আরশি কথা

আরশি কথা

No results found
    Breaking News

    সম্পর্ক" ... বাংলাদেশ থেকে দেবব্রত সেন এর ছোট গল্প

    আরশি কথা
    শীতটা একটু বেশিই পড়ছে এবার। টীলটী শালটাকে আরো ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সামনের সবজির ধামাটার দিকে অগ্রসর হলো। টাটকা পুঁইশাকচিংড়ি শুটকি দিয়ে রান্না করলে বেশ হবে খেতে।
    কপিআলু আর আধা কেজি বেগুন এরমধ্যেই কিনে নিয়েছে সে। যাবার সময় শুটকিটা কিনে নিলেই হবে।
    কাপড়টা একহাতে একটু উঁচু করে মাঝ বয়সী দাঁড়িওয়ালা লোকটার সামনে দাঁড়াল টীলটী-
    ভাই আপনার পুঁইশাক কত?
    দুটাকা আঁটিদিদি মনি।
    টীলটী খানিকটা আনমনা হয়ে গেল।
    ’ আঁটি দেবদিদি মনিটীলটীর ভাবগতি দেখে লোকটা বোধ হয় দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। দিদি মনি আবার এত কিভাবে সামান্য শাক কিনতে। লোকটার পুন: প্রশ্নে টীলটী বাস্তবে ফিরে আসে। সামান্য একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাব্যস্ত করে না’ রেখে দাও। লাগবে না আজ। বলেই টীলটী উল্টা দিকে হাঁটা শুরু করলো।
    বিয়ের মাস তিনেক পর বাপের বাড়ি এসে সেবার টীলটী জয়ন্তকে দিয়ে চিংড়ি শুটকি আর পুঁইশাক আনিয়েছিল। নিজহাতেই শুটকি দিয়ে পুঁই শাকের চচ্চড়ি আর শুটকি ভেজে ভর্তা বানিয়েছিল।
    পরিবেশন করার সময় বাবা বেশ অবাকই হয়েছিলেন। বললেন-
    এটা আবার কি?
    -শুটকি ভর্তা বাবা। চট্টগ্রামী ডেলিকেসি। হাসতে হাসতে জয়ন্ত বলেছিল। তারপর আবার ফোড়ন কেটে বলেছিল- শিখেনেশিখেনে তিতলিযত পারিশ ওদের রান্না শিখে নেতারপর আমাদের খাইয়ে যাবি। রান্নাটা ওরা ভালোই জানে।
    মার বুঝি একটু গায়ে লেগেছিল কথাটা। তিনি কৃত্তিম রাগের সাথে বলেছিলেন- থামতো। আমরা বুঝি রাঁধতে জানি না। এত বড় হলি কাদের রান্না খেয়েশুনি?
    মজা পেয়ে খুব করে হেসেছিল দু’ ভাই বোন। শ্বশুর বাড়িতে এ ধরনের রসিকতা করার প্রশ্নই ওঠে না। সেখানে একবারে অন্যরকম পরিমন্ডল যেন স্বামীশাশুড়িদেবরননদ সবাই যেন অন্য ধারার মানুষ।
    কালরাত্রির পরদিন সকালে টীলটীর এক পিসতুতো ননদ এসেছিল। এসেই ভাই বোনে খুনসুটি শুরু করে দিল টীলটীকে সাক্ষী মেনে।
    দ্যাখোইবারে কয় ননদী। বিয়া বাড়িত আইস্থ যে নিয়নতরন খাইতে। কাজকাম গইরতে নয়। কেয়ারে তুই আগে আইত ন পারলি?
    রাখরাখতুঁই আর কথা ন কইওআঁর বিয়ার পরতথুন কবার গেইয়বইন কেন আছে কোন দিন পৌঁছার গইরগ নাএই তাতারি উজি আইসসি দেখিয়ারে তোঁয়ার পিরিত উথলি উইটটে যেন্।
    তোরে আঁই ঝাঁডাদি মইরজুমবুইজঝসনাস্বামীর মুখে অনবরত চট্টগ্রামের ভাষা শুনতে শুনতে টীলটীর হঠাৎ কেমন জানি ভয় ভয় করছিল। কে বলবে এই মানুষটাই পি.ডব্লিও.ডি.র কনষ্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার।
    র কনষ্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার।
    ওদের আচার অনুষ্ঠাননিয়ম-প্রথাএমনকি ভাবনার ধরণও আলাদাআলাদা সহব্যৎ। আলাদা চাল-চলন। শত্রুতাসেও এক রকম আলাদা। ওদের আঘাতওদের অপমানওদের সততা কোনটাই যেন বুকে বিধে গিয়ে শেষ হয়ে যায় না। তিল তিল করে দগ্ধাতে থাকে ভেতরের অন্তরাত্মাকে।
    ওবাড়ি থেকে চলে আসার পর তখন মাস আটেক পার। তখনও আগুনটা সমানে ছড়াচ্ছেচলছে নিঃশব্দ দহন। জয়ন্ত তখন ব্যঙ্গালোরে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেছে। এই ঘটনায় বাবার বয়স যেন আরো বেড়ে গেল। প্রতিদিনের বাজার করার ভারটা তাই টীলটীই নিয়েছিল। চিন্তায় শোকে তাপে কাহিল মানুষটাকে কোনো কাজ করতে দিতে মন চাইতো না টীলটীর।
    সেদিনও বড়বড় চিংড়ি শুটকি আর টাটকা পুঁইশাক নিয়ে এসছিল টীলটী। বাড়ি ফিরতেই বাবার নজর গেল।
    ওটা কী আনলিরেকী শাক?
    -পুঁইশাক বাবা। চিংড়ি শুটকি দিয়ে----- কথা শেষ করতে পারেনি টীলটী।
    ফেলে দেফেলে দে বলছি ওটাকে। উত্তেজনায় বাবার ফর্সা মুখখানি লাল হয়ে গিয়েছিল। গলার স্বর কেঁপে কেঁপে উঠছিল ওদের বাড়ির কোনো কিছু এখানে আনবিনা। এমনকি কোনো স্মৃতিও না। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দে। ইতর শয়তানদের চিহ্ন এখানে- কথা শেষ না করেই বাবা হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়েছিলেন সোফায়। মার চোখও ভিজে উঠেছিল। টীলটী শান্তভাবে এক গ্লাস জল এনে বাবার পাশে দাঁড়ালো।
    চিন্তা করিসনে মাওটা তোর কোনো বিয়েই নয়। ভুলে যা তুই ওই প্রহসন। বাবার কথা শেষ না হতেই মা জোরে ফুঁপিয়ে উঠেছিলেন- বলেছিলাম তখনশুধু ভাল চাকরি দেখে মেয়ের বিয়ে দিও না। ভালো করে খোঁজ নাও। একে ছোট জাততার পর চট্টগ্রামী ওদের সাথে আমাদের বনে কখনওআমার একটা মাত্র মেয়ে।
    - আঁর উগ্গা পোয়াআঁই পোয়ার আর উগ্গা বিয়া দিউম। অসুখ লুকইয়েনারে বিয়া দিইয়ে- চোরাইয়ার ঘরর মাইপোয়া--- টীলটীর শাশুড়ি বলেছিল শেষদিন। মন থেকে কতগুলো ছবি আর শব্দ ছিড়ে ফেলবে টীলটীমনের গহীন কোনে আরো কত স্মৃতিকত শব্দকত গন্ধকত স্বাদ অন্তরীণ আছে তা টীলটী নিজেও জানে না। সময় ও সুযোগ বুঝে মনের অলিগলিআঁকা বাঁকা পথ পেরিয়ে কখন যে কোনটা বেরিয়ে আসে!
    চাকরিটা পেয়ে টীলটীর ভালোই হলো। কেউ অবশ্য কোনদিন চাকরি নেবার জন্য তাড়া দেয়নি আবার বাঁধাও দেয়নি। নিজেকে কাজের মধ্যে রেখে টীলটী অন্য সবকিছু ভুলে যেতে চায়। সেদিন পত্রিকার বিজ্ঞাপনটা দেখে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলটেবিলের অপর পাশে বসা মহিলাটি তার বায়োডাটা দেখে ভ্রুকুঁচকে জিজ্ঞাসা করেছিল-
    এম.এ ইন সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ারদেন হোয়াট আর ইউ ডুয়িংটিচিং প্রফেশনে গেলেন না কেন?
    কোন প্রফেশনে যাবার কথাই টীলটী কোনো দিন ভাবেনিইউনিভার্সিটির বন্ধুরা যখন বিসিএস দেবার কথা বলছিল তখন টীলটী হেসে বলেছিল- তোরা পরীক্ষা টরীক্ষা দিয়ে মরগে। আমার বাবা আর ধৈর্য নেই। আমি বিয়ে করে এবার চুটিয়ে সংসার করবো।
    ডজন খানেক বাচ্চা কাচ্চার মা হবি-সারাক্ষণ পাশে পাশে সব ঘুরঘুর করবেতনুশ্রী চোখ বড় বড় করে বলেছিল। বন্ধুরা সব হেসে কুটি কুটি।
    অ্যাকচুয়্যলি আই হেভ নেভার থট অফ টেকিং টিচিং অ্যাজ আ প্রফেশন। সামান্য আনমনা টীলটীর এ উত্তরে স্মার্টনেসের চেয়ে সত্যের ভাগ বেশি বলেই বোধ হয় ব্যবসায়িক মনোভাবাপন্ন বোর্ডারদের তেমন একটা খুশি করতে পারেনি। তারপরও চাকরিটা টীলটী পেয়েছিল।
    অফিস ফেরত টীলটী নিজের চিন্তায় বুঁদ হেয়েছিল বাসটা ঝাঁকুনি দিয়ে হঠাৎ মাঝপথে থেমে গিয়েছিল টীলটী খেয়ালই করেনি। চাকাটা গেছে বোধ হয়। তাড়াতাড়ি নেমে পড়লো টীলটী।
    আনমনেই হাঁটতে শুরু করেছিল টীলটী। হঠাৎ ঝোলানো সোয়েটারের দোকানটার দিকে নজর গেল টীলটীর ছোট্ট খুপরিমতো একটা দোকানকিন্তু সুন্দর সুন্দর সোয়েটার ঝুলছে। ঢুকবোনা ঢুকবোনা করেও টীলটী গুটি পায়ে ঢুকে পড়লো।
    দোকানিটা বুড়ো মতোমাথায় কাঁচাপাকা চুল পান খাওয়া মুখে অমায়িক একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
    কী লাগিবমা-মনি?
    উলেন ব্লাউল আছে নাকি?
    ন থাকিব ক্যাবইয়ন দেখাই।
    ভাষার টানটা টীলটীর চেনা চেনা লাগছে। শেষ কয়মাসে মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছিল ভাষাটা। শ্বশুর মশাই কথায় কথায় একদিন বলেই ফেলেছিলেন- আঁরার ভাষাখান বউ তুঁই শিখি ফেলাইয় দেইর। কথা কইলে কেঅ ধরিত ন পারিব তুঁই নোয়াখাইল্যা মাইপোয়া।
    মানুষটা বড় সাদাসিধে ছিলেনওই বাড়িতে মোটামুটি শ্বশুর মশাই-ই ছেলে বউকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। দাপট ছিল শাশুড়ির যেন দামড়া গরু। মৃদুভাষী শ্বশুরমশাই রীতিমতো স্ত্রীকে সমঝে চলতেন। মুখ ফুটে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তাঁর ধাতে ছিল না। বাড়িতে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার অনেক কিছুই অজনা থাকতো লোকটার। কিন্তু শাশুড়ি ঠিকই জেনেছিলেন তার ছেলের অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। আর তাই তড়িঘড়ি করেই ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে আত্মীয় স্বজনের কাছে সব শুনেছিল টীলটী। শুভার্থী আত্মীয় স্বজন তখন নিজ গরজেই ফাঁস করেছিল সব তথ্য। টীলটীর প্রতিটা দিন রাত্র তখন নরক যন্ত্রনায় অস্থির। স্বামীর মন যে অন্য নারীতে আসক্ত তা আর কারো কাছে না হোক স্ত্রীর কাছে গোপন থাকে না। সহ্যের শেষ সীমা উত্তীর্ণ করে একদিন রাতে টীলটী ফেটে পড়েছিল-
    আমাকে বিয়ে করে ঠকালে কেনযাকে তোমার এত পছন্দ তাকে ঘরে আননি কেন------
    কথা শেষ হবার আগেই মুখটা চেপে ধরে ছিল শুভময়।
    শরম নগরে তোর অই কথা কইতেআঁই ঠগাই না তোর বাপ ঠগাইয়েবিয়ার সমত দিব দিব গরিয়েনারে কিছু ন দেয়। মোটর সাইকেল দিবার কথা আছিল পরে দিব কইয়েনারে সটকি পইড়ঝেএকখান দিনরলাই সুখ দিত পাইরজঝ না?
    লাথি মারিয়েনা বাইর গরি ন দিই যেহিয়ানওবোত। যা গরঝি ভালা গরঝিআরও গইরঝুম। শরম থাকে ত বাপর বাড়ি দিয়া উঠ। লাথি মারি এইল্যা বিয়ার মুখত।
    খুব সূক্ষ্মভাবে চালটা দিয়েছিল শুভময়- স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল টীলটী। আবাধ্য চোখের জল নিয়েই মরমে মরে যেতে যেতে নিদ্রাহীন রাতটি কেটেছিল টীলটীর। পরদিন এক কাপড়েই চলে এসেছিল টীলটী চির জনমের জন্য।
    দোকনানীউলেন ব্লাউজের বন্ডিলটা খুলতে খুলতে বলল- মা-মনি চাই লন। কউননা দিইউম?
    চাচাঅনের বাড়ী কি চাটগাঁত নাকি?
    ক্রেতার মুখে এমন ভাষা শুনতে অনভ্যস্ত লোকটা থতমত খায়। সহসা উত্তর দিতে পারেনা।
    ঠিকই ধইরঝেন মা। কেনে ধরিলেন কনতো?
    আঁরার দেশঅত হেডে। দুষ্টুমি করে হাঁসতে থাকে টীলটী। একটু পরে আবার বলে কিন্তু আঁই ন যাই কোন দিন। একটু পর আবার বলে উফ্-কত দিন পর দেশের কথা শুনিলাম-
    কনে কইবোবাপ মা নাইএক ভাইসেও থাকে বিদেশত।
    দুষ্টুমি করতে করতে টীলটী মার জন্য একটা উলেন ব্লাউজবাবার জন্য একটা সোয়েটার আর একটা মাফলার নিয়ে টীলটী দাম করতে লাগলো।
    কী দরদাম গরেন মা-মনিআঁর দেশর মানুষঅনারে ঠকাইয়ুম নাফ্রেশ জিনিস দিইদামঅ বেকের খুন রাখি তারঅ কম রাইখকুম।
    টীলটী দাম মিটিয়ে উঠে পড়তে দোকানী বলল,
    আবার আইসসেনদেশর মানুষ পাইলে মনত জোর পাই।
    কুয়াশা পড়তে শুরু করেছেসন্ধ্যে এখনও হয়নি। টীলটী একটা রিক্সা নেয়। মজার এ খেলাটার কথা ভাবতে ভাবতে টীলটী রাস্তার লোগুলো দেখতে থাকে। মনে মনে স্থির করে এ খেলাটার কথা বাড়িতে কাউকে বলা যাবেনা। নাইবা গেলথাকনা খেলাটা তার একান্ত নিজস্ব হয়ে।
    -এগুলো আবার কিনে আনতে গেলি কেনবাবা মা দুজনেই একসাথে অনুযোগ করেন। টীলটী বুঝতে পারে অনুযোগের অপর পিঠে রয়েছে আনন্দ। সেটা বুঝতে পেরে টীলটীর বাবা মা দুজনের গলাটা জাড়িয়ে ধরে। যাওএখন পরে দেখতো গায়ে হয় কিনা?
    সন্ধ্যা প্রদীপ দিয়ে আহ্নি সেরে মা যখন চা করে নিয়ে এল টীলটী তখনও বারান্দায় বসে ছিল চাদরটা গায়ে জড়িয়ে।
    অন্ধকারে বসে থাকা মেয়েটার দুঃখী মুখখানা দেখে মায়ের মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। কাছে এসে টীলটীর মাথায় হাত রাখেন।
    তুই একেবারে একটা পাগলিজামাটা ভাল পড়েনিতো কী হয়েছেএক একটা দোকানদার এরকম ক্রেতা পেলে ঠকিয়ে দেয়। মন খারাপ করিস না। চা খাবি আয়তোর বাবা বসে আছেন।
    টীলটী লোকটার কথাই ভাবছিল। আশ্চার্য! এমন করে ঠকালো লোকটা দেশের লোক বুঝেওনাকি এরা ঠকাতে এত অভ্যস্ত যে কোনো সেন্টিমেন্টেই এর গলে না। মায়ের কথায় মুহূর্তে সচকিত হয় সে। মার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে আমি ওই নিয়ে মোটেই ভাবছিনা মা। তুমি যাও মাআমি যাচ্ছি এক্ষুনি। উফ্ মা.... তুমি না.....


    দেবব্রত সেন,বাংলাদেশ
    ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট 
    ১২ই জানুয়ারি ২০২০
    3/related/default