মহাসপ্তমীর দিনে সকাল থেকে ময়মনসিংহের এধার ওধার দৌড়াদৌড়ির কারণে শরীর থেকে যেন অগ্নি নিঃসরণ হচ্ছে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ এখন দ্বৈত ঋতুতে পরিণত হয়েছে। মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে আছে বার বার ফোন দিয়েও কাবেরী কে পাচ্ছি না । এমন সময় ফোন টা ভো ভো শব্দ করে জানান দিল আমাকে তোমার আঁটোসাঁটো পকেটে হতে মুক্ত করো।
ফোনটা তুলতেই মনের সমস্ত বিরক্তি দূর হয়ে গেল।
‘আমার প্রেজেন্টেশন শেষ, লাঞ্চের জন্য সবাই ওয়েট করছে’ বলল কাবেরী। আমি বললাম ‘এখন দুপুর ২টা ২০ বাজে ২ টা ৩০ এ একটা গাড়ি আছে, এরপরের গাড়ি সন্ধ্যা ৭টা ৩০ এ’ ও (কাবেরী) বলল, ‘আমি এখনই যাবো, আমি আসছি।’
আমি দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে রেস্ট হাউসের পাওনা চুকিয়ে কাবেরীকে নিয়ে ছুটলাম টাউন হল মোড়ে। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘায়িত না করে বাস এসে থামল আমাদের সামনে। প্রচণ্ড গরমে বাসে উঠতেই ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় পেলাম। কাবেরী তো বলেই উঠলো, ‘উফফ যাক বাবা বাঁচা গেল।’ দুজনেই একটু স্বস্তিবোধ করলাম যে অবশেষে পূজা উদযাপন করার জন্য বাড়ি যেতে পারছি।
তড়িঘিড় করে বাসে ওঠার সময় খেয়াল করিনি, এবার খেয়াল করলাম বাসটিতে যাত্রী অনেক কম। সর্বোচ্চ ৬ থেকে সাতজন হবে।
এমন সময় যাত্রীসিটে বসে থাকা কর্পোরেট সাজে সজ্জিত হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিতা রমনীর দিকে দৃষ্টি পড়তেই মেয়েটির স্মিত হাসি , আর আমার মূখে বিশ্রী অভিব্যক্তি ফুটে উঠল । পেটের চর্বিগুলো পার্শ্ববর্তীনির দুই আঙ্গুলের নিস্পেশনেই এই অভিব্যপ্তির কারণ।
আমাদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে কাছে এসে হূমায়ুনীয় মহিলা হিমু মুখে ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বলল, ‘আমি কি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি।’ আমি থতমত খেয়ে বললাম ‘ইয়ে মানে’। এবার মেয়েটি স্নিগ্ধ মুখে বললো ‘আমি এই বাসের সুপারভাইজার আপনাদের সমস্যাগুলো সমাধান করা আমার দায়িত্ব।’
আমি আমার দেশের কোথাও কোনো রোডে বাস সুপারভাইজার হিসেবে কোনো নারীকে আর দেখিনি । ভাবলাম দিন বদলে যাচ্ছে, নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে , মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে, নারীকে নারী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখছে। মানুষগুলো তাহলে সত্যিই মানুষ হয়ে যাচ্ছে।
বাস ছুটে চলছে মধুপুরের অরন্য চিড়ে। দুই পাশের গভীর বন মনে সব সময় শঙ্কা তৈরি করে। এক অদৃশ্য অনুভূতি যেন শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সুনসান বনের নিরবতা ভেঙে গেল মানুষের স্থায়ী পদচারণায় ।
অতঃপর পৌঁছে গেলাম মধুপুরে । কাবেরী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জল পিপাসার কথা বলতেই আমি এদিক ওদিক অস্বস্তি নিয়ে তাকাতেই সেই স্নিগ্ধ মুখ আবারো বলে উঠলো ‘ক্যান আই হেল্প ইউ’। আমি অস্বস্তি নিয়ে জলের কথা বলতেই তিনি বাসে রাখা একটি পানির বোতল নিয়ে আমাদের দিলেন। জ্যাম পেরিয়ে বাস যখন ফুড ভিলেজে পৌঁছালো তখন প্রায় রাত ৮ টা । সুপারভাইজার তার সুমিস্ট কন্ঠে আমাদের জন্য অবশ্য করণীয়গুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করলেন। আমরা ডিনার কমপ্লিট করে আসার পর আবার বাস চলতে শুরু করল। এবার শরীর ভারী থাকায় অল্পক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রা চলে এলো।
চারদিকে গাঁ ছম ছম পরিবেশে আমাদের বাসখানা গহীন অরণ্য অতিক্রম করেছে । হঠাৎ গাড়ির সামনে দুটি মোটরসাইকেলে ০৫ জন আরোহী রিভলবার তাক করে বাসটি থামাল। আমরা ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছি যেন নিঃশ্বাসের শব্দও যেন না শোনা যায়। ছয় সাতজন যাত্রী দেখে ওরা যারপরনাই হতাশ হলো। সামান্য কিছু অর্থ আর কাবেরীর একটি চেইন নিয়ে নিতান্ত বিরস বদনে ডাকাতদল যখন নেমে যাচ্ছিল তখন একজনের কুৎসিত ইঙ্গিতে সবাই সুপারভাইজারের দিকে তাকালো। এবার রিভলবারের মুখে মেয়েটিকে নিয়ে নিচে নেমে গেল এবং ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বাধ্য করল। বাস প্রায় আধঘণ্টা চলার পরও আমরা দেখলাম একই জায়গায় বাসটি দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে নরম হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে গেলে দেখি আমার সারা শরীর ভিজে এবং পাশে দাঁড়িয়ে সেই সুপারভাইজার । বললেন, ‘আপনারা গোবিন্দগঞ্জে চলে এসেছেন’। ভাবলাম কি দুঃস্বপ্নটাই না দেখছিলাম। আমরা তড়িঘড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে সুপারভাইজারের সহযোগিতায় নেমে আসার আগে তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার নামটাই তো জানা হলো না।
মেয়েটি জানালো তার নাম রূপা। আমি মনে মনে বললাম আমিও তো হুমায়নীয় রূপাই ভাবছিলাম। ছোঁয়া পরিবহন লেখা সম্বলিত বাসটি আমাদেরকে রেখে চলে গেল পরবর্তী গন্তব্যে।
গোবিন্দগঞ্জ থেকে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য আবার বাসের অপেক্ষা করছি । যাত্রী ঠিক করে দেওয়া বাসের এক দালাল এসে জিজ্ঞেস করল ‘কোথায় যাবেন’ ? আমরা গন্তব্য বলার পর আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বললেন ‘কোথা থেকে আসছেন’ ? বললাম ময়মনসিংহ।
তিনি বললেন ‘কোন বাসে আসছেন’ আমি বললাম ছোঁয়া পরিবহন। এবার তিনি সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন ‘ছোঁয়া পরিবহনের বাসতো বন্ধ তাছাড়া যখন চালু ছিল তখনও সেটা বগুড়া পর্যন্ত আসতো’ তখন আমার সিরাজগঞ্জের রূপা খাতুনের কথা মনে পড়লো আদালতের বিচারের অসন্তুষ্টি নিয়ে কি রূপার অতৃপ্ত আত্মা ছোঁয়া পরিবহনের বাস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
শরতের ঠান্ডার মধ্যেও চিপ বেয়ে ঘাম নেমে আসলো ......
সঞ্জিত চন্দ্র পণ্ডিত, বাংলাদেশ
ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল
ডাক অধিদপ্তর, ঢাকা
২৪শে মে ২০২০
ফোনটা তুলতেই মনের সমস্ত বিরক্তি দূর হয়ে গেল।
‘আমার প্রেজেন্টেশন শেষ, লাঞ্চের জন্য সবাই ওয়েট করছে’ বলল কাবেরী। আমি বললাম ‘এখন দুপুর ২টা ২০ বাজে ২ টা ৩০ এ একটা গাড়ি আছে, এরপরের গাড়ি সন্ধ্যা ৭টা ৩০ এ’ ও (কাবেরী) বলল, ‘আমি এখনই যাবো, আমি আসছি।’
আমি দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে রেস্ট হাউসের পাওনা চুকিয়ে কাবেরীকে নিয়ে ছুটলাম টাউন হল মোড়ে। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘায়িত না করে বাস এসে থামল আমাদের সামনে। প্রচণ্ড গরমে বাসে উঠতেই ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় পেলাম। কাবেরী তো বলেই উঠলো, ‘উফফ যাক বাবা বাঁচা গেল।’ দুজনেই একটু স্বস্তিবোধ করলাম যে অবশেষে পূজা উদযাপন করার জন্য বাড়ি যেতে পারছি।
তড়িঘিড় করে বাসে ওঠার সময় খেয়াল করিনি, এবার খেয়াল করলাম বাসটিতে যাত্রী অনেক কম। সর্বোচ্চ ৬ থেকে সাতজন হবে।
এমন সময় যাত্রীসিটে বসে থাকা কর্পোরেট সাজে সজ্জিত হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিতা রমনীর দিকে দৃষ্টি পড়তেই মেয়েটির স্মিত হাসি , আর আমার মূখে বিশ্রী অভিব্যক্তি ফুটে উঠল । পেটের চর্বিগুলো পার্শ্ববর্তীনির দুই আঙ্গুলের নিস্পেশনেই এই অভিব্যপ্তির কারণ।
আমাদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে কাছে এসে হূমায়ুনীয় মহিলা হিমু মুখে ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বলল, ‘আমি কি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি।’ আমি থতমত খেয়ে বললাম ‘ইয়ে মানে’। এবার মেয়েটি স্নিগ্ধ মুখে বললো ‘আমি এই বাসের সুপারভাইজার আপনাদের সমস্যাগুলো সমাধান করা আমার দায়িত্ব।’
আমি আমার দেশের কোথাও কোনো রোডে বাস সুপারভাইজার হিসেবে কোনো নারীকে আর দেখিনি । ভাবলাম দিন বদলে যাচ্ছে, নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে , মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে, নারীকে নারী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখছে। মানুষগুলো তাহলে সত্যিই মানুষ হয়ে যাচ্ছে।
বাস ছুটে চলছে মধুপুরের অরন্য চিড়ে। দুই পাশের গভীর বন মনে সব সময় শঙ্কা তৈরি করে। এক অদৃশ্য অনুভূতি যেন শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সুনসান বনের নিরবতা ভেঙে গেল মানুষের স্থায়ী পদচারণায় ।
অতঃপর পৌঁছে গেলাম মধুপুরে । কাবেরী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জল পিপাসার কথা বলতেই আমি এদিক ওদিক অস্বস্তি নিয়ে তাকাতেই সেই স্নিগ্ধ মুখ আবারো বলে উঠলো ‘ক্যান আই হেল্প ইউ’। আমি অস্বস্তি নিয়ে জলের কথা বলতেই তিনি বাসে রাখা একটি পানির বোতল নিয়ে আমাদের দিলেন। জ্যাম পেরিয়ে বাস যখন ফুড ভিলেজে পৌঁছালো তখন প্রায় রাত ৮ টা । সুপারভাইজার তার সুমিস্ট কন্ঠে আমাদের জন্য অবশ্য করণীয়গুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করলেন। আমরা ডিনার কমপ্লিট করে আসার পর আবার বাস চলতে শুরু করল। এবার শরীর ভারী থাকায় অল্পক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রা চলে এলো।
চারদিকে গাঁ ছম ছম পরিবেশে আমাদের বাসখানা গহীন অরণ্য অতিক্রম করেছে । হঠাৎ গাড়ির সামনে দুটি মোটরসাইকেলে ০৫ জন আরোহী রিভলবার তাক করে বাসটি থামাল। আমরা ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছি যেন নিঃশ্বাসের শব্দও যেন না শোনা যায়। ছয় সাতজন যাত্রী দেখে ওরা যারপরনাই হতাশ হলো। সামান্য কিছু অর্থ আর কাবেরীর একটি চেইন নিয়ে নিতান্ত বিরস বদনে ডাকাতদল যখন নেমে যাচ্ছিল তখন একজনের কুৎসিত ইঙ্গিতে সবাই সুপারভাইজারের দিকে তাকালো। এবার রিভলবারের মুখে মেয়েটিকে নিয়ে নিচে নেমে গেল এবং ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বাধ্য করল। বাস প্রায় আধঘণ্টা চলার পরও আমরা দেখলাম একই জায়গায় বাসটি দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে নরম হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে গেলে দেখি আমার সারা শরীর ভিজে এবং পাশে দাঁড়িয়ে সেই সুপারভাইজার । বললেন, ‘আপনারা গোবিন্দগঞ্জে চলে এসেছেন’। ভাবলাম কি দুঃস্বপ্নটাই না দেখছিলাম। আমরা তড়িঘড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে সুপারভাইজারের সহযোগিতায় নেমে আসার আগে তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার নামটাই তো জানা হলো না।
মেয়েটি জানালো তার নাম রূপা। আমি মনে মনে বললাম আমিও তো হুমায়নীয় রূপাই ভাবছিলাম। ছোঁয়া পরিবহন লেখা সম্বলিত বাসটি আমাদেরকে রেখে চলে গেল পরবর্তী গন্তব্যে।
গোবিন্দগঞ্জ থেকে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য আবার বাসের অপেক্ষা করছি । যাত্রী ঠিক করে দেওয়া বাসের এক দালাল এসে জিজ্ঞেস করল ‘কোথায় যাবেন’ ? আমরা গন্তব্য বলার পর আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বললেন ‘কোথা থেকে আসছেন’ ? বললাম ময়মনসিংহ।
তিনি বললেন ‘কোন বাসে আসছেন’ আমি বললাম ছোঁয়া পরিবহন। এবার তিনি সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন ‘ছোঁয়া পরিবহনের বাসতো বন্ধ তাছাড়া যখন চালু ছিল তখনও সেটা বগুড়া পর্যন্ত আসতো’ তখন আমার সিরাজগঞ্জের রূপা খাতুনের কথা মনে পড়লো আদালতের বিচারের অসন্তুষ্টি নিয়ে কি রূপার অতৃপ্ত আত্মা ছোঁয়া পরিবহনের বাস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
শরতের ঠান্ডার মধ্যেও চিপ বেয়ে ঘাম নেমে আসলো ......
সঞ্জিত চন্দ্র পণ্ডিত, বাংলাদেশ
ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল
ডাক অধিদপ্তর, ঢাকা
২৪শে মে ২০২০