পড়ন্ত বিকেলে, ক্লান্ত শরীরে রহমত বাড়ি ফিরছিল। আজও কোন রোজগার হয় নি। এমনিতেই রমজানের এই দিনগুলিতে ট্যুরিস্টের ভীড় তুলনামূলক কম হয়। জুন মাসের প্রচণ্ড দাবদাহে পুরো উত্তর ভারত জ্বলতে থাকে,আগ্রার ফতেপুর সিক্রি তেও তাই। মইনুদ্দিন চিস্তির দরগা-তে কিছু মানুষ আসে,বিশ্বাস নিয়ে,আশা নিয়ে।তাদের কে অনেক ভুজুং ভাজুং দিয়ে কিছু রোজগার করে। প্রচুর কথা বলতে হয়। এর মধ্যে অন্য প্রতিদ্বন্দীদের সাথে প্রতিযোগিতাও আছে।রমজানের এই দিনগুলিতে খুব কষ্টই হয়। কিন্তু সন্ধ্যায় ‘ইফতার’ এ সবাই একসাথে মিলিত হয়ে,খাওয়াদাওয়া..খুব আনন্দ হয়। কিন্তু এবার ! কি যে মহামারী এসেছে…সব শেষ করে দিচ্ছে।আজ তার বড় ছেলেটাকে দেখে বুক মুচড়ে ওঠে। প্রথমা বিবি ফতেমাকে যখন ছেড়ে দ্বিতীয় নিকা করে,ফাহেম আর ফৈয়াজ তখন কিশোর।খুব কষ্ট করে তারা বড় হয়েছে। ফৈয়াজ ফতেপুর সিক্রিতেই ঘুরে ঘুরে রূপোর গয়না বিক্রি করে,আর ফাহেম দুবাইতে কাজ করে।ফতেমা মাত্রই সুখের মুখ দেখছিল। এর মধ্যে এই ভাইরাস-এর জন্যে সবার পেটেই লাথি পড়ছে। ফাহেমের চাকরী যেতে পারে,ফৈয়াজের রোজগার বন্ধ। বেড়াতেই আসছে না কেউ,কে কিনবে ! ফৈয়াজকে শুকনো বিষণ্ণ মুখে চাতালে বসে থাকতে দেখে রহমত এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ ক্যায়া হুয়া? ঘরমে সব ঠিক!’ দু’ ছেলেই তাকে ঘৃণা করে,কথা বলে না।আজ তার স্নেহভরা কণ্ঠে ফৈয়াজ মাথা নাড়ে। কিছুই ঠিক নেই,দু’মাস হতে চলল, রোজগার বন্ধ। জমা টাকাতে টান পড়েছে। দুধের নাতিটার জন্য একটু দুধ,ফতেমার ওষুধ কেনা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। রহমতের সামান্যই রোজগার হয়েছিল। একটা পার্টি পেয়েছিল আজ। জোর করে দিয়ে দিল ফৈয়াজকে। কখনো তো কিছু করে নি,তাদের জন্যে। বাপ থাকতেও পিতৃহীন হয়েই বড় হয়েছে,ওরা।ব্যাংক থেকেও তুলে দেবে,মনস্থ করল। এই বেগম না জানলেই হল। এ বেগমের কোন সন্তান হল না। দু’টো তো পেট,চলেই যাবে। “ ইয়া আল্লা,রেহম কর’, … এই ঈদ যেন খুশীর ঈদ হয়,…মনে মনে প্রার্থনা করে। সন্ধ্যা নেমে আসছে, শতাব্দী পুরনো এই বিশাল অট্টালিকা,প্রাসাদে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে আসছে। রহমতের সুর্মা আঁকা চোখ আর্দ্র হয়ে আসে।
২০২০ সালের ঈদ যে এভাবে আসবে,ভাবে নি কেউ। ভাবেনি রফিকও। কত স্বপ্ন এই উৎসবকে ঘিরে। পাই পাই পয়সা বাঁচিয়ে রাখে,বাড়ি যাবে এই উপলক্ষ্যে। টিকিটের দাম,সবার জন্য উপহার …জামাকাপড়,খেলনাপাতি…কত কিছু। বাচ্চা দুটো পথ চেয়ে থাকে,কখন ‘আব্বু’ আসবে! আর নূর মানে তার বেগম যখন খুশী হয়ে নতুন শাড়ি পরে সেমুই খাইয়ে দেয়….রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাবার পর…সত্যি নিজেকে বাদশাই মনে হয়।
সারাটা বছর এই মরুভূমির দেশে লেবার ক্যাম্পে থেকে, হাড়ভাঙা খাটুনি, আর অমানবিক ব্যবহার…সব সহ্য করে ওরা,মানে ওর মত যারা শ্রমিক হয়ে এসেছে মিডল ইস্ট এর দেশগুলিতে।
এবার এই ভাইরাসের প্রকোপে কম্পানি প্রচন্ড রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।অনেক ইন্জিনীয়ারদের চাকরী যাচ্ছে,আর এরা তো শ্রমিক !
কোথায় বোনাস পেয়ে কেনাকাটা করবে, তা নয় । মাইনেই পাওয়া যায় নি।চাকরী গেলে দেশে ফিরে কি করবে? যা কিছু জমি ছিল,বন্ধক দিয়ে,এজেণ্টকে মোটা টাকা দিয়ে,তবেই এখানে আসতে পেরেছিল।মাইনের এক অংশ কিস্তি সুদ করতেই যায়।তারপর দেশে পাঠিয়ে,খুব সামান্যই হাতে থাকে।ফিরে গিয়ে চাষবাস করা সম্ভব নয়।দুশ্চিন্তায় আকুল হয়ে দু’হাতে মাথা ধরে বসে থাকে।রোগা লিকলিকে বয়স্ক সফিকুল কাছে এসে বলল, “ কি মিঞা,এ্যমনে বইস্যা রইছ ক্যান?”
“ কিতা হইব,সফিকুল ভাই! দ্যাশে গিয়া কি করুম!’,আকুল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে রফিক।
সফিকুলের কাছে এর উত্তর জানা নেই,ঠোঁট উল্টে ,দু হাতের তালু উপরে উঠিয়ে সে এক দেহভঙ্গী করল।সন্ধ্যা নামছে,পাশের মসজিদ থেকে আজান শুরু হল।এখন মসজিদেও যাওয়া যায় না।নইলে রমজানের দিনগুলিতে মসজিদে গিয়ে তারা ‘ইফতার’ করত।কত কত খাবার…ক্যাম্পের একঘেয়ে খাবার থেকে অন্যরকম।মল গুলিতে ডিসকাউন্ট চলে…তারা দলবেঁধে সাধ্য মত কেনাকাটা করত।
পাকিস্তানি বিলাল কিছু খেজুর দিয়ে বলে, “ আভি তো ইসিসে ইফতার পার্টি হোগা। লো খা লো’।সারাদিনের উপোসের পর এই দাঁতে কাটা।রফিকের চোখে জল এসে যায়,মুখ ফিরিয়ে লুকায়।
তারা তিনজনই একই নৌকার যাত্রী।নৌকোর তলায় যে ফুটো হয়েছে, তা সারাবার কোন পথ নেই।মালয়ালী ক্রীশ্চান ছোঁড়া রবি বাঁশিতে ফুঁ দেয়।কি মর্মস্পর্শী বেদনার ছোঁয়া,তার সুরে। হৃদয় নিংড়ে নিচ্ছে।অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, অন্ধকারের রঙ কি আগে এত কালো ছিল ! নির্জনতা আর নীরবতায় ক্যাম্পটি যেন মুড়ে আছে,কালো কালো ছায়ামূর্তিরা দিশাহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে,অজানা ভবিষ্যতের চিন্তায় আকুল।
লাহোর থেকে প্রায় ১২০ কিমি দূরে, এক গ্রামে সন্ধ্যা নেমেছে।সারাদিনের উপোসের পর ক্লান্ত ,ক্ষুধার্ত ফরজানা আটা মাখছিল।কোনরকমে ‘ইফতার’ করা হল, বাড়ির গাছের ফল পাকুড় দিয়ে।কেমন নিরানন্দ হয়ে গেছে জীবনটা।পুরো গ্রামটি বিষণ্ণতার চাদরে মুড়ে রয়েছে।অন্য বছর রমজান এর মাসে, সন্ধ্যার পর কত মেহমান আসত,কত খাবার বানানো হত। আর এখন!আজ পাঁচদিন হল বিলালের ফোন আসে নি।হয়ত ফোনে টাকা নেই।বিলালের মা আর ছেলেমেয়ে দুটোকে বোঝাতে বড় কষ্ট হচ্ছে।এরা আশা করে আছে,বিলাল সবার জন্য উপহার নিয়ে ঈদে আসবে।বড় মায়া হয়,তাদের আশা গুলো গুড়িয়ে দিতে।যদি এর মধ্যে কিছু ঘটে আবার আগের মত হয়ে যায়! উঠোনে খাটিয়ায় বসেবিলালের আম্মী হুঁকো টানে,মনে আশা,যদি ঈদ এর আগে সব ঠিক হয়! হাতের মালা ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করে।
“আম্মী, ঈদ এ কোন জামা দিবা? আব্বু কবে আইব?’, ছোট্ট তনভীরের প্রশ্নে আমিনার চোখ ভিজে আসে। অবুঝ শিশুদের কি বোঝাবে! এরা,মহামারী,ভাইরাস …কি বুঝবে! আসন্ন ঈদের আনন্দে মশগুল। আমিনাও ভাবে এ কয়দিনে যদি সব ঠিক হয়ে যায়।ক’দিন হল ,তার মিঞার কোন খবর নেই। আশংকাকে মাথা চাড়া দিতে চায় না সে।
টিভিতে খবর দেখছিল রুমানা,বিশাল ঝড় আছড়ে পড়বে। চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী গ্রামে তাদের বাড়ি। বাড়িটাও যদি না থাকে তো……..আশংকায় কেঁপে ওঠে। ভাইবোনদের মধ্যে সে-ই বড়,আব্বার অনুপস্থিতিতে তাকেই সামলাতে হয়। কোথায় ঈদ –এর প্রস্তুতি নেবে…না এখনই সব বিপদ আসতে হয়! ‘হে আল্লা,রক্ষা কর’, মনে মনে প্রার্থনা করে। তাকে চিন্তান্বিত দেখে ভাইবোনেরা বলে, “ কি হইছে আপি?” রুমানা মাথা নাড়ে, তাদের ভীত করতে চায় না। আল্লা নিশ্চয় এতটা কঠোর হবে না। নিশ্চয়,এবার ও ঈদ ভালই কাটবে।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসে সবাই আশা করে,সব বিপদ কাটিয়ে আবার সুন্দর , আনন্দময় হয়ে উঠবে, এই ধরিত্রী।
মৌসুমি ভট্টাচার্য, ওমান
২৪শে মে ২০২০