দীর্ঘ রোগভোগের পর বিদ্যাসাগর প্রয়াত হলে দেশের সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। শুধু এদেশেই নয়, বিদেশের পত্রপত্রিকাতেও শোক সংবাদ প্রকাশিত হয়। বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এত শোকসভা আহুত হয়েছিল যে তা সংখ্যায় প্রকাশ করা অসম্ভব। কলকাতা শহরে তো বটেই, মফ:স্বল বর্ধমান, হুগলি, শ্রীরামপুর, ঢাকা, আসাম, গৌহাটি, বরিশাল, ত্রিপুরা, কুচবিহার প্রভৃতি নানা শহরে; এমনকি হায়দ্রাবাদ শহরেও গভীর শোক পালিত হয়েছিল। কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের ছাত্ররা শোক পালন করেছিল পাদুকা ত্যাগ করেছিল। তারা খালি পায়েই বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করে। অর্থাৎ বিদ্যাসাগর আপামর সাধারণ মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে সমকালে বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। সারা দেশজোড়া যাঁর এত নামডাক, সেই তিনি কি না বনবাসীদের সাথে অবলীলায় মিশেছেন ! উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবর্ণীয়দের বিরুদ্ধে চিরকালীন অভিযোগ যে তাঁরা সমাজের প্রান্তজনদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেন। বিদ্যাসাগর সেসব প্যারাডাইম ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন। সমাজের উপরতলায় যেমন ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত, তেমনই সমাজের প্রান্তিক মানুষদের মধ্যেও সমান স্বাচ্ছন্দে বিরাজ করতেন। অথচ তাঁর জীবনের এই অংশটি খুব বেশি আলোচিত নয়।
নারী শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের দ্বারা বিদ্যাসাগর ততদিনে সারাদেশের যুগপুরুষে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু ক্রমে কলকাতা তাঁর কাছে হয়ে উঠেছে অসহ্য । শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে তিনি সাঁওতাল পরগণার বন জঙ্গলে পরিবৃত কর্মাটাঁড়ের এক নিভৃত স্থানে গৃহ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। এখানে এসে তাঁর জীবনে যেন এক নতুন জগৎ উন্মোচিত হয়। কলকাতার শিক্ষিত উচ্চবর্ণীয় ভদ্রলোকেদের গণ্ডির বাইরে অশিক্ষিত সহজ সরল সাঁওতালদের মধ্যে তিনি বাস্তবিকই প্রাণ খুঁজে পেয়েছিলেন। তাদের সরল ও অকৃত্রিম ব্যবহারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কলকাতায় যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। ক্রমে থাকতে থাকতে এই সাঁওতালরাই হয়ে ওঠে তাঁর পরম আত্মীয়। কেউ তাঁকে দাদা, কেউ বাবা, কেউবা জ্যাঠা বলে সম্পর্ক পাতালেন। তবে এই প্রান্তবাসীদের দুর্দশা দেখে বিদ্যাসাগরের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। নানাভাবে তিনি তাদের সাহায্য করতে শুরু করেন। যেমন প্রতি শীতেই হতদরিদ্র সাঁওতালদের অকাতরে চাদর, কম্বল বিতরণ করতেন; না খেতে পাওয়ারা তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত খাবার তো পেতেন-ই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল কারও কিছু প্রয়োজন হলেই তাঁর কাছে গিয়ে নিঃসংকোচে তারা হাত পাততো। তিনিও হাতের সামনে যা থাকত, অকাতরে বিলিয়ে দিতেন। প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণকালে সাঁওতালদের বাড়িতে খোঁজ নিতে যেতেন কে কেমন আছে। কেউ অসুস্থ হলে তো কথাই নেই। সব কাজ ভুলে লেগে পড়তেন শুশ্রূষায়। নিজে হাতে তাদের মুখে ওষুধ ঢেলে দেওয়া থেকে শুরু করে, শয্যাশায়ী রোগীদের মলমূত্র ত্যাগেও সহায়তা করতেন।
কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের বাড়ি ছিল সাঁওতালদের অবারিত দ্বার। তারা এসে যেমন নানা বিষয়ে আব্দার করে যেত, তেমনই ইচ্ছে হলে দলবদ্ধ হয়ে এসে পরিবেশন করত চিরাচরিত নিত্য গীত। এভাবে তিনি প্রান্তবাসীদের সুখে দুঃখের শরিক হয়ে ওঠেন। কলকাতার যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃতির কোলে থাকা মানুষদের সাথে একাত্ম হয়ে যান। অশিক্ষিত সাঁওতালদের পেয়ে ক্রমে তিনি শহরের শিক্ষিত বড় বড় মানুষদের সাথে মেলামেশা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। একবার কবি হরিশচন্দ্রকে বলেছিলেন, " পূর্বে বড় মানুষদের সহিত আলাপ হইলে, বড় আনন্দ হইত, কিন্তু এখন তাঁহাদের সহিত আলাপ করিতে প্রবৃত্তি হয় না। সাঁওতালদের সহিত আলাপে আমার প্রীতি। তাহারা গালি দিলেও আমার তৃপ্তি। তাহারা অসভ্য বটে, কিন্তু সরল ও সত্যবাদী।" একথা শুধু বলার জন্য বলাই নয়, তিনি এই তথাকথিত অশিক্ষিত ও বর্বর মানুষদের যতটা বিশ্বাস করতেন , ততটা শহরবাসী তথাকথিত ভদ্রলোকদের নয়। বাস্তবে সমগ্র এই জঙ্গলমহলই হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রকৃত আবাসস্থল; আর সেখানে বসবাসকারী সাঁওতালরা নিকটাত্মীয়।
জীবনের উপান্তে এসে এই কর্মাটাঁড়ই হয়ে ওঠে তাঁর কর্মক্ষেত্র। তিনি ব্রত করলেন এই অশিক্ষিত মানুষগুলিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে। যে মানুষ সারাটা জীবন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন, সে এই প্রান্তিক স্থানে এসে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন কি করে? অতএব যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ - ওই প্রান্তিক এলাকাতেও সাঁওতালদের শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় গড়ে তুললেন। তিনি যেমন নিজের সব কিছু সাঁওতালদের উজার করে দিয়েছিলেন, তেমনি ওই অভাবী মানুষরাও তাঁকে দিয়েছিলেন অকৃত্তিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। প্রায় প্রতিটা দিন তারা কিছু না কিছু জিনিস নিয়ে আসত তাঁর বাড়িতে। যেমন একবার জনৈক এক সাঁওতাল একটি মোরগ নিয়ে আসে তাঁকে দেওয়ার জন্য। বিদ্যাসাগর তা দেখে হেসেই বললেন, " আমি ব্রাহ্মণ, মোরগ লই কি করিয়া ?" এই কথা শুনে সেই সাঁওতাল মানুষটি শিশুর মত কেঁদে ফেলে। বিদ্যাসাগর তাকে নিরাশ না করে মোরগটি গ্রহণ করেন। তখন সেই ব্যক্তির আনন্দের আর সীমা থাকে না।
বিদ্যাসাগরের সাথে সাঁওতালদের আত্মিক সম্পর্কের আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হল। তিনি তাঁর ঘরের চাবি পর্যন্ত অবলীলায় তাদের দিয়ে দিতেন। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে তারা বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে বাক্স আলমারির তালা খুলে প্রয়োজনের জিনিস নিয়ে যেত। ফলে তাঁর ওপর তাদের এক অধিকারবোধও জন্মেছিল। একবার এক সাঁওতাল তার এক আত্মীয়াকে নিয়ে আসে বিদ্যাসাগরের কাছে। কারণ সেই সাঁওতাল রমণীর পরিধেয় বস্ত্র ছিল না। সেকথা বিদ্যাসাগরকে জানাতে তিনি একটু মজা করার জন্যই বললেন, " কাপড় নাই। আর ওকে দিব কেন ? " সেই সাঁওতালটিও নাছোড়বান্দা। সে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে জোর করেই কাপড় নেবে বলে মনস্থির করে। তারা জানত যে বিদ্যাসাগর তাদের জন্য কলকাতা থেকে কাপড় সহ নানা জিনিসপত্র এনে রাখতেন। সে বলে, " দে তোর চাবি। চাবি খুলে সিন্দুক দেখবো।" বিদ্যাসাগর তার হাতে সিন্দুকের চাবি তুলে দেন এবং সে তালা খুলে একটা ভালো কাপড় নিয়ে এসে সেই রমণীকে দেয়। এসব ঘটনা তাঁর মতো দানপুরুষের কাছে খুবই সাধারণ ও তুচ্ছ হলেও সেই হতদরিদ্র আদিবাসীদের কাছে তা ছিল অনেক বড় বিষয়। কারণ ইতিহাস বলে - বাঙালি মহাজন, সাউকাররা অশিক্ষিত ও সরল সাঁওতালদের নানাভাবে প্রতারিত ও শোষণ করে নিঃস্ব করেছিল বলেই তো তারা একদিন গর্জে উঠেছিল - সেই প্রেক্ষিতে তারা চোখের সামনে দেখল এক বাঙালি দানবীরকে। নবজাগরণের কুশীলবদের মধ্যে একমাত্র বিদ্যাসাগরই প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে মিশে গিয়েছিলেন এবং এভাবেই তিনি তাদের দেবতায় পরিণত হয়েছিলেন।
ড. রাজর্ষি বিশ্বাস
কোচবিহার
আরশিকথা হাইলাইটস
২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২১