আজ সপ্তাহখানেক হলো মা নাছিমা বেগম কেমন যেন স্থবির হয়ে গেছেন। প্রায় রাতে গুমড়ে গুমড়ে কাঁদেন, এমনকি সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে কি যেন বিড়বিড় করে বলেন আর চোখ মুছেন, যা হ্যারিকেনের নিভু আলোয় স্পষ্ট বুঝা যায় । এদিকে বাবা আবদুর রব বাড়ি থেকে গেছেন প্রায় ১০ দিন হলো। ছেলে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে মা বলতেন তোর নানি বাড়ি গেছে। কিন্তু দাদীকে জিজ্ঞেস করার পর জানা গেল মূল ঘটনা। গতকাল স্কুলের শিক্ষক ও বারবার জিজ্ঞেস করছিল বাবার কথা কিন্তু দাদীর বারণ তুহিন শিক্ষককে কিছুই বলেনি। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না বাবা কেন দেশ মুক্তির কাজে গেছে আর কখনইবা ফিরে আসবেন।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়া ১৪/১৫ বছর বয়সের তুহিন যুদ্ধ ,স্বাধীনতা, এ সম্পর্কে তেমন কিছুই বোঝেনা, কিন্তু দাদী গতয়কয়েক দিন ধরে খুব কাছাকাছি রাখছে, বুকে আগলে ধরে নানা বিষয়ে কথা বলে এবং আকার ইঙ্গিতে কিছুটা গল্পের ছলে যুদ্ধের কথা, মানুষের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে তুহিনকে বুঝাচ্ছে । দাদী তাকে একা কোথাও বেরোতে দিচ্ছে না, বারবার নিজের চোখে চোখে রাখছে। এদিকে গতকাল তুহিনের স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে । দাদীর উৎকন্ঠা আর মায়ের মাঝে রাতে নির্ঘুম কান্না ছেলে প্রায়ই খেয়াল করছে। গতকাল মাঝরাতে দাদী হঠাৎ করে গুমড়ে কেঁদে উঠেছিলো, তুহিন তাকে জিজ্ঞেস করতেই দাদী বলল কই কিছু নাতো এমনিতেই খারাপ স্বপ্ন দেখছিলাম তো! তাই সেই ভয়ে একটু কান্না আসছে দাদাভাই । কান্না বিজড়িত কণ্ঠে দাদী তুহিনকে বুকে আগলে ধরে চুপ করে শুয়ে রইলো। ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের কথা, বাবা যে নানিবাড়ির কথা বলে যুদ্ধে গিয়েছে সে কথা বোঝার আর বাকি নেই তুহিনের। আজি প্রথম বাবার লম্বা অনুপস্থিতি অনুভব করছে তুহিন, কিন্তু তাদের সান্ত্বনা আর মায়ের চোখের জল খানিকটা স্থগিত করে দিয়েছে । এজন্য মাকেও কিছু বলতে পারছে না । বাবার জন্য মায়ের অস্থির আচরণ ছেলের চোখকে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারেনি মা নাসিমা বেগম।
বৃদ্ধা মা, স্ত্রী নাসিমা বেগম এবং একমাত্র ছেলে তুহিন কে নিয়েই আব্দুর রব এর সংসার। পৈত্রিক কিছু জায়গা জমি আর কিছু গবাদিপশু দিয়ে ভালই কাটছিল রবের সংসার। দরিদ্র কৃষকের সন্তান লেখাপড়ার সুযোগ পাননি কোনরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ক্লাস সিক্স তার পর থেকেই সংসারের হাল ধরা। বিয়ের কিছুদিন পরেই বাবা ইহকাল ছেড়ে যান এবং তারপরে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয় তার। একমাত্র ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রামে, স্বামীকে নিয়ে ঢাকা শহরে তার বসবাস। হঠাৎ চারদিকে ২৬ শে মার্চের কালো রাতে হানাদার বাহিনীর আক্রমণে শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও প্রতিবাদে মানুষ ফুঁসে উঠেছে মুক্তির কামনায়। মা মাটি দেশের মুক্তি আর স্বাধীনতার জন্য পাশের বাড়ির আলী চাচার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান়। বিদায় বেলা স্ত্রী আর একমাত্র সন্তানকে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে মাকে বলেছিল তুমি ওদের আগলে রেখো মা , আমি রক্তিম পতাকা নিয়ে বিজয়ের মালা হাতে একদিন তোমার কাছে ফিরে আসব।
হঠাৎ এপ্রিল মে এর মাঝামাঝিতে এক রাতে সবাই যখন ঘুমোতে যাবে ঠিক তখন দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। মা ভেবেছিল বাবা ফিরছে, দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দেখতে পেলো দুজন লোক মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি তারা কিছু না বলেই বাসার ভেতরে ঢুকে তার দিকে তাকিয়ে বলল এটা রবের- ? পাশের ঘর থেকে দাদী দৌড়ে আসলেন এবং তাদের পরিচয় জানলেন তারা বাবার সাথে যুদ্ধে গিয়েছিল তারাও মুক্তিযোদ্ধা। দাদী বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন রব গতকাল শত্রুর বুলেটের আঘাতে আহত হয়েছেন আমরা কোন রকম তাকে হাসপাতালে রেখে চলে আসি, আসার সময় রব তার পকেট থেকে এই চিঠিখানা বের করে আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বলেছিল । অনেক কষ্ট করে এখানে এসেছি জানিনা ও আজ কেমন আছে। দাদী চিৎকার করে উঠলেন লোক দু'জন আর বিলম্ব না করে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা নাসিমা বেগম তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগলেন । শাশুড়ি মা নাসিমা বেগম এর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন মা আমার খোকার চিঠিখানা একটু পড়ো। নাসিমা বেগম কান্না বিজড়িত কণ্ঠে চিঠিখানা পড়তে লাগলো-
তুহিনের মা,
কেমন আছো আর মাত্র কটা দিন তারপর ঐ হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে রক্তিম সূর্যটা ছিনিয়ে এনে তোমার কাছে ফিরে আসব । তুমি চিন্তা করো না,তোমার নিখাদ ভালোবাসা আর মা মাটি দেশের জন্য যে উৎসাহ তুমি জাগিয়ে আছো তা বুকে লালন করে রণক্ষেত্রে পড়ে আছি । জানো! খোকার মা কাল রাত্রে শত্রুদের দুর্গ ঘুরিয়ে দিয়েছি আমরা মাত্র ১১ জনে এটা কেবল তোমার ভালোবাসা জড়ানো প্রার্থনার জন্য সম্ভব হয়েছে । খোকাবাবু টা নিশ্চয়ই আমার কথা জিজ্ঞাসা করে, দরজায় সামনে ৎদাঁড়িয়ে থাকে প্রতিদিন ? কি করব বলো দুর্বার বাসনায় মাথায় গামছা বেঁধে নিজেকে তৈরি করেছি শত্রুমুক্ত করব বলে । তোমাদের দেখার ইচ্ছেটা যে আমার কতটা প্রবল সে কথা বুঝাতে পারবো না। বিশ্বাস করো খোকার মুখখানা বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওকে তুমি আগলে রেখো, আর মায়ের যত্ন নিও এটা তোমার কর্তব্য । নাসিমা বেগম চিঠি পড়ছে আর চোখের পানি গড়িয়ে গড়িয়ে দু'গাল বেয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ছে। হঠাৎ দেখলেন তার শাশুড়ি মাটিতে ঢলে পড়ছেন। নাসিমা বেগমের চিৎকারে বাড়ির অন্যান্য লোকজন দৌড়ে এসে দেখলেন তার শাশুড়ি আর নেই। রাতেই আত্মীয়-স্বজনকে খবর দেওয়া হলো। নিয়মমাফিক পরের দিন দুপুরে শাশুড়িকে কবর দিয়ে বড় ভাইয়ের হাত ধরে সন্তানকে নিয়ে স্বামীর ভিটা ছেড়ে নাসিমা বেগম বাপের বাড়ি চলে গেলেন।
আজ তিনদিন ছেলে তুহিন কিছুই মুখে দিচ্ছে না। তার একমাত্র খেলার সাথী দাদীকে হারিয়ে ছেলেটি আজ পাগল প্রায়। বাবা যুদ্ধে যাওয়ার পর থেকে দাদীই ছিল তার একমাত্র অবলম্বন। বারবার ছুটে যান দাদীর কবরের পাশে, মা নাসিমা বেগম কিছুতেই ছেলের বাধভাঙ্গা কান্না কে থামাতে পারছেন না। এদিকে বাবারও কোন খোঁজ নেই । কোথায় আছে কেমন আছে তারও কোন হদিস নেই। স্বপ্নভরা সংসারটা নিমেষে তছনছ হয়ে গেল নাসিমা বেগমের । দুচোখে শুধু কান্নার জল আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে অন্ধকার ভবিষ্যৎ তার দিকে তাকিয়ে আছে । সন্তানকে নিয়ে কি করবে ভেবে অস্থির, তুহিন যখনই বাবার কথা জানতে চায় মায়ের চোখে শুধু কান্না দেখতে পায়। কোন সঠিক উত্তর জানা নেই মায়ের কাছে। ইতিমধ্যে চার মাস অতিবাহিত হলেও বাবার কোন খোঁজ নেই। পাশের বাড়ি থেকে শুরু করে পাশের গ্রাম পর্যন্ত যতজনকে তুহিন চিনে সবাইকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করে এবং কোথায় কোথায় যুদ্ধ হয়, মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় থাকে সে সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করলো কিন্তু এ ব্যাপারে মা কিছুই জানেন না।
ঠিক তার দুদিন পর, মা নাসিমা বেগম সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন তুহিন বিছানায় নেই। প্রথমে ভেবেছিল হয়তো দাদীর কবরের কাছে গিয়েছে কিন্তু দুপুর অবধি গড়িয়ে আসার পরে মা নাসিমা বেগম ছুটে যান ছেলেকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না । পাগলের মত প্রায়, বৃদ্ধ শাশুড়ি, স্বামীর অনিশ্চিত সংবাদ এবং একমাত্র সন্তানকে খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণা আর সইতে পারছে না। কান্না কিছুতেই থামছেনা নাসিমা বেগমের। তুহিনের মামা-মামী বোনকে নিয়ে বসে আছেন। কোন কিছুতেই কান্না থামাতে পারছেন না। তার আহাজারিতে চারিদিকে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসছে। হঠাৎ মায়ের চোখে নজর পড়লো তুহিনের বালিশের কাছে কি যেন সাদা একটা কাগজ দেখা যাচ্ছে। নাসিমা বেগম বসা থেকে ওঠে চিৎকার করে দৌড়ে বালিশ এর কাছে গিয়ে দেখলেন তার ছেলের হাতে লেখা চিঠি। বোনের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে তুহিনের মামা পড়তে লাগলো-
মা,
আমাকে ক্ষমা করো । তোমাকে না বলেই বাবার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বাবার সংবাদ আর দাদী হারানোর যন্ত্রণা আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছিল না মা। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি বাবার খোঁজে মুক্তিযুদ্ধে যাব। আর সেই জন্যই পাশের গ্রামের করিম চাচার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। তুমি দোয়া করো মা, শুনেছি বাবা আসামের কোন এক হাসপাতলে চিকিৎসাধীন আছেন। তাই আমিও মুক্তিযুদ্ধে নিজের নাম লিখিয়ে বাবাকে খুঁজে বের করে এ দেশটাকে মুক্ত করে বাবাকে নিয়ে তোমার কোলে ফিরবো।
তুমি ভালো থেকো মা, ভাবনার করোনা, তোমার সন্তান হয়েই ঐ স্বাধীনতা নামক রক্তিম সূর্যটা ছিনিয়ে এনে খুব শিগগিরই তোমার কাছে ফিরে আসবো। মামাকে বলো ততদিন তোমাকে তারা যেন তোমাকে আগলে রাখেন ।
ইতি
তোমার খোকা তুহিন।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়া ১৪/১৫ বছর বয়সের তুহিন যুদ্ধ ,স্বাধীনতা, এ সম্পর্কে তেমন কিছুই বোঝেনা, কিন্তু দাদী গতয়কয়েক দিন ধরে খুব কাছাকাছি রাখছে, বুকে আগলে ধরে নানা বিষয়ে কথা বলে এবং আকার ইঙ্গিতে কিছুটা গল্পের ছলে যুদ্ধের কথা, মানুষের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে তুহিনকে বুঝাচ্ছে । দাদী তাকে একা কোথাও বেরোতে দিচ্ছে না, বারবার নিজের চোখে চোখে রাখছে। এদিকে গতকাল তুহিনের স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে । দাদীর উৎকন্ঠা আর মায়ের মাঝে রাতে নির্ঘুম কান্না ছেলে প্রায়ই খেয়াল করছে। গতকাল মাঝরাতে দাদী হঠাৎ করে গুমড়ে কেঁদে উঠেছিলো, তুহিন তাকে জিজ্ঞেস করতেই দাদী বলল কই কিছু নাতো এমনিতেই খারাপ স্বপ্ন দেখছিলাম তো! তাই সেই ভয়ে একটু কান্না আসছে দাদাভাই । কান্না বিজড়িত কণ্ঠে দাদী তুহিনকে বুকে আগলে ধরে চুপ করে শুয়ে রইলো। ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের কথা, বাবা যে নানিবাড়ির কথা বলে যুদ্ধে গিয়েছে সে কথা বোঝার আর বাকি নেই তুহিনের। আজি প্রথম বাবার লম্বা অনুপস্থিতি অনুভব করছে তুহিন, কিন্তু তাদের সান্ত্বনা আর মায়ের চোখের জল খানিকটা স্থগিত করে দিয়েছে । এজন্য মাকেও কিছু বলতে পারছে না । বাবার জন্য মায়ের অস্থির আচরণ ছেলের চোখকে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারেনি মা নাসিমা বেগম।
বৃদ্ধা মা, স্ত্রী নাসিমা বেগম এবং একমাত্র ছেলে তুহিন কে নিয়েই আব্দুর রব এর সংসার। পৈত্রিক কিছু জায়গা জমি আর কিছু গবাদিপশু দিয়ে ভালই কাটছিল রবের সংসার। দরিদ্র কৃষকের সন্তান লেখাপড়ার সুযোগ পাননি কোনরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ক্লাস সিক্স তার পর থেকেই সংসারের হাল ধরা। বিয়ের কিছুদিন পরেই বাবা ইহকাল ছেড়ে যান এবং তারপরে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয় তার। একমাত্র ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রামে, স্বামীকে নিয়ে ঢাকা শহরে তার বসবাস। হঠাৎ চারদিকে ২৬ শে মার্চের কালো রাতে হানাদার বাহিনীর আক্রমণে শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও প্রতিবাদে মানুষ ফুঁসে উঠেছে মুক্তির কামনায়। মা মাটি দেশের মুক্তি আর স্বাধীনতার জন্য পাশের বাড়ির আলী চাচার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান়। বিদায় বেলা স্ত্রী আর একমাত্র সন্তানকে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে মাকে বলেছিল তুমি ওদের আগলে রেখো মা , আমি রক্তিম পতাকা নিয়ে বিজয়ের মালা হাতে একদিন তোমার কাছে ফিরে আসব।
হঠাৎ এপ্রিল মে এর মাঝামাঝিতে এক রাতে সবাই যখন ঘুমোতে যাবে ঠিক তখন দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। মা ভেবেছিল বাবা ফিরছে, দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দেখতে পেলো দুজন লোক মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি তারা কিছু না বলেই বাসার ভেতরে ঢুকে তার দিকে তাকিয়ে বলল এটা রবের- ? পাশের ঘর থেকে দাদী দৌড়ে আসলেন এবং তাদের পরিচয় জানলেন তারা বাবার সাথে যুদ্ধে গিয়েছিল তারাও মুক্তিযোদ্ধা। দাদী বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন রব গতকাল শত্রুর বুলেটের আঘাতে আহত হয়েছেন আমরা কোন রকম তাকে হাসপাতালে রেখে চলে আসি, আসার সময় রব তার পকেট থেকে এই চিঠিখানা বের করে আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বলেছিল । অনেক কষ্ট করে এখানে এসেছি জানিনা ও আজ কেমন আছে। দাদী চিৎকার করে উঠলেন লোক দু'জন আর বিলম্ব না করে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা নাসিমা বেগম তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগলেন । শাশুড়ি মা নাসিমা বেগম এর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন মা আমার খোকার চিঠিখানা একটু পড়ো। নাসিমা বেগম কান্না বিজড়িত কণ্ঠে চিঠিখানা পড়তে লাগলো-
তুহিনের মা,
কেমন আছো আর মাত্র কটা দিন তারপর ঐ হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে রক্তিম সূর্যটা ছিনিয়ে এনে তোমার কাছে ফিরে আসব । তুমি চিন্তা করো না,তোমার নিখাদ ভালোবাসা আর মা মাটি দেশের জন্য যে উৎসাহ তুমি জাগিয়ে আছো তা বুকে লালন করে রণক্ষেত্রে পড়ে আছি । জানো! খোকার মা কাল রাত্রে শত্রুদের দুর্গ ঘুরিয়ে দিয়েছি আমরা মাত্র ১১ জনে এটা কেবল তোমার ভালোবাসা জড়ানো প্রার্থনার জন্য সম্ভব হয়েছে । খোকাবাবু টা নিশ্চয়ই আমার কথা জিজ্ঞাসা করে, দরজায় সামনে ৎদাঁড়িয়ে থাকে প্রতিদিন ? কি করব বলো দুর্বার বাসনায় মাথায় গামছা বেঁধে নিজেকে তৈরি করেছি শত্রুমুক্ত করব বলে । তোমাদের দেখার ইচ্ছেটা যে আমার কতটা প্রবল সে কথা বুঝাতে পারবো না। বিশ্বাস করো খোকার মুখখানা বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওকে তুমি আগলে রেখো, আর মায়ের যত্ন নিও এটা তোমার কর্তব্য । নাসিমা বেগম চিঠি পড়ছে আর চোখের পানি গড়িয়ে গড়িয়ে দু'গাল বেয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ছে। হঠাৎ দেখলেন তার শাশুড়ি মাটিতে ঢলে পড়ছেন। নাসিমা বেগমের চিৎকারে বাড়ির অন্যান্য লোকজন দৌড়ে এসে দেখলেন তার শাশুড়ি আর নেই। রাতেই আত্মীয়-স্বজনকে খবর দেওয়া হলো। নিয়মমাফিক পরের দিন দুপুরে শাশুড়িকে কবর দিয়ে বড় ভাইয়ের হাত ধরে সন্তানকে নিয়ে স্বামীর ভিটা ছেড়ে নাসিমা বেগম বাপের বাড়ি চলে গেলেন।
আজ তিনদিন ছেলে তুহিন কিছুই মুখে দিচ্ছে না। তার একমাত্র খেলার সাথী দাদীকে হারিয়ে ছেলেটি আজ পাগল প্রায়। বাবা যুদ্ধে যাওয়ার পর থেকে দাদীই ছিল তার একমাত্র অবলম্বন। বারবার ছুটে যান দাদীর কবরের পাশে, মা নাসিমা বেগম কিছুতেই ছেলের বাধভাঙ্গা কান্না কে থামাতে পারছেন না। এদিকে বাবারও কোন খোঁজ নেই । কোথায় আছে কেমন আছে তারও কোন হদিস নেই। স্বপ্নভরা সংসারটা নিমেষে তছনছ হয়ে গেল নাসিমা বেগমের । দুচোখে শুধু কান্নার জল আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে অন্ধকার ভবিষ্যৎ তার দিকে তাকিয়ে আছে । সন্তানকে নিয়ে কি করবে ভেবে অস্থির, তুহিন যখনই বাবার কথা জানতে চায় মায়ের চোখে শুধু কান্না দেখতে পায়। কোন সঠিক উত্তর জানা নেই মায়ের কাছে। ইতিমধ্যে চার মাস অতিবাহিত হলেও বাবার কোন খোঁজ নেই। পাশের বাড়ি থেকে শুরু করে পাশের গ্রাম পর্যন্ত যতজনকে তুহিন চিনে সবাইকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করে এবং কোথায় কোথায় যুদ্ধ হয়, মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় থাকে সে সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করলো কিন্তু এ ব্যাপারে মা কিছুই জানেন না।
ঠিক তার দুদিন পর, মা নাসিমা বেগম সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন তুহিন বিছানায় নেই। প্রথমে ভেবেছিল হয়তো দাদীর কবরের কাছে গিয়েছে কিন্তু দুপুর অবধি গড়িয়ে আসার পরে মা নাসিমা বেগম ছুটে যান ছেলেকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না । পাগলের মত প্রায়, বৃদ্ধ শাশুড়ি, স্বামীর অনিশ্চিত সংবাদ এবং একমাত্র সন্তানকে খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণা আর সইতে পারছে না। কান্না কিছুতেই থামছেনা নাসিমা বেগমের। তুহিনের মামা-মামী বোনকে নিয়ে বসে আছেন। কোন কিছুতেই কান্না থামাতে পারছেন না। তার আহাজারিতে চারিদিকে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসছে। হঠাৎ মায়ের চোখে নজর পড়লো তুহিনের বালিশের কাছে কি যেন সাদা একটা কাগজ দেখা যাচ্ছে। নাসিমা বেগম বসা থেকে ওঠে চিৎকার করে দৌড়ে বালিশ এর কাছে গিয়ে দেখলেন তার ছেলের হাতে লেখা চিঠি। বোনের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে তুহিনের মামা পড়তে লাগলো-
মা,
আমাকে ক্ষমা করো । তোমাকে না বলেই বাবার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বাবার সংবাদ আর দাদী হারানোর যন্ত্রণা আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছিল না মা। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি বাবার খোঁজে মুক্তিযুদ্ধে যাব। আর সেই জন্যই পাশের গ্রামের করিম চাচার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। তুমি দোয়া করো মা, শুনেছি বাবা আসামের কোন এক হাসপাতলে চিকিৎসাধীন আছেন। তাই আমিও মুক্তিযুদ্ধে নিজের নাম লিখিয়ে বাবাকে খুঁজে বের করে এ দেশটাকে মুক্ত করে বাবাকে নিয়ে তোমার কোলে ফিরবো।
তুমি ভালো থেকো মা, ভাবনার করোনা, তোমার সন্তান হয়েই ঐ স্বাধীনতা নামক রক্তিম সূর্যটা ছিনিয়ে এনে খুব শিগগিরই তোমার কাছে ফিরে আসবো। মামাকে বলো ততদিন তোমাকে তারা যেন তোমাকে আগলে রাখেন ।
ইতি
তোমার খোকা তুহিন।
মা নাসিমা বেগম হঠাৎ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। কিছু বলতে পারছেন না শুধু দু'গাল বেয়ে চোখের পানি ঝড়ছে আর একদৃষ্টিতে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে করিম চাচা তুহিন কে নিয়ে প্রথমে দুর্গাপুরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম এ ওয়াদুদ মিয়ার কাছে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ১৫ বছরের এই ছেলেটিকে কিছুতেই মুক্তিবাহিনীর সাথে নিলেন না । এদিকে করিম মিয়াও নাছোড়বান্দা কিছুতেই হাল ছাড়লেন না। রাতের মধ্যেই তুহিন কে নিয়ে দাউদকান্দি হয়ে প্রথমে কুমিল্লার তিতাস তারপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে দালালের মাধ্যমে আগরতলা ক্যাম্পে পৌঁছলেন। ছেলেটির সমস্ত ঘটনা শোনার পর ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কমান্ডার ছেলেটিকে নিজের দলে নিয়ে নিলেন। প্রথমে তাকে আগরতলার মেলাঘরে ট্রেনিং ক্যাম্পে ২৬ দিন তাকে ট্রেনিং করানো হলো । তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হলো আসামের গোকুলনগর ক্যাম্পে। সেখানে ট্রেনিং করার পর পুনরায় আবার মেলাঘর হেডকোয়ার্টারে ফিরে নিয়ে আসা হলো । তারপর ৯৫ জন সদস্যের সাথে তুহিনকে কোন এক অঞ্চলে শত্রু মুক্ত করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। বয়সে ছোট হলেও তুহিনের অস্ত্র চালানো পারদর্শিতা দেখে সবাই তাকে আদর করতো এবং সবার নজর কাড়েন। তখনও তুহিন তার বাবার কোন সন্ধান পাননি । আসামের ক্যাম্পে থাকাকালীন সময়ে শুধু একজনের কাছে শুনেছিলো দুমাস আগে আবদুর রব নামের একজন আসাম হাসপাতাল থেকে পায়ে গুলি লাগা অবস্থায় আহত হয়ে অন্যত্র কোন এক হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য চলে যান। ক্যাম্পে থাকাকালীন অবস্থায় মা মাটি দেশ আর বাবাকে খুঁজে পাবার যে প্রেরণা কমান্ডার দিয়েছেন তা প্রতিনিয়ত ও তুহিনের রক্তে এবং চোখে-মুখে লেপ্টে আছে। প্রতিশোধের আগুন আর স্বাধীন হওয়ার যে মুক্ত বাসনা তার অন্তরের ভিতর দানা বেধেছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঠিক তিন দিন পরের কথা, রাত তখন আনুমানিক ৮ টা বাজে । ক্যাম্পের সবাই যখন খাওয়া-দাওয়া করে যুদ্ধ গল্পে বিভোর, ঠিক সেই সময় ক্যাম্পে শত্রুদের আক্রমণের খবর তুহিনের কানে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। চারদিকে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল সবাই যার যার অবস্থান থেকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি। ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন হঠাৎ করে দেখলেন সবার আগে রাইফেল কাঁধে তুহিন দৌড়াচ্ছে পিছু ডাকলেন। কিন্তু তুহিন কিছুই শুনছে না বারবার রাইফেল শত্রুদের দিকে তাক করে গুলি ছুড়ছে । ইতিমধ্যে তুহিনের গুলির আঘাতে তিনজন শত্রুসেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন তুহিনের পিছু নিলেন। তারপর তুহিনের বুলেটের আঘাতে আরও দু'জন পাক সেনা অন্ধকার আলোয় মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন । বাকি যারা জীবিত ছিলেন পিছু হটতে শুরু করলেন। ক্যাপ্টেন খুব কাছ থেকে তার দূরদর্শিতা দেখতে পেলেন এবং সাহসী মনোভাব নিয়ে দৌড়ে তুহিনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন। হঠাৎ কিছু বুঝার আগে শত্রুর একটি গুলি তুহিনের বুকে এসে লাগলো। সে শুধু একবার বাবা বলে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পরলো। ক্যাম্প ক্যাপ্টেন দৌড়ে গিয়ে তুহিন বলে চিৎকার করে ওকে বুকে জড়িয়ে নিলেন । গুলিবিদ্ধ তুহিন যন্ত্রণায় ছটফট করছে ক্যাপ্টেন অন্য দুজন সহ যুদ্ধাকে নিয়ে তুহিনকে গাড়িতে করে হাসপাতালের দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন।
টানা তিনদিন পর তুহিনের জ্ঞান ফিরল আসামের হাসপাতালে। ডাক্তার জানিয়ে দিলেন তখন ও তার আশঙ্কা কাটেনি। সাথে থাকা দুজন মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তারকে জানালেন ছেলেটির বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সেও মুক্তিযোদ্ধে এসেছিলেন । শুনেছি এই হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে সে চিকিৎসা নিয়েছেন। ডাক্তার জিজ্ঞেস করতেই তারা বললেন তুহিনের বাবার নাম আব্দুর রব। ডাক্তার সাহেব ছিলেন পশ্চিমবাংলার বাঙালি বাবু, তিনি নাম শুনামাত্র বললেন পাশের ওয়ার্ডে আছেন আব্দুর রব। মুক্তিযোদ্ধা দু'জন ডাক্তারের সঙ্গে গিয়ে আব্দুর রব কে নিয়ে আসলেন। ছেলেকে দেখে চিৎকার করে উঠলেন আব্দুর রব। আহা কি নিদারুণ দৃশ্য পুরো হাসপাতাল স্তম্ভিত হয়ে গেল নিমিষেই। বাবার আত্মচিৎকার খোকার কান পর্যন্ত পৌঁছতেই তুহিন ধীরে ধীরে চোখ খুললো। অধিক রক্তক্ষরণের ফলে শরীর নিস্তেজ হয়ে দেহখানি যেন হাসপাতালের বিছানায় লেপ্টে আছে। বাবার দিকে হাত বাড়াচ্ছে কিন্তু শক্তি পাচ্ছে না। আব্দুর রব নিজের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। তুহিন বাবার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল- বাবা আমি সার্থক তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। আমার পকেট এ লাল-সবুজের পতাকা রয়েছে তুমি ওটা উড়িয়ে মায়ের কাছে ফিরে যাবে বাবা। আমি দাদীমার কবরের কসম খেয়ে এসেছি এদেশকে মুক্ত করে বাবাকে নিয়ে ফিরে যাব। কিন্তু আমি যদি ফিরে যেতে নাও পারি বাবা তুমি আমার এই পতাকাটি মাকে মায়ের হাতে তুলে দিও। ডাক্তার বিনয় বাবু হঠাৎ আব্দুর রব কে বলল তোমার ছেলের গায়ে সাদা শার্ট পরানো ছিল মনে হয় সেটি কোন এক স্কুলের ড্রেস। কিন্তু অনেক রক্তক্ষরণের ফলে তার সেই সাদা শার্টটি রক্তে লাল হয়ে আছে ।এই বলেই ডাক্তার বাবু আব্দুর রব এর হাতে ছেলের রক্তে ভেজা শার্ট টি তুলে দিলো।
টানা তিনদিন পর তুহিনের জ্ঞান ফিরল আসামের হাসপাতালে। ডাক্তার জানিয়ে দিলেন তখন ও তার আশঙ্কা কাটেনি। সাথে থাকা দুজন মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তারকে জানালেন ছেলেটির বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সেও মুক্তিযোদ্ধে এসেছিলেন । শুনেছি এই হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে সে চিকিৎসা নিয়েছেন। ডাক্তার জিজ্ঞেস করতেই তারা বললেন তুহিনের বাবার নাম আব্দুর রব। ডাক্তার সাহেব ছিলেন পশ্চিমবাংলার বাঙালি বাবু, তিনি নাম শুনামাত্র বললেন পাশের ওয়ার্ডে আছেন আব্দুর রব। মুক্তিযোদ্ধা দু'জন ডাক্তারের সঙ্গে গিয়ে আব্দুর রব কে নিয়ে আসলেন। ছেলেকে দেখে চিৎকার করে উঠলেন আব্দুর রব। আহা কি নিদারুণ দৃশ্য পুরো হাসপাতাল স্তম্ভিত হয়ে গেল নিমিষেই। বাবার আত্মচিৎকার খোকার কান পর্যন্ত পৌঁছতেই তুহিন ধীরে ধীরে চোখ খুললো। অধিক রক্তক্ষরণের ফলে শরীর নিস্তেজ হয়ে দেহখানি যেন হাসপাতালের বিছানায় লেপ্টে আছে। বাবার দিকে হাত বাড়াচ্ছে কিন্তু শক্তি পাচ্ছে না। আব্দুর রব নিজের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। তুহিন বাবার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল- বাবা আমি সার্থক তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। আমার পকেট এ লাল-সবুজের পতাকা রয়েছে তুমি ওটা উড়িয়ে মায়ের কাছে ফিরে যাবে বাবা। আমি দাদীমার কবরের কসম খেয়ে এসেছি এদেশকে মুক্ত করে বাবাকে নিয়ে ফিরে যাব। কিন্তু আমি যদি ফিরে যেতে নাও পারি বাবা তুমি আমার এই পতাকাটি মাকে মায়ের হাতে তুলে দিও। ডাক্তার বিনয় বাবু হঠাৎ আব্দুর রব কে বলল তোমার ছেলের গায়ে সাদা শার্ট পরানো ছিল মনে হয় সেটি কোন এক স্কুলের ড্রেস। কিন্তু অনেক রক্তক্ষরণের ফলে তার সেই সাদা শার্টটি রক্তে লাল হয়ে আছে ।এই বলেই ডাক্তার বাবু আব্দুর রব এর হাতে ছেলের রক্তে ভেজা শার্ট টি তুলে দিলো।
তুহিন হটাৎ বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে, কিছু বলতে চা্চ্ছে কিন্তু পারছেনা । ডাক্তারবাবু দৌড়ে এগিয়ে গেলেন কিন্তু কি বিধি বাম চোখের পলকে ছেলেটি বাবার হাত আর নিজের হাতের মাঝখানে পতাকা আর নিজের গায়ের সেই রক্তভেজা সাদা শার্ট টি চেপে ধরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। হাসপাতালের পুরো ওয়ার্ড চিৎকারে ভারী হয়ে গেলো। বাবা আব্দুর রব নির্বাক হয়ে সন্তানের দিকে তাঁকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এদিকে আব্দুর রব পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি, বুলেটের ক্ষত তাকে হাসপাতালের বিছানায় ঠাঁই করে দিয়েছে। আসাম মসজিদের পাশে দেশের জন্য শহীদ হওয়া আরও দেশের জন্য শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিজের একমাত্র সন্তান তুহিনকেও সমাহিত করলেন। তার তিনদিন পর হঠাৎ সবাই হাসপাতালে উল্লাসিত কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না আব্দুর রব। কেউ একজন এসে বলল পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে এবং বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। আব্দুর আব্দুর রব খুশিতে আত্মহারা নিজের সন্তানের জীবন দিয়ে হলেও মা-মাটি-দেশকে আজ শত্রুমুক্ত করতে পেরেছে।
দেশ শত্রুমুক্ত এবং স্বাধীন হওয়ার ঠিক দশ দিন পর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু মা মারা যাবার পর স্ত্রী তার বাপের বাড়িতে আছেন সে কথা তিনি জানতেন না। বাড়ির সব লোকজন দৌড়ে আসে আব্দুর রব কে দেখার জন্য। কেউ কান্না করছে কেউ আদর করছে কেউবা তার মা মারা যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা দিচ্ছেন। কেউ আবার তার কাছে বারবার তুহিনের খবর জানতে চাচ্ছেন। ইতিমধ্যে নাসিমা বেগম খবর পেয়ে তার ভাইকে সাথে নিয়ে স্বামীর ভিটেমাটিতে এসে হাজির। কান্না বিজরিত ভালবাসায় রবের বুকে মাথা রাখলেন নাসিমা বেগম। হঠাৎ ছেলের জন্য ছুটোছুটি শুরু করে দিলেন, ঘরের ভেতর ছেলেকে খুঁজতে লাগল কেউ নেই । চিৎকার করে ওঠলো আমার খোকা কোথায়? খোকার বাপ তুমি আমার খোকাকে নিয়ে আসো নি? আব্দুর রব মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে যেন নির্বাক। স্ত্রীকে কিছুই বলতে পারছে না, শুধু মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে আর দু'গাল বেয়ে টপটপ করে চোখের জল মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। স্ত্রী আর আত্মীয় পরিজনের আত্মচিৎকারে আব্দুর রব নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না । চিৎকার করে বলে উঠলো খোকার মা আমার তুহিন আর নেই, তোমার খোকা দেশের জন্য নিজের জীবন দিয়েছে । তোমার খোকা শত্রুদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিল এক রাতে এবং তার হাতে ৫ জন পাক হানাদার বাহিনী সেদিন মারা গিয়েছিল। স্ত্রী নাসিমা বেগম স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কিছুই বলতে পারছেনা। খোকার মা তোমার ছেলেকে আমি নিজ হাতে কবর দিয়েছি। খোকার যখন গুলি খেয়ে হাসপাতালে আসে তখন ওর সাথে আমার হাসপাতালে দেখা হয়েছিলো। আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিলো - বাবা আমি তোমাকে খুঁজতে এসেছি আর এ দেশ স্বাধীন করার জন্য, তুমি আমার দেয়া এই পতাকা আমার মায়ের হাতে তুলে দিও। খোকার মা তুমি দেখো খোকার রক্তমাখা সেইসাথে শার্ট খানা? আব্দুর রব তার ছোট্ট ব্যাগ থেকে তুহিনের রক্তে মাখা শার্ট আর মাকে দেওয়া লাল সবুজে ঘেরা পতাকাটি বের করলেন। নাসিমা বেগম ঘরের দরজার সামনে সিঁড়িতে বসে আছে, আব্দুর রব ধীরে ধীরে স্ত্রীর কাছে এগিয়ে গেলেন। সন্তানের দেয়া লাল সবুজের পতাকা আর খোকার রক্তমাখা শার্ট স্ত্রীর হাতে তুলে দিলো।
দেশ শত্রুমুক্ত এবং স্বাধীন হওয়ার ঠিক দশ দিন পর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু মা মারা যাবার পর স্ত্রী তার বাপের বাড়িতে আছেন সে কথা তিনি জানতেন না। বাড়ির সব লোকজন দৌড়ে আসে আব্দুর রব কে দেখার জন্য। কেউ কান্না করছে কেউ আদর করছে কেউবা তার মা মারা যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা দিচ্ছেন। কেউ আবার তার কাছে বারবার তুহিনের খবর জানতে চাচ্ছেন। ইতিমধ্যে নাসিমা বেগম খবর পেয়ে তার ভাইকে সাথে নিয়ে স্বামীর ভিটেমাটিতে এসে হাজির। কান্না বিজরিত ভালবাসায় রবের বুকে মাথা রাখলেন নাসিমা বেগম। হঠাৎ ছেলের জন্য ছুটোছুটি শুরু করে দিলেন, ঘরের ভেতর ছেলেকে খুঁজতে লাগল কেউ নেই । চিৎকার করে ওঠলো আমার খোকা কোথায়? খোকার বাপ তুমি আমার খোকাকে নিয়ে আসো নি? আব্দুর রব মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে যেন নির্বাক। স্ত্রীকে কিছুই বলতে পারছে না, শুধু মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে আর দু'গাল বেয়ে টপটপ করে চোখের জল মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। স্ত্রী আর আত্মীয় পরিজনের আত্মচিৎকারে আব্দুর রব নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না । চিৎকার করে বলে উঠলো খোকার মা আমার তুহিন আর নেই, তোমার খোকা দেশের জন্য নিজের জীবন দিয়েছে । তোমার খোকা শত্রুদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিল এক রাতে এবং তার হাতে ৫ জন পাক হানাদার বাহিনী সেদিন মারা গিয়েছিল। স্ত্রী নাসিমা বেগম স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কিছুই বলতে পারছেনা। খোকার মা তোমার ছেলেকে আমি নিজ হাতে কবর দিয়েছি। খোকার যখন গুলি খেয়ে হাসপাতালে আসে তখন ওর সাথে আমার হাসপাতালে দেখা হয়েছিলো। আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিলো - বাবা আমি তোমাকে খুঁজতে এসেছি আর এ দেশ স্বাধীন করার জন্য, তুমি আমার দেয়া এই পতাকা আমার মায়ের হাতে তুলে দিও। খোকার মা তুমি দেখো খোকার রক্তমাখা সেইসাথে শার্ট খানা? আব্দুর রব তার ছোট্ট ব্যাগ থেকে তুহিনের রক্তে মাখা শার্ট আর মাকে দেওয়া লাল সবুজে ঘেরা পতাকাটি বের করলেন। নাসিমা বেগম ঘরের দরজার সামনে সিঁড়িতে বসে আছে, আব্দুর রব ধীরে ধীরে স্ত্রীর কাছে এগিয়ে গেলেন। সন্তানের দেয়া লাল সবুজের পতাকা আর খোকার রক্তমাখা শার্ট স্ত্রীর হাতে তুলে দিলো।
নাসিমা বেগম ক্রমশ ওঠে দাঁড়িয়ে সন্তানের দেয়া বিজয়ের পতাকা নিজের গায়ে জড়িয়ে নিলেন, তার পর বাড়ির উঠোনে ভীড় করা শত লোকের সামনে খোকার গায়ের রক্তমাখা শার্ট হাতে নিয়ে চিৎকার করে ওঠলো। তার এই আত্মচিৎকারে সমস্ত ধরনী যেন নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ নাসিমা বেগম চোখ মুছে খোকার শার্ট খানা দুহাতে মেলে ধরে বলতে লাগলো-
" মরেও খোকা আমার জাতির তরে
এনেছে স্বাধীনতা বাংলার তটে,
আজীবন গেয়ে যাব লাল সবুজের গান
আমার খোকার রক্তে ভেজা শার্টে" ।
এনেছে স্বাধীনতা বাংলার তটে,
আজীবন গেয়ে যাব লাল সবুজের গান
আমার খোকার রক্তে ভেজা শার্টে" ।
----------0------------
খোরশেদ আলম বিপ্লব
লেখক ও মানবাধিকার কর্মী
ঢাকা বাংলাদেশ
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
লেখক ও মানবাধিকার কর্মী
ঢাকা বাংলাদেশ
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
১২ জানুয়ারী ২০২০