Type Here to Get Search Results !

রূপং দেহি " ... সময়ের আলোকে মধুমিতা নাথ এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ ত্রিপুরা

"আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি

পূজার সময় এল কাছে

মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই

আনন্দে দুহাত তুলি নাচে..."


সময় গড়িয়ে চলে। চিত্রপট খুব একটা বদলায় না। কোভিডের থাবায় জীবনযাত্রা দীর্ঘদিন অস্বাভাবিক থাকার পর বর্তমানে কিছুটা যেন গা-সওয়া ভাব। কোভিড আছে , আরও থাকবে হয়তো। অনুমান করা হচ্ছে পুজোর পর প্রকোপ বাড়তেও পারে। তাই বলে আনন্দে খামতি থাকবে কেন ! মধু বিধুর মত অনেকেই আনন্দে ছুটাছুটি করছেন।

উচ্চবিত্ত আমীরদের মধ্যে ছোঁক ছোঁক রয়ে গেছে। চলাফেরায় , সামাজিক মেলামেশায় যথেষ্ট সাবধানতা। কেনাকাটা অনলাইন।  ভিড় এড়িয়ে চলাই বাঞ্ছনীয়। মধ্যবিত্ত সচ্ছলদের মধ্যে ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি ভাব। সামাজিক মেলামেশায় কিছুটা সচেতন , তবে তার চেয়ে বেশি সচেতনতা অপরকে সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে। মাস্ক পরিধান করে দোকানে দোকানে যাচাই , দরদাম এবং ঘন ঘন স্যানিটাইজার হাতে মেখে পোশাক বাছাই চলছে , পুজো শেষ হওয়া পর্যন্ত চলবে হয়তো বা। বাড়ি ফিরে ডেটল জলে স্নান আর রাস্তায় ভীড়ের জনতার উদ্দেশ্যে কটূক্তি। "মানুষের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই ... সব রাস্তায় নেমে গেছে ... এত ভিড় করার কি আছে বাপু... " ইত্যাদি ইত্যাদি। বেমালুম ভুলে যান যে তিনিও ওই ভিড়ের অংশ ছিলেন।

নিম্ন মধ্যবিত্তরা ওভার স্মার্ট। মাস্কখানি থুতনিতে ঝুলিয়ে দিব্যি ঠেলাঠেলি করে ভিড়ের মধ্যেই সেরে নিচ্ছেন কেনাকাটা। পছন্দের পোশাকের দামটা কমিয়ে দেওয়ার জন্য দোকানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তর্কে জুড়ে যাচ্ছেন। তীব্র গরমে ঘেমে নেয়ে একসা। মাস্ক দিয়েই কপালের ঘাম মুছে অন্য দোকানে যাচ্ছেন। হয়তো সেখানে পছন্দ না হলে আবার একই দোকানে ফিরে আসছেন।

এই তিন রকমের বাইরে যারা আছেন তারা নির্বিকার , অন্তত কোভিড নিয়ে। একটাই আফসোস , পুজো এসে গেল কিন্তু আগের মত কাজ পাওয়া যাচ্ছে না।

অনেক অভাব-অভিযোগ , রোগ-শোক টানাপোড়নের মধ্যেও আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির। বাতাসে ছুটির গন্ধ। যে যার মত করে দেবী আবাহনে ব্যস্ত। ছোট আকারে হলেও ক্লাবগুলিতে সাজসজ্জার খুটখাট , সঙ্গে যখন তখন সুরেলা সমবেত কন্ঠে বাজে "রূপং দেহি , জয়ং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষো জহি’৷ হে মহিষাসুরমর্দ্দিনি! আমরা রূপ চাই , জয় চাই যশ চাই , আমাদের শত্রুদের নাশ চাই। 

রূপের জন্য পার্লারে ছুটি । কেউ অসুন্দর থাকতে চাই না। সাধ্যমত সুন্দর পোশাকটি চাই। চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত অপরূপ রূপের প্রত্যাশায় যাবতীয় মালিশ পোলিশ কসমেটিক্স কত কি ! জয়ের জন্য প্রতিযোগিতায় নামি । খেলায় জিততে চাই , পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর চাই , ভোটে জিততে চাই , শ্রেষ্ঠ শিরোপা চাই। যশের পেছনে ছুটতে গিয়ে যত্রতত্র জ্ঞান জাহির করি । সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখি , মঞ্চে উঠি , নিজের ঢাকে নিজেই কাঠি দিই। পরিমিত গন্ডিতে অপছন্দের মানুষগুলোকে শত্রু ভাবি। নিধনে অপারগ হয়ে মনে মনে তাদের মুণ্ডুপাত করি। কখনো প্রকাশ্য শত্রুতায়ও মেতে উঠি। হিংস্র হয়ে উঠি । শত্রুতা কখনো গন্ডি ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত হয়।  ক্রমাগত ইঁদুর দৌড়ে নিজেরা আছি , প্রজন্মকেও লিপ্ত রাখছি। ভাবতেও ভুলে যাই এই "রূপ" , "জয়" , "যশ" "দ্বিষ জহি" এর গূঢ় মহিমা।


মহাপুরুষদের ব্যাখ্যায় এই রূপ হলো স্বরূপ বা আধ্যাত্ম-রূপ। গূঢ় অর্থে আত্মা এক  জ্যোতির্ময় আনন্দঘন চিত্‍স্বরূপ৷ এই চেতনার রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার রূপের কামনা দেবী মায়ের কাছে। রোগ-শোক-জরা-স্বার্থপরতার প্রতিমূর্তি দেহকে ছাপিয়ে গিয়ে মানবের প্রকৃত স্বরূপকে খুঁজে পাওয়ার আকুল প্রার্থনাই হলো "রূপং দেহি ..."

মানব দেহ একটি আধার মাত্র। এই দেহকেই মানুষ 'সত্তা' ভাবতে শুরু করে দেয়। তাই কামনা বাসনা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি । মানব মনের রাজসিক বা তামসিক অহং বোধের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধে প্রকৃত সাত্ত্বিক অহং বোধের জয় প্রার্থনাই হল  "জয়ং দেহি ..."


জাগতিক অর্থে আমরা প্রত্যেকেই খ্যাতি চাই । জীবনে বেঁচে থাকার মূল চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিবশত জাগতিক খ্যাতির পেছনে ছুটতে থাকে। দেবী মায়ের কাছে প্রার্থনা সেই যশের যা আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন।

সব শেষে আমরা শত্রুর বিনাশ চাই।  মানুষের পাপপ্রবণ ষড়রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাত্‍সর্য হল আসল শত্রু। এই শত্রু বিনাশ করার অর্তিই হল  দ্বিষো জহি..."।


অতিমারী পৃথিবীকে অনেক বদলে দিয়েছে। চারদিকের হাহাকারের মধ্যেও মা এসেছেন  ।  পৃথিবী সুন্দর হোক। কাশবনে দোলা জেগে থাকুক , আকাশ হোক আরও স্বচ্ছ নীল , মায়ের কাছে প্রার্থনা তাই ---

" রূপং দেহি , জয়ং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষো জহি’'।


মধুমিতা নাথ, ত্রিপুরা

সহকারী প্রধান শিক্ষিকা, অভিনেত্রী, নাট্য পরিচালক, কবি


অতিথি কলাম

১১ই অক্টোবর ২০১

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.