Type Here to Get Search Results !

কবিতা জীবনযুদ্ধের মিছিলের ব্যানার হেড ও প্রেরণাঃ হাওড়া থেকে প্রদীপকুমার পাল

"খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে?" কিম্বা "ভোর হল দোর খোল খুকুমণি ওঠো রে"... এই সব ছড়া কবিতার লাইনগুলো শৈশবে গুরুজনদের মুখে শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। চিরকালীন এই সব সৃষ্টি মানুষের মুখে-মুখে থেকে যাবে, যতদিন পৃথিবী থাকবে। এই কবিতাই যৌবনে প্রেমিক-প্রেমিকার রূপ বর্ণনার তুরুপের তাস, আবার সংসার জীবনে জীবনযুদ্ধের মিছিলের ব্যানার হেড এবং মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের মুখে স্লোগান। 

       লেখক বার্ণাড শ কবিতার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, "মানুষ যা কথায় প্রকাশ করতে পারে না, তা প্রকাশ করে গানে, আর গানেও যার প্রকাশ সম্ভব নয়, তা প্রকাশ করে  কবিতায়।"


       আদিম গুহামানব তখন গুটিকয়েক শব্দ সৃষ্টি করে অপার বিস্ময়ে দেখতো তার পরিপার্শ্বকে। একদিন জানা অজানা শব্দের মৌলিক ছবি এপাশ ওপাশ সাজিয়ে চাইলো মনের আকুলিবিকুলি ভাবের খেলা সাজিয়ে নিতে। চাইলো গুহার দেয়াল ইচ্ছে মাফিক সাজাতে। অবাক এ কী সৃষ্টির অরূপ রতন! কবিতা মুচকি হেসে বললো আমাকে চেনো কি? তোমার মনে, তোমার ভাবনায় ঘুমিয়ে ছিলাম জেগে উঠেছি! অরণ্যানী-বৃক্ষছায়া, ফুলেল-লতা, বর্ণিল গুল্মের ঝোঁপ আকুল-ঝর্ণা-বহতা-নদী-সুরধুনী আকাশ-মাখা-নীলে সজ্জিতা ধরিত্রী শুধুই নয়, এ যে নন্দনকানন! কবিতা এখানে মৃদুল ছন্দে পরমানন্দে নৃত্যপরা ললিত লবঙ্গলতিকা! পৃথিবী বদলায় প্রকৃতি-সভ্যতা বদলায়, বদলায় মানুষ। বদলায় মানুষের মনন চিন্তন অনুভবের জটিল ব্যাকরণ। কবিতাও অস্তিত্বের হেরফেরে কেবলই বদলে যায় নিত্য। তবু কালজয়ী সৃষ্টি যা অনন্তকালের পরিধিতে অমরত্বে উজ্জ্বল তা দিগন্তের এখানে-ওখানে-সেখানে চিরন্তনের সাক্ষর রেখে যায়। কবিতার কোনও সীমানা নেই। কবির কোনও নিজস্ব দেশ নেই, কাল নেই। সারাটা পৃথিবী জোড়া কবিতার মানচিত্র। আর সেই মানচিত্রে যখনই যেখানে দ্রোহ, প্রেম, বিপ্লব, প্রতিবাদ কিংবা মানুষের ন্যায়সঙ্গত দেনাপাওনার, মিলনের অভিব্যক্তি শৈল্পিক সৃষ্টিতে কবি প্রত্যয়ে প্রকাশ করেন, তখন তা সারা বিশ্বের জনগণের সম্পদ হয়ে ওঠে। পাবলো নেরুদা পশ্চিম গোলার্ধের কবি হয়েও তাই পূর্ব গোলার্ধের আমাদেরও কবি। রবীন্দ্রনাথ তাই বিশ্বকবি। তাই কালিদাস, শেক্সপিয়ার সকলের কবি। অনুন্নত ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের দাবি যথার্থ উন্নত ভাষার কবিদের উজ্জ্বল সৃষ্টির সংস্পর্শে এসে প্রাণ পায়।তাই দাবি উঠলো রাষ্ট্রসঙ্ঘে একটা বিশেষ দিনকে 'বিশ্ব কবিতা দিবস' হিসেবে উদযাপনের জন্য স্থির করতে হবে। বিশেষ করে আমেরিকা এই প্রস্তাব উত্থাপন করে।


১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো “To give fresh recognition and impetus to national, regional and international poetry movements” -- এই মর্মে ২১ মার্চ দিনটিকে "World Poetry Day" হিসাবে ঘোষণা করে। এর উদ্দেশ্য হল পৃথিবীব্যাপী কবিতাপাঠ, রচনা, প্রকাশনা ও শিক্ষাকে উৎসাহিত করা। ইউনেসকোর অধিবেশনে এই দিনটিকে ঘোষণা করার সময় বলা হয়েছিল, এই দিনটি বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কবিতা আন্দোলনগুলিকে নতুন করে স্বীকৃতি ও গতি দান করবে।


আগে অক্টোবর মাসে বিশ্ব কবিতা দিবস পালন করা হত। প্রথম দিকে কখনো কখনো পাঁচ অক্টোবর এই দিবস পালিত হলেও বিশ শতকের শেষভাগে রোমান মহাকাব্য রচয়িতা ও সম্রাট অগস্টাসের রাজকবি ভার্জিলের জন্মদিন স্মরণ করে  পনেরো অক্টোবর কবিতা  দিবস পালনের প্রথা শুরু হয়। অনেক দেশে এখনো অক্টোবর মাসের কোনো দিন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস পালন করা হয়। এই দিবসের বিকল্প হিসেবে অক্টোবর অথবা নভেম্বর মাসের কোনো দিন কবিতা দিবস পালনের প্রথাও চালু আছে। 


আজ বিশ্ব কবিতা দিবস। ২০২১ সালের ঠিক এমন দিনেই সামনে এসেছিল খবরটা। ‘অভিশাপ’ নামের একটি কবিতা ফেসবুকের দেয়ালে পোস্ট করেছিলেন কবি। কবিতাটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। কবিতাটি ধর্মে আঘাত দিয়েছে বলে অভিযোগ দায়ের করা হয় থানায়। কবির কিন্তু তাতে কোনও অনুশোচনা নেই।


কবি আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহর 'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি' কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি :


“জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,

কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।

যে কবিতা শুনতে জানে না

সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।

যে কবিতা শুনতে জানে না

সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

যে কবিতা শুনতে জানে না

সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।"


       বিশ্ব কবিতা দিবসে আজ নতুন করে ভাবতে  হবে কবিতাচর্চার প্রয়োজনের কথা। মানুষের হৃদয়-নন্দনবনে মানব মহিমার শতপুষ্পকে কবিতাই পারবে নব-নব রূপে বিকশিত করতে। বিশ্ব মানবিকতা কবিতার উচ্চারণে বিজয়ী হবে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা উচ্চারণ করে বলব, কবিতাই পারবে সেই মানব-পৃথিবীকে গড়ে তুলতে। আর সেখানেই বিশ্ব কবিতা দিবস পালনের সার্থকতা।

       আর কবিতা হয়ে উঠবে একদিন খেটে খাওয়া মানুষের মুখে প্রতিবাদের হাতিয়ার, জীবন যুদ্ধের সারথী। দরিদ্রের দুঃখের দিনবন্ধু হবে, সুখে হবে সখা, আঁধারে আলো হবে, আলোতে গানের পাখি-- সেদিনই স্বার্থক হবে অক্ষরের এই শৌখিন চাষ।



প্রদীপকুমার পাল

হাওড়া

২১শে মার্চ ২০২২

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.