Type Here to Get Search Results !

বিশ্ব জল দিবসে আমাদের অঙ্গীকার ঃ লীনা গাঙ্গুলি, ত্রিপুরা

পরিশুদ্ধ জলের গুরুত্বের উপর নজর দিতে এবং জলসম্পদ পরিচালনার জন্য একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে প্রতি বছর ২২শে মার্চ  বিশ্ব জল দিবস পালিত হয় ।জল নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যই এই দিন।VALUING  WATER এটিই এই দিনের মূল উপজীব্য ।

           এখনো পৃথিবীতে জল সহজলভ্য নয়।বিজ্ঞানীরা প্রায়শই সতর্ক করেন এই বলে যে,এমন একটা দিন আসছে যখন তীব্র জল সঙ্কটে পড়বে মানবজাতি। এছাড়া বিজ্ঞানীরা এটাও বলেন যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখা দেবে পানীয় জলের জন্য।  তেমন একটি দিন  কি আমাদের কাম্য?  অবশ্যই নয়। তাইতো আমরা উদযাপন করি  এই দিনটির, বছরে একদিন হলেও ভাবি   আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা। 
      

  ১৯৯২ সালে Rio de Jeneiro তে আয়োজিত Environment and Development সংক্রান্ত United nations এর বৈঠকেই প্রথম World Water Day র ভাবনা ভাবা হয় ।The United nations General assembly এই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং পরের বছর ১৯৯৩ সাল থেকেই ২২শে মার্চ দিনটিকে বিশ্ব জল দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয় ।  নিছক পালন নয়,একটি লক্ষ্যমাত্রা ও ধার্য হয় ।  ঠিক করা হয় দিনটির ফোকাস ।  ২০৩০ সালের মধ্যেই জল এবং জলের ব্যবহার নিয়ে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণতায় পৌছানো --- Water and Sanitation for all by 2030। অর্থাৎ একথা বলা যায় যে বিশ্ব জল দিবসের অঙ্গীকার হল --- সকলের জন্য সুরক্ষিত হোক জলের অধিকার এবং শৌচাগারের অধিকার। 
        

যখনই  আমরা  প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে   বাস্তুতন্ত্রের প্রতি অবহেলা করি  তখনই  তা ক্ষতি করে পরিবেশের। ঘটায় জলবায়ুর পরিবর্তন । এই পরিবর্তনের ফলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাছপালা, মাটি, নদী এবং হ্রদসমূহ। ফলস্বরূপ পৃথিবীতে বন্যা, খরা এবং জলদূষণের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা সমস্যা দেখা দেয় ।
          

জল মূল্যবান সম্পদ ।বিষয়টি শুধুমাত্র জলের মূল্য নিয়ে নয়,এর চেয়েও অনেক বেশি ।বিষয়টি পরিবার, খাদ্য, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি এবং বাস্তুতন্ত্রে জলের অবদানের সঙ্গে সম্পর্কিত ।  আসলে আপাতভাবে বিশ্ব জল সঙ্কট টা হয় তো বোঝা যায় না, কিন্তু চোখ কপালে উঠবে এটা জানলে যে আজও পৃথিবীতে দুই কোটির বেশি মানুষ সুপেয় জল থেকে বঞ্চিত থেকেই নিত্য দিনের জীবন কাটায়। বিশ্ব ব্যাপী 2.1 বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানীয় জলের পরিষেবা পায় না ।পরিশুদ্ধ পানীয় জল এবং স্বচ্ছতার অভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ।বিশ্ব জুড়ে সমাজ দ্বারা উৎপাদিত ৮০% এর বেশি নোংরা জল পুনঃশোধন বা পুনঃব্যবহারযোগ্য না করার ফলে তা আবার পরিবেশেই ফিরে যায় ।  বিশ্ব ব্যাপী কৃষি কার্যের জন্য বর্তমানে ৭০% জল উত্তোলন করা হয় ।  শিল্প ক্ষেত্রে মোট জলের ২০%, অবশিষ্ট ১০% গৃহস্থালির জন্য আর ১% এর কম জল পান করার জন্য ব্যবহার করা হয় ।


২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ৭০০ মিলিয়ন মানুষ জলের অভাবে স্থানচ্যূত হবেন ।২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা আনুমানিক দুই বিলিয়ন বৃদ্ধি পাবে এবং বিশ্ব ব্যাপী জলের চাহিদা আজকের চেয়ে ৩০% বেশি হতে পারে ।
         
এই জল সম্পদ রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম ।এই বছরের জল দিবস এর স্লোগান হল Ground Water, Making the invisible visible ।ভূগর্ভস্থ জল মাটিকে সাপোর্ট দিয়ে রাখে,তাই সমুদ্র মাটিকে গ্রাস করে ফেলতে পারে না ।এই ভূগর্ভস্থ জল কে দুষিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে ।মুক্ত বাতাস যেমন কোনো সীমানায় বাঁধা পড়ে না তেমনি ভূগর্ভস্থ জল ও দেশের সীমানার গন্ডি তে আটকে থাকে না, সে বয়ে চলে নিজের খেয়ালে,তাই সবাই কে মিলেই এর সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে ।
        
কিন্তু আমরা তো জ্ঞানপাপী ।এই যে এতগুলো কথা বললাম জলের গুরুত্ব নিয়ে, তা কিন্তু সবই আমরা জানি ।কিন্তু একটু ভেবে দেখুন দেখি বাস্তবে আমাদের ভূমিকা টা কেমন? আমরা নিজেরাই কিন্তু যথেচ্ছ ভাবে জলের অপচয় করে চলেছি নিত্যদিন । জলের মেশিন চালিয়ে ভুলে যাই,জল উপচে পড়ে নষ্ট হতে থাকে, আমাদের কোনো খেয়াল থাকে না ।আর একটা জিনিস খেয়াল করবেন সে গ্রামে হোক্ কি শহরে সাধারন মানুষের জন্য যে সর্বজনীন কল থাকে  তা বেশির ভাগ সময়ই হয়  ভাঙা থাকে নতুবা থাকে নষ্ট । এর থেকে অবিরাম জল বেরোতেই থাকে, এভাবেই জলের অপচয় হয় আমাদের চোখের সামনেই।  এ ক্ষেত্রেও আমরা চোখ বুজেই থাকি । আসলে আমরা সবই বুঝি,কিন্তু নিজেদের স্বার্থে আমরা সবকিছু ভুলে যাই।বিল্ডিং বানাবো বা ফ্ল্যাট বানাবো তখন টাকা খরচ করে জলাভূমি কে স্থল বানাই। কত জলাশয় এভাবে ভরাট হয়ে যাচ্ছে ।আমরা ছোটো থাকতেও যে পরিমাণ জলাশয় ছিল,সেগুলো এখন কোথায়?  সব কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে । এটা বাস্তব যে বর্ধিত জনসংখ্যার স্থান সংকুলানের জন্য জলাভূমি ভরাট করতেই হবে। কিন্তু আমরা কি পারিনা প্রত্যেকে তার নিজের বাড়িতে গাছ লাগাতে যাতে রক্ষা  পায় প্রকৃতির ভারসাম্য?  পারিনা কি ছোটো ছোটো বাড়িতে থাকতে যাতে ভরাট করতে না হয় জলাভূমি?  

 
         ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার দিল্লি গিয়েছিলাম ।প্রচন্ড গরম,জলপিপাসা পেয়েছিল,বাবা কে সেই প্রথম দেখলাম টাকা দিয়ে জল কিনতে ।আমি তখন অবাক হয়ে ভাবছিলাম জল ও টাকা দিয়ে কিনতে হয়?আর এখন প্রতিদিন টাকা দিয়ে জল কিনে পান করতে হয় ।অর্থাৎ আজকে যেটা অসম্ভব বা অবাস্তব মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে এটাই যে বাস্তবে রূপ পাবে না সেটা কেউ জোড় গলায় বলতে পারবে না ।সময় থাকতে না বুঝলে কিন্তু ভবিষ্যত প্রজন্ম কে বিপদে ফেলে যাবো।ভাবুন, ভাবতে হবে । তাই বিশ্ব জল দিবস এর এটাই লক্ষ্য হোক বিশ্বের জল সঙ্কট কে অতিক্রম করে এক জল সিঞ্চিত স্নিগ্ধ পৃথিবী গড়ে তুলতেই হবে আমাদের সবাই কে আর এই কাজ টা শুরু হতে হবে নিজেদের ঘর থেকেই,তবেই আসবে এই দিনটি পালনের যথার্থতা ।

প্রথমেই আমাদের মধ্যে যে ক্ষুদ্র স্বার্থ সমন্বিত চিন্তা গুলি অদৃশ্য অবস্থায় আছে সেগুলো কে একটু ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। নিজের স্বার্থ, নিজের চাওয়া পাওয়ার সাথে সাথে একটু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথাও ভাবতে হবে।  নতুবা বিশ্ব জল দিবসে পোস্টার বানিয়ে, ভিডিও বানিয়ে, সোস্যাল মিডিয়া তে প্রচার করে, লোগো বানিয়ে, টি শার্ট বানিয়ে যতই মুখে মুখে প্রচার করি না কেন ,নিজেরা ঠিক না হলে  এগুলো প্রচারসর্বস্বই থেকে যাবে, বাস্তবে কোন কাজে আসবে না।তাই ভাবুন, ভাবনা টা কে কাজে রুপ দিন,এটাই হোক আজকের এই বিশ্ব জল দিবস এর অঙ্গীকার ।


লীনা গাঙ্গুলি, ত্রিপুরা


আরশিকথা অতিথি কলাম
২২শে মার্চ ২০২২
 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.