ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব শক্তিশালী ও সাংগঠনিক ক্ষমতায় বলিষ্ঠ ও একনিষ্ঠ সংগ্রামী পুরুষ দেশনায়ক সুভাষ চন্দ্র বোস ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও অদম্য মনোবলের অধিকারী অভিজাত ও ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ছোটবেলা থেকেই তিনি আর্ত-মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে ছিলেন । এটা ৺তার চরিত্রের একটা অসাধারণ গুণ। ৺তার জীবনী পাঠ করলে আমরা এরকম অনেক দৃষ্টান্ত ই পাই। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন দেশমাতৃকার শৃংখল মোচন ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন।
শিক্ষাজীবন : আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর পুত্র সুভাষ ছাত্র জীবন থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।
তার জন্মস্থান উড়িষ্যার কটক শহরে সেখানে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করার সময় তিনি বারবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। পরবর্তীকালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণীতে পাস করে আই সি এস পড়ার জন্য বিলেত যাত্রা করেন। আইসিএস পাস করে তিনি সরকারি চাকুরি গ্রহণ করলেও দেশমাতৃকার অমোঘ টানে সে চাকুরি পরিত্যাগ করেন,ও দেশে ফিরে আসেন।
কর্মজীবন ও আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন :
ভারতে ফিরে আসার পর থেকেই শুরু হয় তাঁর দেশ সেবার মহান ব্রত। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশ স্বাধীন করার কর্মযজ্ঞে। সুভাষ চন্দ্রের কর্মদক্ষতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা, অগাধ পাণ্ডিত্য ,বক্তৃতা ও নেতৃত্ব দেওয়ার অসামান্য দক্ষতা সকলকে অভিভূত করে। এই সময়ে বাংলাদেশের আরেক বরেণ্য নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সান্নিধ্যে সুভাষ চন্দ্রের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। সুভাষের জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বদানের বিস্ময়কর দক্ষতা দেখে ইংরেজ সরকার ভয় পেয়ে ৺তাকে কারান্তরালে নিক্ষেপ করেন। একবার, দুবার নয় জীবনে বহুবার তিনি দেশের জন্য কারাবরণ করেন।
সুভাষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ইংরেজরা কখনোই ভারতকে স্বাধীনতা দেবে না। তাই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর ফলে ইংরেজ সরকার এই ভেবে আতঙ্কিত হয় যে সুভাষ ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ শুরু হলে সরকার সুভাষচন্দ্র কে "ভারত রক্ষা আইনে "গ্রেফতার করে নেয়। ১৯৪০খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই কারাগারে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে ৺তাকে কলকাতায় নিজ বাড়িতে পুলিশি প্রহরায় অন্তরীণ রাখা হয়। অন্তরীণ অবস্থায় পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেন এবং কাবুলে পৌঁছান । কাবুল থেকে মস্কো হয়ে সুভাষচন্দ্র বার্লিনে উপস্থিত হন। সেখানে গিয়ে তিনি ভারত কে স্বাধীন করার জন্য জার্মানির সাহায্য প্রার্থনা করেন। বার্লিন বেতার থেকে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ভারতবাসীকে আহ্বান জানান। সেই সময়ই জার্মানির প্রবাসী ভারতীয়রা ৺তাকে "নেতাজি" সম্বোধনে ভূষিত করেন। তারপর থেকে তিনি বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছেই নেতাজি নামে পরিচিত হন ।
তিনি অনুভব করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেকোন দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা সহজ হবে, তাই পরবর্তী সময় তিনি জাপানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা মতো ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসু জাপানে উপস্থিত হন। সেই সময়ে প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানের হাতে বন্দী ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে একটি সেনা বাহিনী গঠন করে সুভাষচন্দ্র কে এর দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। যথারীতি দায়িত্ব গ্রহণ করে সুভাষচন্দ্র এই বাহিনীর নাম দেন ""আজাদ হিন্দ ফৌজ""। সুভাষ চন্দ্রের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও অনুপ্রেরণায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকগণ নতুনভাবে প্রেরণা লাভ করে ।সুভাষ সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলতেন, "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব"। ৺তার এই আপ্ত বাক্যটি আজও প্রতিটি দেশবাসীর অন্তরে পূজিত হয়। সিঙ্গাপুরেও সুভাষচন্দ্র স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করেন। ৺তার নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতে প্রবেশ করে এবং কোহিমা ও বিষেণপুর দখল করে স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পনা ছিল ইংরেজ কে পরাজিত করে দিল্লি দখল করা সৈনিকদের উদ্দেশ্যে তিনি "দিল্লি চলো" আহ্বান করে সমস্ত সৈনিক ও স্বাধীনতাকামী দেশবাসীর মনে অসম্ভব উন্মাদনা সৃষ্টি করেন। ধীরে ধীরে স্বাধীনতা লাভের ৺সিড়ি পথটি ও মসৃণ হচ্ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের ফলে সুভাষচন্দ্র পিছিয়ে আসতে ও অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তবে সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম এতটাই শক্তিশালী হয়েছিল যে ইংরেজ সরকারের ভীতির কারণ হয়ে পড়েছিল। ৺তার নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতীয় নৌ-বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল । সেনাবাহিনীর এই অসন্তোষ ব্রিটিশ সরকারকে ভীষণভাবে আতঙ্কিত করে তুলে।
দেশনায়ক সুভাষ চন্দ্রের সাহসিকতা, অদম্য মনোবল ও দেশপ্রেমের আদর্শ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন কে অনেকটাই সহজতর করেছিল।
ভারত সরকারের মতে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ই অগস্ট জাপান অধিকৃত ফরমোজা দ্বীপে বা বর্তমান তাইওয়ানের তাইহোকু বিমান বন্দরে এক বিমান দুর্ঘটনায় সকলের প্রিয় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছিল তবে তার মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পর থেকেই শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্র তত্ত্বের যা থেকে আজও বের হতে পারেনি ভারতবাসী সেজন্য তার মৃত্যু রহস্য আজও রহস্যই থেকে গেছে ।তা যাই হোক ভারতবাসীর মনে তাদের প্রিয় দেশনায়ক সর্বদাই পূজিত হবে।
আজ ১২৫ তম জন্মবার্ষিকীতে ৺তার প্রতি রইল এই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।
জয়তু বীর সেনানী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, তোমায় কোটি প্রণাম।
মণীষা গুপ্ত পাল, ত্রিপুরা
২৩শে জানুয়ারি ২০২২