভাষা বুঝে নেয় অবলিলায়। 

তিন বছর পর...

সেদিন ছিলো শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি ঝরছিলো। মুনা শুয়ে ছিলো হসপিটালের বেডে। কিছুক্ষণ পর তাকে নিয়ে যাওয়া অপারেশন থিয়েটারে। প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পাবে সে। তার কোল জুড়ে আসবে সন্তান। মুনা কেঁদে চলেছে অনাগত ভবিষ্যত নিয়ে। সে জানেনা আজ সে বাঁচবে না মরবে? তার ছেলে সন্তান হবে নাকি মেয়ে?  

মুনার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন তার চোখের সামনে দেখতে পেলো শশুর বাড়ির সকলকে। মুনার দিকে তাদের ফিরে তাকানোর অবকাশ নেই। মুনার মেয়েকে নিয়ে আদরে ব্যস্ত সবাই।কেউ জানতে চাইলো না কোথায় কষ্ট হচ্ছে তার?  খিদে পেলো কিনা?

ভোর তখন পাঁচটা, মেয়ের জন্য দুধ বানিয়ে, মেয়েকে খাইয়ে চলে গেলো রান্না ঘরে রান্না করতে। সকলের জন্য নাস্তা বানানো শেষে রাতের এঁটো থালা বাসন ধুঁয়ে নিচ্ছিলো এমন সময় মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলো। হাতটা ধুয়ে যখন যাবে মেয়ের কাছে এমন সময় শাশুড়ি এলেন রান্না ঘরে। মুনাকে মেয়ের কাছে যেতে দেখে বললেন - কোথায় দৌড় দিচ্ছো শুনি, বলি বাচ্চাকাচ্চা কি আর আমি মানুষ করিনি বাপু, যে একটু কাঁদছে শুনেই ছুটে যেতে হবে?

কাঁদতে দাও, কান্না করলে গলার আওয়াজ পরিস্কার হয়, নাও দেখি তাড়াতাড়ি বাসন গুলো ধুয়ে টেবিলে সবার জন্য নাস্তা দাও, তোমার শশুর আবার যাবে একটু বাইরে কাজ আছে। নাও তাড়াতাড়ি করো।

মুনা শাশুড়ির মুখের উপর কোন কথা বলতে পারলো না, কারণ সে জানে মুখের উপর কথা বললে সইতে হবে নির্যাতন। আর তার জন্য হারাতে হবে সারাদিনের মেয়ের  গচ্ছিত দুধটুকু।এক ফোটা দুধ মুখে উঠবে না আজ, তাই নিরবে মেনে নিয়ে সংসারের সবার মন জুগিয়ে চলে মুনা। ওদিকে মেয়ে তার কেঁদেই চলেছে। বুকে পাথর দিয়ে সহ্য করে যায় মুনা। কিন্তু এটাই কি জীবন?  এভাবে বাঁচার চেয়ে তো মরে যাওয়া ঢের ভালো।

 ২৫ বছর পর...

মুনার মেয়ে টুম্পা আজ একজন উকিল। মুনা নিজে যা পারিনি তা সে তার মেয়েকে দিয়ে পূরণ করতে পেরেছে।যদিও এই দিনটি দেখার জন্য তাকে পোহাতে হয়েছে নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা অপমান নির্যাতন। সব মুখবুজে সহ্য করে গেছে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।টুম্পা মুনার ঠিক বিপরীত চরিত্র। অন্যায়কে মেনে নেয়নি কখনও। ভীষণ জেদি আর সাহসী মেয়ে টুম্পা।

রাত তখন নয়টা বিশ। টুম্পা তার কাজ শেষে ফিরলো বাড়ি। বাড়িতে পা রাখতেই দেখলো খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। আজ বাবার প্রিয় ইলিশ মাছের তরকারীতে একটু ঝাল বেশি হওয়াতে ভাতের প্লেট ছুঁড়ে মারলো মায়ের মুখের উপর সেই সাথে চলল অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। চোখের সামনে মায়ের এমন অপমান সে আর মেনে নিতে পারলো না। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে মায়ের এমন অপমান। আর নয়। আজ সে সাবলম্বি একটা মেয়ে। তার মায়ের ভরন পোষনের ক্ষমতা রাখে সে।মায়ের এমন অপমান দেখে টুম্পা তার বাবাকে কিছু বলল না। 

রাত তখন একটা। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেছে। টুম্পা এগিয়ে গেলো তার মায়ের ঘরের দিকে।বাবা নাক ডেকে ঘুমচ্ছে আর মা জানালার পাশে বসে নিরবে চোখের জল ঝরাচ্ছে। মায়ের কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠলো।টুম্পাকে এই সময় এখানে দেখতে পেয়ে বিষ্মিতও হলো মুনা।টুম্পা তার মাকে নিয়ে গেলো তার ঘরে। আগে থেকে ব্যাগে কাপড় চোপড় প্রয়োজনিয় জিনিস গুছিয়েই রেখেছিলো সে। মাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো সে। আগে থেকে টুম্পার বন্ধু রাসেলকে দিয়ে একটা ভাড়া ঘরের ব্যবস্হাও করে রেখেছিলো সে।

মুনা প্রথমে যেতে চাইনি সংসার ছেড়ে তবুও মেয়ের জেদের কাছে হার মানতে হলো তাকে।টুম্পা শুধু যাওয়ার আগে তার বাবার ঘরে একটা চিঠি লিখে গেলো।এতো দিনের মায়ের উপর চালানো সব লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিলো সে।

ঘরের চৌকাঠ  পেরিয়ে যখন মেয়ের হাতটি ধরে বেরিয়ে এলো, আকাশে তখন জেগেছিলো পূর্ণিমার চাঁদ।পিছন ফিরে একবার শেষ বারের মতো তাকালো মুনা। পিছনের সব নষ্ট স্মৃতির কবর দিয়ে এক পরম তৃপ্তির স্বাদ পেলো সে।এটাই বুঝি মুক্তির আনন্দ। আজ প্রথমবার মুনা বুক ভরে নিশ্বাঃস নিলো। হাত মেলে মেখে নিলো জোছনার স্নিগ্ধ আলো।মেয়ের হাত ধরে এগিয়ে চললো, চাঁদটা যেনো পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো তাদের। মুনার কন্ঠে বেজে উঠলো রবিঠাকুরের গান -

দূরে কোথায় দূরে দূরে,

আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে.....।

***********************************************
রীতা আক্তার 
রামপুরা, ঢাকা,বাংলাদেশ

ছবিঃ ইন্টারনেটের সৌজন্যে
২রা অক্টোবর ২০১৯


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.