হেমন্তের বেলা শেষ। অমৃত বসে আছে দাওয়ায়। দিনের ক্ষীন আলোর রেখার মতো তার মনটা আজ। স্ত্রী এসে লিকার চা দিয়ে গেল। একে লিকার ,তার উপর খালি চা! অমৃতের একেবারে অরুচি। কিন্তু উপায় নেই।
স্ত্রী কে এখন কিছু বললেই ঘ্যান ঘ্যান করে উঠবে। অগত্যা চায়ের কাপে চুমুক দিতেই কাপটা হাতে তুলে নিল। স্ত্রী ব্যাগ হাতে নিয়ে এসে বলল -
-অখন তো বাজারে যাইবা না কিতা? ঘরে কিন্তু চা পাতা থিক্কা ধইরা কিচ্ছু নাই।
এই ভয়টাই করছিল অমৃত। পকেট একেবারে শূন্য। মাত্র পঞ্চাশ টাকা আছে। এই বাজারে এই কয়টা টাকা কিচ্ছু না। কিন্তু কি করবে সে! এমনটা অন্তত পূজোর পর কখনো হয়নি। প্রতি বছর দুর্গা পূজার পর ঘরে আসে প্রতিদিন মাছ , মাংস। দেওয়ালীর আগে ছেলের, বৌয়ের পোশাক আসে নতুন। কিন্তু এবার সব ফাঁকা।
অমৃত নামী ঢাকী। এই তল্লাটে তার বেশ ঢাকের বাজনায় নাম ডাক। বংশ পরম্পরায় তাদের পেশা ঢাক বাজানো। অমৃতের পিতা জনার্দন ছিল এই শহরের সেরা ঢাক বাদক। শহরের ছোট বড় সব পূজো - পার্বনে জনার্দই ছিল আসল আকর্ষণ। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। জনার্দন ও নাই আর ঢাকের প্রতি মানুষের আকর্ষণ ও নাই। এখন অনুষ্ঠান মানেই ডি . জে. , আর সিন্থেসাইজার এর যুগ। প্রাচীন কালের ঢাক প্রায় অচল। তাই সব ঢাকীরাই সিন্থেসাইজার নিয়েছে, কিন্তু ব্যতিক্রম অমৃত। তার ঐ এক কথা ঢাক ঢোলের সাথে অন্য কিছু থাকলে ঢাকীর মান কোথায়? আমরা জাত ঢাকী, পোশাকি ঢাকী না!
স্ত্রীর কর্কশ স্বরে অমৃত সম্বিত ফিরে পেলো - কিতা ভাবতাছ? যাইবা তো, না কিতা?
- হঅ যাইতাছি।
- ঘরে কিন্তু একবারেই কিচ্ছু নাই।
- হুমম।
অমৃত পথ চলতে চলতে ভাবছে - দুর্গা পূজা গেল, কালী পূজা গেল কিন্তু একটা টাকা নাই হাতে। অবশ্য থাকবে কি করে? কাজ পেলে তো। একে তো চারদিকে মহামারী ,দুর্গা পূজা, কালী পূজা তেমন ঘটা করে কোথাও হয়নি। তার উপর যে ও বায়না দিয়ে গিয়েছিলো দুর্গা পূজার একটা ক্লাব, কিন্তু বিকেলে এসে ক্লাবের একদল টাকা ফেরত নিয়ে নিলো -
- সিন্থেসাইজার ছাড়া হবে না। টাকা ফেরত দিন। আমরা ডি. জে. আনবো।
তারপর আর কেউ আসেনি । অমৃত ভাবে -পূজা যেমনই হোক , জমজমাট গান বাজনা, মদের আসর , নাচ এসব না হইলে পূজার মজা আর কই!
সে দিশেহারা, কি করবে ? কখনো মনে হয় - ঢাক আজকে অচল! অখন সংসার টা পথে বইছে , শেষ পর্যন্ত কি জুতা সেলাই করতে হইব? জনার্দনের পুলা অখন পথে বাইয়া জুতা সেলাই করবো! যা তার চৌদ্দ পুরুষ করে নাই! উপায় নাই । ছেলেটা ও এই বয়সে কতো ভালা বাজায় কিন্তু...... !
এসব ভাবতে ভাবতে অমৃত কিছু বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখে ছেলেটা ঢাক বাজাচ্ছে। চিৎকার করে উঠে অমৃত -
- বন্ধ কর্ ,বন্ধ কর এই বাজনা।
-ওমা, কিতা আইল বাবা? আমি তো ঠিকই ঐ
বাজাইতাছি, ভুলতো বাজাই নাই।
- ঢাক বাজাবি না কইতাছি, এই বাজনা আমার অখন বিষ লাগে।
- ওমা, কিতা অইল, পুলাডারে বকতাছ ক্যান্?
- যে ঢাক পেটে ভাত দেয় না, তার বাজনা
আমার বিষ লাগে। অখন ঢাক ছাইড়া জুতা সেলাই করুম পথে পথে।
এবার নিতাই মুখ খুলে - পূজার আগে কতো কইলাম, বাবা সাথে একজন সিন্থেসাইজার নিয়া নেও কিন্তু তুমি...।
- তুই চুপ কর। আমার বাপ, ঠাকুরদা কেউ...
- পুলা তো ঠিকই কইছে, বাপ ঠাকুরদা লইয়া বইয়া থাকলে আমরার পেট চলতো না। অখন যুগ বদলাইছে। যুগের লগে তাল মিলাইয়া চলতে আইবো।
- মা আমি সুদীনদার লগে কথা কইছি। অখন থিক্কা আমি সুদীনদার সিন্থেসাইজার এর লগে ঢাক বাজামু। হেরার অনেক কাজ।
- নিতাই চুপ কর, চুপ কর নিতাই!
- নিতাই ঠিক কথা কইছে, যা বাপ আমি তরে কইতাছি, তুই যা। আর কত পরম্পরা লইয়া না খাইয়া কাটামু যা বাপ যা।
- মা!
অনুমতি পেয়ে নিতাই আনন্দে আত্মহারা। অমৃতের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কিন্তু কি করবে সে? সময়ের কাছে বড়োই নিরুপায় আজ সে। চারদিক কেমন অন্ধকার করে আসে। মনে হচ্ছে বাবা সামনে দাঁড়িয়ে ঢাক বাজাচ্ছে। বাবার শরীরে পাঁচ টাকা, দশ টাকার কতো নোট গাঁথা। সবাই ঢাকের তালে শরীর দোলাচ্ছে । ভাবতে ভাবতে এই অন্ধকার ঘরে বসে পরলো ঢাকটা জড়িয়ে ধরে । শুরু হল লোডশেডিং। এই অন্ধকারে অমৃত কি যেন খুঁজতে লাগলো পাগলের মতো।
- গণেশ দেবরায়, খোয়াই
২৮শে মার্চ ২০২১