"You' ve come a long day, baby --- চল্লিশের দশকে একটি সিগারেটের বিজ্ঞাপনের বিখ্যাত এই ক্যাচলাইনটি তৈরীই হয়েছিল মেয়েদের উদ্দেশ্যে।ভার্জিনিয়া স্লিমস এর সেই বিখ্যাত সিগারেটের প্যাকেটে ছবিও থাকত একটি মেয়ের। তার ঠোঁটে ছিল জ্বলন্ত সিগারেট। বোঝাই যায়, ক্রমাগত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা নারীবাদী আন্দোলন, নারী মুক্তি এবং বাইরের জগতে মেয়েদের ক্রমবিজয় -- এ সবের প্রেক্ষাপটেই জন্ম এই ধরনের শ্লোগানের। তবে সেটা ছিল এক পট পরিবর্তনের সময়। অন্দরমহলের অসূর্যস্পশ্যতা ভেঙ্গে নারী তখন ক্রমাগত পা রাখা শুরু করে চলেছিল আত্মপ্রকাশের প্রখর সূর্যালোকিত রাজপথে। তার চলার পথ কিন্তু মসৃণ ছিলনা মোটেও। সামনে বারবার পড়েছিল বন্ধ কপাট,উঁচু পাচিল, কখনও বা ভ্রুকুটি চোখে সুগম্ভীর পর্বত। তাতে কিন্তু বন্ধ হয়নি নারীর পত চলা। ভাবীকাল এগিয়ে নিয়ে গেছে তাকে হাত ধরে। নারীর পথ চলার, পথ চেনার সেই শুরু। ক্রমশ সে জিতে নিতে পেরেছে রথের রশির অধিকার।
নারী দিবস -- এটি হল দ্বিভুজা, দ্বিনয়নী মেয়েদের উৎসবের দিন। নারী দিবস মানে বছরে অন্তত একবার কুর্নিশ করা -- কাছের, দূরের, ঘরের, বাইরের সকল নারীদের। অভিবাদন জানোনোর দিন সেই সব নারীদের যারা তাঁদের সাধারণ স্ব- ভাবের বলে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে চলেছেন।
নারীর এই যে বিজয়যাত্রা, তার অন্যতম ভগীরথ হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি যদি তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে, সমস্ত শক্তি দিয়ে নারীশিক্ষা সম্ভব করে না তুলতেন তবে কোথায় থাকত নারীর এই বিজয়যাত্রা? কোথায় থাকত নারীর এই দ্বিগ্বিজয়? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই প্রথম যিনি মেয়েদের মন - শরীর সব কিছুর গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করার জন্য সহ্য করেছিলেন বহু লাঞ্ছনা, বহু গন্জনা। উনিশ শতকে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা শুধু বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের অন্দরমহলেই নয় জানালা এবং চিকের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়েছিল আরও অনেকেরই অন্দরমহলে। সেই ঝোড়ো হাওয়ায় নড়ে গেল মেয়েদের পরম্পরা নির্দিষ্ট জীবনযাত্রা। শিক্ষার সুযোগ,গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আর সামান্য সহানুভূতি --এই তিন পুঁজিকে সম্বল করেই পথচলা শুরু হল বাঙালী নারীদের।
অজস্র কাঁটা, অজস্র বাঁধা -- তার মধ্যেই এগিয়ে চলা। উনিশ শতকটাই ছিল এমন। বোধের জগত থেকে বুদ্ধির জগতে উত্তরণ। নিজের আয়নায় মুখ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল মেয়েরা । সাহস জোগালেন স্বামীজি। বললেন --" মেয়েরা তাঁদের নিজের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করবে।পুরুষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। " যাদের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় এগিয়ে এসেছিলেন তাদের পূর্ণরূপের আভাস লক্ষ্য করেই বোধহয় স্বামীজি বলেছিলেন এই কথাগুলো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রাজা রামমোহন রায় যে পথ তৈরী করে দিয়ে গিয়েছিলেন স্বামীজির বক্তব্যে সাহসী হয়ে অন্দরমহলের ঘেরাটোপকে দু - হাতে সরিয়ে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে বঙ্গললনারা এসে পড়লেন একবিংশ শতকে।
আজ একবিংশ শতকের নারীরা শিক্ষা - সংস্কৃতির চেতনায় আলোকপ্রাপ্তা। নারীসুলভ কমনীয়তা বজায় রেখেও সে আত্মবিশ্বাসী। আজ সে নগরবধূ নয়, নগর পথচারিণী। সরকারি দপ্তর থেকে ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট দুনিয়া, শিক্ষিকা থেকে বিত্তশালী উদ্যোগপতি --- সর্বত্রই এখন তার অবারিত দ্বার। ঘরে বাইরে পা রেখে চলেছে সে সমানতালে। নারীর শক্তিময়ী ব্যক্তিত্ব, বলিষ্ঠতা ও বীরত্বের জন্য দেবলোকেও তিনি আদৃতা। সিমোন দ্য বোভোয়ার একদা বলেছিলেন -- নারীদের অস্তিত্ব আপেক্ষিক। তার সেই কথাকে নস্যাৎ করে সমস্ত আপেক্ষিকতা কাটিয়ে আজ নারীরা অনেক দূর এগিয়ে আসতে পেরেছে --এটাই এখন চরম সত্য। তাদের পথে বাঁধা হয়ে আসা সমস্ত দুর্যোগকে যথাসাধ্য সু- যোগ করে নিতে পেরেছে, এখানেই তো কৃতিত্ব আজকের নারীদের, এখানেই তো অসাধারণত্ব তাদের।
চন্দ্রিমা চৌধুরী, ত্রিপুরা
আরশিকথা হাইলাইটস
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
৮ই মার্চ ২০২২
মেয়েরা এখন -- চন্দ্রীমা চৌধুরীর লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো। সমৃদ্ধ হলাম।
উত্তরমুছুন