নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িটা ঢোকার পরপরই নীলরঙের আরেকটা গাড়ি এসে কারা ফটকে থামলো। সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে নামলো ক’জন ডাক্তার; শাদা অ্যাপ্রোন পরা। দুজন ডোম, একজন মৌলবী আগেই হাজির ছিল। বাকি সব প্রস্তুতিও ইতোমধ্যে সম্পন্ন করে রেখেছে কারা কর্তৃপক্ষ। এখন শুধু নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষা...
দীর্ঘকায় শরীরটা ধনুকের মতো বাঁকিয়ে এবং হাঁটুর উপর ছড়ানো হাত দুটিতে মাথা ঠেকিয়ে নিরিবিলি কনডেম সেলে বসে আছে জমিরুদ্দিন সিদ্দিকী ওরুফে জমিরুল। মাথার ওপর ক্ষেপাটে ষাঁড়ের মতো গরগর করছে বৈদ্যুতিক পাখা। সেদিকে খেয়াল পড়েনি তার। কিছুক্ষণ আগে একটা টিকটিকির অহেতুক টুকটুক শব্দ পেয়ে একবার মাথা তুলেছিলো, তারপর আবার আগের মতো বসে রইলো নিঃশব্দে; তীব্র আলোর মধ্যেও তার চেহারা দেখার উপায় নাই।
মাস চারেক আগে কারা কর্তৃপক্ষ তার সেল-কক্ষ আলাদা করে দেয়। এ স্থানান্তর নির্জন কারাবাসের মতো সাময়িককালের জন্যে নয়। সেদিনের পর স্থায়ীভাবেই আলাদা সেলের বাসিন্দা হয়ে পড়ে জমিরুল।
দুই.
লম্বা একটা ছায়া ধীরে ধীরে জমিরুলের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। লাইটের তরল আলোয় ছায়াটা আস্তে আস্তে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো; এক সময় জমিরুলের শরীরের ওপর ছড়িয়ে পড়লো। টের পায়নি সে। হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে মাথা তোলেন জেল সুপার! সঙ্গে আরো দুজন পুলিশ কর্মকর্তা। লাল কাপড়ে মোড়ানো একটা বস্তু হাত বদল করতে করতে সুপার সাহেব বলেন :
মিস্টার জমির, আপনি নিশ্চয়ই সবকিছু শুনেছেন। এ সময় মন-মানসিকতা ভালো থাকার কথা নয়। আশা করি পরোয়ানা পড়ে শোনানোর দরকার হবে না।
এই প্রথম জেল সুপার লোকটাকে কারো সাথে কোমল ভাষায় কথা বলতে দেখলো জমিরুল। এখানে আসার পর এই লোকটাকে সবসময়ই ভার-ভারিক্কি ভাব নিয়ে এতদিন চলতে দেখেছে সে।
মিথ্যেরা মাঝেমধ্যে সত্যকে চেপে ধরে রাখতে পারলেও আদালতের রায় তো আর চেপে ধরে রাখতে পারবে না স্যার। আমি জানলেই কী আর না জানলেই বা কী। আমার চেয়ে আপনাদের জানাটাই বেশি জরুরি।
আমি আপনার শেষ ইচ্ছা জানতে এসেছি। বলুন আপনার শেষ ইচ্ছা কী? আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করবো পূরণ করতে।
কেন, একজন অপরাধীর শেষ ইচ্ছা জানার এবং পূরণ করার কী এমন প্রয়োজন ঠেকলো হঠাৎ? পরাধীন জাতির তো অধিকার থাকতে নেই।
এটা নিয়ম। তাছাড়া আপনি শুধু অপরাধীই নন, একজন মানুষও বটে।
কতো নিয়মই তো ভঙ্গ হয় রোজ রোজ। এই একটা নিয়ম ভঙ্গ হলেই বা কী আসে যায়। তাছাড়া আমি যে একজন মানুষ এটা তো আপনাদের সরকারি কাগজের কোথাও লেখা নাই। সবখানেই তো কয়েদি আর আসামি শব্দ ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়েনি।
মিস্টার জমির, একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেও এই কারাগারে আপনার চলাচলতি, ব্যক্তিত্ববোধ ও কথাবার্তার প্রশংসা অনেকের মুখেই শোনা যায়। তাই আপাতত তর্কে জড়াতে চাই না।
দেশময় আমার দুর্নাম ছড়ানো, তাই তর্কে যে যেতেই হবে, স্যার!
দেখুন জমির সাহেব, ওপাশে অপেক্ষমাণ সবাই। একটু পরেই আপনাকে ওজু-নামাজ, তওবা ইস্তেগফার করানো হবে। হাতে সময় বেশি নাই। পৃথিবী ও মানুষের সাথে আজই আপনার শেষ সাক্ষাৎ, শেষ কথা! মনে অনেক রাগ-ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক কিন্তু আদালতের রায়ের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। দায়রা আদালতের রায় ঘোষণার সাতদিনের মধ্যে উচ্চাদালতে আপিলের সুযোগ ছিলো; সেটা গ্রহণ করলেও একটা পথ খোলা থাকতো; গোয়ার্তুমি করে আপনি সে সুযোগটাও গ্রহণ করেন নাই, স্বেচ্ছায়। সেটা আপনার ব্যাপার। ডেথ রেপারেন্স হাইকোর্ট ঘুরে আসার পর আমাদের আর কী করার থাকে বলুন। এই মুহূর্তে তর্কে জড়াবেন না প্লিজ, অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে। সেগুলো সারতে হবে। আপনার আর আমার জন্য তো কেউ বসে থাকবে না। আপনার চাহিদা থাকলে সেটা মেটানোর জন্যেও তো যথেষ্ট সময়ের দরকার হবে। শেষ ইচ্ছেটা থাকলে বলে ফেলুন প্লিজ।
আমি যদি বলি আমার শেষ ইচ্ছা হলো নিঃশর্ত মুক্তি। সেটা কি পূরণ করতে পারবেন?
-সেটা কীভাবে সম্ভব!
-তাহলে শেষ ইচ্ছা পূরণের নামে তামাশা করার কী দরকার।
-শুনুন, আমি এখানে জেরা করতে আসিনি। আপনার শেষ ইচ্ছা থাকলে বলুন, সম্ভব হলে পূরণের যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। না থাকলেও বলুন, চলে যাবো।
-আমার শেষ ইচ্ছা অবশ্যই আছে স্যার। কিন্তু সেটা পূরণের সদিচ্ছা আপনার আছে কিনা এটাই তো ভাবনার বিষয়।
-স্বাভাবিক ও আইন সঙ্গত ইচ্ছা হলে যতো কষ্টই হোক আমি পূরণ করার চেষ্টা করবো।
-আমার শেষ ইচ্ছা তিনটি। খুবই সাধারণ। পূরণ করতেও বেগ পোহাতে হবে না। আইনের খেলাপ ঘটবে না। অভয় দিলে এবং আশ্বস্ত করলে এখনই খুলে বলবো।
-আপনার সাথে কথা বলে ভালো লেগেছে। আগেও দুজন অফিসার এবং কজন কয়েদির মুখে আপনার সাহস ও কথা বলার স্পষ্টতা সম্পর্কে প্রশসংনীয় বক্তব্য শুনেছি। তাই কথা দিলাম, আপনার ইচ্ছে পূরণের আপ্রাণ চেষ্টা আমি করবো। বলুন আপনার অন্তিম বাসনা তিনটে কী কী?
-আমার প্রথম ইচ্ছা হলো, আমি আপনার কপালে তিনটে চুমো খাবো। বিষয়টা সিরিয়াসলি বলছি। ঠাট্টা নয়। এটা পূর্ণ হলেই দ্বিতীয়টা বলবো।
স্তব্ধ হয়ে গেলো কারা সুপার। দুই পাশে দাঁড়ানো পুলিশ কর্মকর্তারাও অবাক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখের ভাষায়, আকারে ইঙ্গিতে বিস্ময়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো, এ কেমন আচানক ইচ্ছে রে বাপু।
প্রথমদিকে সুপারের মেজাজ বিগড়ে গেলো। অনেক কষ্টে জেদ সংবরণ করলেন। একজন মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ ইচ্ছা বলে কথা। কিছুটা ছাড় তো দেওয়াই উচিত। তাছাড়া কথা বলতে বলতে এতক্ষণে লোকটাকেও তার ভালো লেগে যায়, দারুণ স্মার্টও সে। পুরুষ হয়ে পুরুষকে চুমো খেলে কিইবা আসে যায়। বিষয়টা অত্যন্ত কৌতূহলী তো বটেই।
-ঠিক আছে। আপনি চাইলে এখনই আমার কপালে চুমো খেতে পারেন।
জমিরুল দৃঢ়পায়ে এবং নিঃসংকোচে এগিয়ে গেলো; তার নিরুত্তাপ হাত দুটি জেল সুপারের মাথার দুই প্রান্তসীমা স্পর্শ করলো। রীতিমতো বিব্রত হলেন তিনি। স্বাভাবিক থাকার ভান করলেন। একজন আদর্শ পিতা যেমনিভাবে স্নেহ তার সন্তানকে চুমো খায়, অবিকল তেমনিভাবেই জমিরুল সযতনে তিন-তিনটে চুমো সুপারের কপালে বসিয়ে দিলো! বিষয়টা আশ্চর্যজনক ঠেকলেও অজানা এক অদ্ভূত আবেশে সুপারের শরীরটা কেমন শিউরে ওঠলো হঠাৎ!
-বলুন আপনার দ্বিতীয় ইচ্ছাটা কী?
-ওজু, নামাজ, তওবা ইস্তেগফার কিংবা অন্য যে কোনো আচার-আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই আমি অন্তিম মঞ্চে দাঁড়াতে চাই। পৃথিবীতে আমি এক আজন্ম পাপী, অপরাধী এবং দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি! তাই আমার মৃত্যুটাও পাপযুক্তই থেকে যাক, আরো কিছু অপরাধ কাঁধে নিয়েই আমি কবর প্রদেশে ঢুকতে চাই। পৃথিবীর কাছে, আইনের কাছে, সময়ের কাছে আমি যেহেতু অপবিত্র মানুষ। ফলে মৃত্যুর পর আমার এই অপবিত্র শরীরটা যেন গোসল জানাযা ছাড়াই মাটিতে পুঁতে রাখা হয়, আমি পবিত্র হতে চাই না স্যার! পরাধীন ব্যক্তির ঈশ্বরও যে পরাধীন!
-কী সব আজব কথাবার্তা বলছেন! আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? সামাজিক নিয়মনীতি, ধর্মাচার, সরকারি বিধিবিধানের বাইরে গিয়ে আমি কীভাবে করবো এসব?
-কত নিয়ম, কত বিধিবিধানই তো প্রতিনিয়ত ভাঙ্গে-গড়ে মানুষ- লোক দেখানো কিংবা নিয়মরক্ষার এই ক্ষুদ্রতর বিষয়াশয়গুলো তোয়াক্কা না করলেই বা কী আসে যায়। তাছাড়া বিষয়টা আমি আর আপনি ছাড়া অন্য কেউ তো জানছে না, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? এটা পূরণের আশ্বাস পেলেই তৃতীয়টা বলবো স্যার।
-ঠিক আছে। আপনার কথাই থাকলো। আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। এবার তাহলে সর্বশেষ ইচ্ছটাও বলে ফেলুন। হাতে সময় একদম কম। এক্ষুনি যেতে হবে আমাকে।
-আমার তৃতীয়তম এবং সর্বশেষ ইচ্ছা হলো, ফাঁসির মঞ্চে আমাকে দাঁড়া করানোর সময় আপনি কাছে থাকবেন এবং কালো মুখোশ পরানোর আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন, নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন আমাকে; মৃত্যুর পর ম্যানিলা রোপ থেকে আমার লাশ নামিয়ে ফেলার পর ময়নাতদন্ত শুরুর আগে কালো মুখোশটা আপনিই খুলবেন, তারপর আরেকবার চোখের দিকে তাকাবেন। গভীরভাবে চোখ দুটোকে দেখার চেষ্টা করবেন। আপনি নিশ্চিত থাকুন, মৃত্যুর পরও আমার চোখ খোলা থাকবে। তাই ভালো করে আমার চোখ দুটির দিকে কিছুকাল তাকিয়ে থেকে আপনি নিজ হাতে সেগুলো বন্ধ করে দিয়ে যাবে, এটাই শেষ ইচ্ছা! এর বাইরে আমার আর কোনো ইচ্ছা নেই স্যার।
-এতটা কঠিন শর্ত কেন দিচ্ছেন ভাই? মঞ্চের কাছেধারে প্রবেশাধিকার আমাকে দেবে কিনা সেটাও তো জানি না।
-আপনি চাইলে, দরকার হয় আমি লিখিতভাবে এসব ইচ্ছার কথা জানাবো। ‘শেষ ইচ্ছা’রক্ষার্থে তখন হয়তো কেউ বাধা দেবে না। আশা করি অনুমতি পেয়ে যাবো।
-ঠিক আছে। প্রস্তাবটা মেনে নেয়ার শতভাগ চেষ্টা রাখবো। আপনি রেডি হোন। বাই।
তিন. বারোটা বাজার দুই মিনিট বাকি থাকতে জমিরুলকে মঞ্চে তোলা হলো। জেল সুপার, ম্যাজিস্ট্রেট এবং দুজন জল্লাদ দাঁড়িয়ে আছে নিচে। নজর ঘড়ির কাঁটার দিকে। জমিরুল পলকহীন তাকিয়ে আছে জেল সুপারের দিকে। তিনিও তাকিয়ে আছেন জমিরুলের চোখের দিকে। কী নির্ভার, সংকোচহীন, চিন্তাহীন, নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে জমিরুল। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠছে তার চোখমুখ। চেহারায় নেই সামান্যতম মলিনতার ছাপ। জমিরুলের চোখেমুখে দারুণ একটা মায়া জড়ানো এবং সমস্ত দেহেজুড়ে কাঠিন্যের তীব্রতর শ্লেষ ছড়ানো। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে এতটা সংশয়হীন দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই অবিশ্বাস্য। মৃত্যুকেও এতটা উপভোগ করতে পারে কেউ! বারোটা বেজে গেলো। কালো কাপড় হাতে উদ্যত হয়ে ওঠলো জল্লাদÑ এমনতর জান্তব মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েও মৃদু-ভর্ৎসনার একটা হাসি ছড়িয়ে দিলো সে। অচিরেই কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হলো মুখ, গলায় বাঁধা হলো ধারালো রশি! মিনিটখানেক পার না হতেই নির্দেশ মোতাবেক ঝুলিয়ে দেয়া হলো ফাঁসিতে। প্রথম ধাক্কাতেই একটু নড়েচড়ে ওঠলো তার শরীর। তারপর আর সাড়াশব্দ নেই! দীর্ঘক্ষণ ঝুলন্ত দেহটা একটু নড়াচড়াও করলো না! রশিতে একটা জীবন্ত মানুষ ঝোলানো হয়েছে নাকি একটা ময়দার বস্তা ঝোলানো হয়েছে, সেটা আন্দাজ করাও কঠিন হয়ে পড়লো। মৃত্যুর শেষপ্রান্তে চলে যাওয়ার পরও জমিরুলকে এতটুকু ছটফট করতে দেখেনি কেউ। দীর্ঘসময় ঝুলিয়ে রাখার পর নামিয়ে ফেলা হলো লাশ। চার. ডোম সদস্যরা দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে গেলো। সঙ্গে জেল সুপারও। কথা রাখতে, তিনিই প্রথম লাশের মুখ থেকে কালো কাপড়টা সরালেন এবং বিস্মিত হলেন- সত্যিই তো! মৃত্যুর পরও জমিরুল জীবিত মানুষের মতো কেমন ড্যাপ ড্যাপ করে তাকিয়ে আছে! তার দেহের প্রাণ উড়ে গেলেও চোখের প্রাণ তো ঠিকই রয়ে গেছে! ধারালো ম্যানিলা রশির প্রহারে গলায় দীর্ঘ কালচে একটা ক্ষতচিহ্ন পড়ছে শুধু। চেহারাটাও একটু লালচে হয়ে ফুলে গেছে। কিন্তু চোখের পাতা দুটো খোলা! মুখে ছড়ানো সে হাসি! সদ্যমৃত জমিরুলের এই মৃদু হাসিতে যেন লুকিয়ে আছে মোলায়েম কোনো বিদ্রূপ। সুপার সাহেব চোখ দুটির দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলেন এবং কৃত্রিম আলোয় বিস্ময়কর একটা দৃশ্য দেখে থমকে গেলেন! বিস্ফারিত দৃষ্টি ফেলে তিনি দেখলেন, জমিরুলের চোখের মণিঘেরা সাদা অংশজুড়ে সবুজ রঙের হালকা একটা আবরণ ছড়ানো এবং চোখের কনীনিকাজুড়ে হালকা কতেক লালবর্ণ মেশানো, দুটোর সংমিশ্রণ অনেকটা পতাকার মতো ঠেকছে! দৃশ্যটা তাকে স্তম্ভিত করে দিলো। সুপারের ভেতরটা করুণ একটা হাহাকারে নাড়া খেয়ে ওঠলো; বেখায়ালেই খেদোক্তি ঝাড়লেন তিনি,‘লোকটা কী সত্যিসত্যিই অপরাধী ছিলো!’ জমিরুলের কথা তিনি ফেলতে পারলেন না। নিজের অজান্তেই তার হাত দুটো জমিরুলের চোখের দিকে এগিয়ে গেলো। সুপারের কম্পমান হাতের পরশ পেয়ে নির্বিকার চোখ দুটি মুদে এলো, একমুহূর্তে হাসিটিও নিঃশেষ হয়ে গেলো। তীব্র মলিনতায় ঢেকে গেলো তার মুখ। ময়নাদন্তের অপেক্ষায় পড়ে রইলো নিথর দেহ। সুপারের দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়লো। বের হয়ে গেলেন তিনি। রাষ্ট্রীয় নিয়ম মানতে ব্যস্ত হয়ে ওঠলো ডোম সদস্যরা। জমিরুলের ঘাড় এবং হাত-পায়ের রগ কাটতে যখন টুংটাং করে ওঠলো ছুরিসমেত যন্ত্রাপাতির শব্দঝঙ্কার, ঠিক অই মুহূর্তে পাশের রুম থেকে অদ্ভুত একটা শব্দমিশ্রিত আওয়াজ বেরিয়ে এলো, কান্নার শব্দ! নিকটতম কোনো স্বজনের মৃত্যু না হলে এতটা বিলাপ-আর্তকণ্ঠে কেঁদে ওঠার মানুষ আজকাল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!
রফিকুজ্জামান রণি, বাংলাদেশ
ছবিঃ ইন্টারনেটের সৌজন্যে
২রা অক্টোবর ২০১৯
তিন. বারোটা বাজার দুই মিনিট বাকি থাকতে জমিরুলকে মঞ্চে তোলা হলো। জেল সুপার, ম্যাজিস্ট্রেট এবং দুজন জল্লাদ দাঁড়িয়ে আছে নিচে। নজর ঘড়ির কাঁটার দিকে। জমিরুল পলকহীন তাকিয়ে আছে জেল সুপারের দিকে। তিনিও তাকিয়ে আছেন জমিরুলের চোখের দিকে। কী নির্ভার, সংকোচহীন, চিন্তাহীন, নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে জমিরুল। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠছে তার চোখমুখ। চেহারায় নেই সামান্যতম মলিনতার ছাপ। জমিরুলের চোখেমুখে দারুণ একটা মায়া জড়ানো এবং সমস্ত দেহেজুড়ে কাঠিন্যের তীব্রতর শ্লেষ ছড়ানো। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে এতটা সংশয়হীন দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই অবিশ্বাস্য। মৃত্যুকেও এতটা উপভোগ করতে পারে কেউ! বারোটা বেজে গেলো। কালো কাপড় হাতে উদ্যত হয়ে ওঠলো জল্লাদÑ এমনতর জান্তব মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েও মৃদু-ভর্ৎসনার একটা হাসি ছড়িয়ে দিলো সে। অচিরেই কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হলো মুখ, গলায় বাঁধা হলো ধারালো রশি! মিনিটখানেক পার না হতেই নির্দেশ মোতাবেক ঝুলিয়ে দেয়া হলো ফাঁসিতে। প্রথম ধাক্কাতেই একটু নড়েচড়ে ওঠলো তার শরীর। তারপর আর সাড়াশব্দ নেই! দীর্ঘক্ষণ ঝুলন্ত দেহটা একটু নড়াচড়াও করলো না! রশিতে একটা জীবন্ত মানুষ ঝোলানো হয়েছে নাকি একটা ময়দার বস্তা ঝোলানো হয়েছে, সেটা আন্দাজ করাও কঠিন হয়ে পড়লো। মৃত্যুর শেষপ্রান্তে চলে যাওয়ার পরও জমিরুলকে এতটুকু ছটফট করতে দেখেনি কেউ। দীর্ঘসময় ঝুলিয়ে রাখার পর নামিয়ে ফেলা হলো লাশ। চার. ডোম সদস্যরা দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে গেলো। সঙ্গে জেল সুপারও। কথা রাখতে, তিনিই প্রথম লাশের মুখ থেকে কালো কাপড়টা সরালেন এবং বিস্মিত হলেন- সত্যিই তো! মৃত্যুর পরও জমিরুল জীবিত মানুষের মতো কেমন ড্যাপ ড্যাপ করে তাকিয়ে আছে! তার দেহের প্রাণ উড়ে গেলেও চোখের প্রাণ তো ঠিকই রয়ে গেছে! ধারালো ম্যানিলা রশির প্রহারে গলায় দীর্ঘ কালচে একটা ক্ষতচিহ্ন পড়ছে শুধু। চেহারাটাও একটু লালচে হয়ে ফুলে গেছে। কিন্তু চোখের পাতা দুটো খোলা! মুখে ছড়ানো সে হাসি! সদ্যমৃত জমিরুলের এই মৃদু হাসিতে যেন লুকিয়ে আছে মোলায়েম কোনো বিদ্রূপ। সুপার সাহেব চোখ দুটির দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলেন এবং কৃত্রিম আলোয় বিস্ময়কর একটা দৃশ্য দেখে থমকে গেলেন! বিস্ফারিত দৃষ্টি ফেলে তিনি দেখলেন, জমিরুলের চোখের মণিঘেরা সাদা অংশজুড়ে সবুজ রঙের হালকা একটা আবরণ ছড়ানো এবং চোখের কনীনিকাজুড়ে হালকা কতেক লালবর্ণ মেশানো, দুটোর সংমিশ্রণ অনেকটা পতাকার মতো ঠেকছে! দৃশ্যটা তাকে স্তম্ভিত করে দিলো। সুপারের ভেতরটা করুণ একটা হাহাকারে নাড়া খেয়ে ওঠলো; বেখায়ালেই খেদোক্তি ঝাড়লেন তিনি,‘লোকটা কী সত্যিসত্যিই অপরাধী ছিলো!’ জমিরুলের কথা তিনি ফেলতে পারলেন না। নিজের অজান্তেই তার হাত দুটো জমিরুলের চোখের দিকে এগিয়ে গেলো। সুপারের কম্পমান হাতের পরশ পেয়ে নির্বিকার চোখ দুটি মুদে এলো, একমুহূর্তে হাসিটিও নিঃশেষ হয়ে গেলো। তীব্র মলিনতায় ঢেকে গেলো তার মুখ। ময়নাদন্তের অপেক্ষায় পড়ে রইলো নিথর দেহ। সুপারের দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়লো। বের হয়ে গেলেন তিনি। রাষ্ট্রীয় নিয়ম মানতে ব্যস্ত হয়ে ওঠলো ডোম সদস্যরা। জমিরুলের ঘাড় এবং হাত-পায়ের রগ কাটতে যখন টুংটাং করে ওঠলো ছুরিসমেত যন্ত্রাপাতির শব্দঝঙ্কার, ঠিক অই মুহূর্তে পাশের রুম থেকে অদ্ভুত একটা শব্দমিশ্রিত আওয়াজ বেরিয়ে এলো, কান্নার শব্দ! নিকটতম কোনো স্বজনের মৃত্যু না হলে এতটা বিলাপ-আর্তকণ্ঠে কেঁদে ওঠার মানুষ আজকাল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!
রফিকুজ্জামান রণি, বাংলাদেশ
ছবিঃ ইন্টারনেটের সৌজন্যে
২রা অক্টোবর ২০১৯