Type Here to Get Search Results !

এসো মা লক্ষ্মী " ---- সুস্মিতা ধর, ত্রিপুরা

 কোজাগরী লক্ষী পূর্ণিমা। বাংলা জুড়ে মানুষ মাতবে দেবী লক্ষীর আরাধনায়। পরিবার সমন্বিতা মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো বাঙালির সবচেয়ে জনপ্রিয় পুজো এবং সর্বাধিক সর্বজনীন উৎসবও। আর উমার কৈলাশে ফেরার পর থেকেই বাংলা জুড়ে মানুষ মেতে ওঠে যে দেবীর আরাধনায়, যে দেবী পূজিতা হন প্রায় প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে তিনি হলেন সৌভাগ্য ও ধন সম্পদের  অধিষ্ঠাত্রী লক্ষীদেবী। মহিষাসুরমর্দিনীর আগমনে আনন্দময় হয়ে উঠেছিল ধরনী। জীবনের দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা ভুলে মানুষ মেতেছিল উৎসবের আনন্দে।  চিন্ময়ীর বিদায়ের বার্তা ভুলে মানুষ আবার মেতে  উঠে লক্ষী  দেবীর আরাধনায়, মেতে উঠে লক্ষীপুজোর উৎসব ও আনন্দে।


সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব এটি। ধন সম্পদের দেবী হওয়ায় বিভিন্ন মন্দির ছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে লক্ষী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গোৎসব শেষে চান্দ্র আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দেবী লক্ষীর আরাধনা করা হয়ে থাকে। মা দুর্গার কৈলাশ গমনের পরে আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমাকে কোজাগরী পূর্ণিমা বলা হয়। কেন এমন নাম?  

কোজাগরী শব্দের উৎপত্তি  "কো জাগতী" থেকে। যার আক্ষরিক অর্থ  "কে জেগে আছো?" হিন্দু পুরাণ মতে এই কোজাগরী পূর্ণিমার দিন দেবী লক্ষী মর্ত্যে আসেন এবং ভক্তদের আর্শীবাদ দেন। কথিত আছে যে এই তিথিতে যে ব্যাক্তি সারারাত জেগে থেকে দেবীর আরাধনা করেন দেবী তার বাড়িতেই প্রবেশ করেন এবং সুখ,সমৃদ্ধি, শান্তি প্রদান করেন।  বলা হয় যে এই তিথিতে বাড়ির দরজা সারারাত খোলা রাখতে হয় এবং জেগে থাকতে হয়। যার বাড়ির দরজা বন্ধ থাকে তার বাড়িতে দেবী প্রবেশ করেন না এবং সেখান থেকে ফিরে যান। দেবী এ ও বলেন যে ---"আজ  রাতে যে ব্যাক্তি জেগে থেকে পাশাখেলা করবে তাকে আমি ধনদান করব।" আসলে সারারাত জেগে থাকতে হলে এমনই কোনো উত্তেজনামূলক  খেলার প্রয়োজন যা শারীরিক কষ্ট কে ভুলিয়ে দিতে পারে। তাই বোধহয় এই দিনে পাশাখেলার প্রচলন। বনভোজন বা পিকনিক করার প্রথাও বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত  আছে। কেও কেও এই দিন পরের বাগানের ফলমূল চুরি করে রাত জেগে। উদ্দেশ্য সেই একটাই। সারারাত  না ঘুমিয়ে ধন - সম্পদের দেবী লক্ষীর কৃপালাভ করা।

আজকাল গৃহস্থের সুবিধের জন্যই হোক বা পুরোহিতের স্বল্পতার জন্যই হোক -- লক্ষী পুজো হচ্ছে সকাল থেকেই। কিন্তু  কোজাগরী লক্ষী পুজোর প্রকৃষ্ট সময় প্রদোষকাল।  অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে মোটামুটি দু ঘন্টা পর্যন্ত সময়। প্রদোষ থেকে নিশীথ অবধি তিথি থাকলেও প্রদোষেই পুজো বিহিত হয়। কিন্তু আগের দিন রাত্রি থেকে পরদিন প্রদোষ পর্যন্ত তিথি থাকলে পরদিন প্রদোষেই পুজো করা বিধেয়। 

  

বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণে লক্ষী দেবী আসেন বারে বারে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন সময়ে। অনেকেই সারা বছর বৃহস্পতিবার লক্ষীর পুজো করে থাকেন। এছাড়া শস্য সম্পদের দেবী বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতেও লক্ষী পুজো হয়। খারিফ শস্য এবং রবি শস্য ঠিক যে সময় গৃহজাত হয় তখনই বাঙালি মেতে ওঠে লক্ষীর আরাধনায়। তবে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষী পুজোই হল বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় লক্ষী পুজো।  গবেষকদের মতে বাংলার এই কোজাগরী লক্ষী পুজোর সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে কৃষি সমাজের প্রভাব।  তার প্রমাণ পাওয়া যায় পুজোর উপকরণ আর আচার অনুষ্ঠানে। 

কোজাগরী লক্ষী পুজোয় বাংলার ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি মুখরিত সন্ধ্যায় লক্ষীর আরাধনা হয়। তেমনি মহারাস্ট্রেও কোজাগরী পূর্ণিমায় ভক্তি সহকারে লক্ষী পুজো  করা হয়।  গুজরাটে ওই রাতে চাঁদের আলোয় ক্ষীর রেখে দেওয়া হয়। পরদিন তা খাওয়া হয়। গুজরাতিরা এই পার্বণে গরবা উৎসবও পালন করে। ওড়িশাবাসী মনে করে এই দিনটিতে কুমার কার্তিকের জন্ম। তাই তাদের কাছে এটি কুমার পূর্ণিমাও।

কোজাগরী লক্ষী পুজোয় নানান রূপে লক্ষীর আরাধনা করা হয়। মাটির তৈরি ছাঁচে   কাঠামোতে দেবী মূর্তি তৈরি করে পুজো করা হয়। বেতের ছোটো চুপড়ি বা ঝুড়িতে ধান ভর্তি করে তার ওপর দুটি কাঠের লম্বা সিঁদুর কৌটো লালচেলি দিয়ে মুড়ে দেবীর রূপ দেওয়া হয়। একে বলা হয় " আড়ি লক্ষী।" আবার কলার বাকলকে গোল করে কেটে নারকেলের কাঠি দিয়ে আটকিয়ে একে চোঙাকৃতি বানানো হয়। এরূপ নয়টি চোঙা কাঠের আসনের উপরে লক্ষীর পা অঙ্কিত আলপনার উপরে রাখা হয়। এতে পঞ্চ শস্য দিয়ে সর্বশেষে একটি শীষযুক্ত নারকেল রেখে লাল চেলি দিয়ে ঢেকে বউ সাজিয়ে লক্ষী কল্পনা করে পুজো করা হয়। এছাড়া লক্ষীর মুখ সমন্বিত পোড়া মাটির ঘটে চাল বা কখনো কখনো জল ভরে সেটিকে লক্ষী কল্পনা করেও পুজো করা হয়। অনেক বাড়িতেই পূর্ববঙ্গীয় রীতি মেনে সরার পটচিত্রে পুজো করা হয়।এই সরাতে লক্ষী, জয়া- বিজয়া সহ কয়েকটি বিশেষ পুতুলকে চিত্রায়িত করা হয়। লক্ষী সরাও হয় নানা রকম। যেমন ঢাকাই সরা,ফরিদপুরি সরা, শান্তিপুরী সরা ইত্যাদি। 

হিন্দুদের ধনসম্পদ,আধ্যাত্মিক ও পার্থিব উন্নতি, আলো, জ্ঞান, সৌভাগ্য,উর্বরতা,দানশীলতা সাহস ও সৌন্দর্যের দেবী হলেন লক্ষী।র্পেঁচক বা পেঁচা হল মা লক্ষীর বাহন। কেন?  ধান হল লক্ষীর প্রতীক। চাল,অন্ন,খাদ্যশস্য হল লক্ষীর প্রতীক। ধানক্ষেতের আশেপাশে থাকে ইদুর যারা ধানের ক্ষতি করে। আর পেঁচার খাদ্য হল এই ইদুর। গোলাঘর কে লক্ষীর প্রতীক বলা হয়। আর গোলাঘরের আশেপাশেই থাকে ইদুরজাতি। পেঁচা এই ইদুর দের খেয়ে খাদ্যশস্য কে রক্ষা করে। তাই এদিক থেকে পেঁচা  মা লক্ষীর বাহন হিসেবে যথার্থ মানানসই। আবার কারো কারো মতে কুৎসিত  পেঁচাকে বাহনরূপে রাখার মাধ্যমে দেবী লক্ষী বোঝাতে চেয়েছেন তাঁর আরাধনায় যারা থাকবেন দেবী তাদের সকল কুৎসিত মানসিক অবস্থাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে,  অন্ধকারকে আপন শক্তির মাধ্যমে বন্দি করে তাঁর ভক্তদের হৃদয় করে তুলবেন নির্মল ও প্রশান্ত। 


পুরাণে আছে সাগর মন্থন কালে দেবী লক্ষী সমুদ্র থেকে প্রকট হন। সাগর হলেন লক্ষী দেবীর পিতা।  তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া,শ্রী বিষ্ণুর সহধর্মিণী, তিনি সীতা,তিনি রাধা,তিনি মহাপ্রভুর সহধর্মিণী লক্ষীপ্রিয়া, তিনিই আবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী। শাস্ত্রে অষ্টলক্ষীর কথা আছে। দেবী লক্ষীর আটটি রূপ।এঁনারা হলেন -- আদিলক্ষী,ধনলক্ষী,ধান্যলক্ষী, গজলক্ষী, সন্তানলক্ষী,বীরলক্ষী,বিজয়ালক্ষী এবং বিদ্যালক্ষী। 

দেবী লক্ষী কোথায় অচঞ্চল হয়ে থাকেন? ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেবী নিজ পরিচয় দিয়েছেন --------" যে সকল গৃহে গুরু, ঈশ্বর, পিতামাতা, আত্মীয়, অতিথি, পিতৃলোক রুষ্ট হন, সে সকল গৃহে আমি কদাপি প্রবেশ করি না। আমি সে সকল গৃহে যেতে ঘৃণা বোধ করি,যে সকল ব্যাক্তি স্বভাবতঃ মিথ্যাবাদী,সর্বদা কেবল 'নাই'  'নাই' করে যারা দুর্বলচেতা এবং দুঃশীল। যে গৃহস্থ পরিজনের মধ্যে ধন এবং ভোগ্য বস্তুর সমান বিভাগ পূর্বক বিতরণ করেন, যিনি মিষ্টভাষী, বৃদ্ধপোসেবী, প্রিয়দর্শন, স্বল্পভাষী, ধার্মিক, জিতেন্দ্রিয়, বিদ্যা বিনয়ী, সংযত এমন ব্যাক্তি আমার কৃপা পেয়ে থাকেন।" 


শুধু অর্থ নয়, উন্নত চরিত্রও মানুষের অমূল্য সম্পদ। লক্ষী দেবীর কৃপা তারাই লাভ করেন যারা নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। যে শুদ্ধ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী তার গৃহে লক্ষী অচলা হয়ে অবস্থান করে।সকল নারীর মধ্যে যে শীল ও সদাচার আছে তার মাধ্যমেই তিনি প্রকাশিতা। কারণ  দেবী নিজেই বলেছেন --- " মম অংশে জন্ম ধরে নারী সমুদয় ---- অর্থাৎ  সমাজ - সংসারের সকল নারীই জন্মগ্রহণ করেছেন মা লক্ষীর অংশে । তাই যেখানে নারীদের প্রতি অবমাননা হয়, লাঞ্ছনা হয়, নির্যাতন হয় সেখানে দেবী লক্ষীর কৃপা বর্ষণ হয় না। 

পরিবারসমন্বিতা মহিষাসুরমর্দিনী মা দুর্গার নিরঞ্জনের পর কেটে গেছে কয়েকটি দিন।দোরগোড়ায় কোজাগরী লক্ষী পুজো।  দেবী লক্ষীর পুজোর মন্ত্র, পুষ্পাঞ্জলি, পুজোর আচার -- আচরণ, রীতি - নীতি সবকিছু ছাপিয়ে একটি কথাই আবাল- বৃদ্ধ - বনিতার  মুখে মুখে, মনে মনে উচ্চারিত হবে 

" এসো মা লক্ষী বসো ঘরে

আমার এ ঘরে থাকো আলো করে..."


সুস্মিতা ধর,পরিচালক

আরশিকথা গ্লোবাল ফোরাম


আরশিকথা হাইলাইটস

১৭ই অক্টোবর ২০২১


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. কোজাগরী লক্ষ্মী সম্পর্কিত উপস্থাপনা "এসো মা লক্ষ্মী" পাঠ করে লক্ষী পুজোর মাহাত্ম্য সম্পর্কে সম্যক অবগত হলাম। সমৃদ্ধ লেখা।

    উত্তরমুছুন