পার্বতী কন্যা ত্রিপুরায় প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে জাতীয় উৎসব গড়ে ওঠে। গড়িয়া পূজা ত্রিপুরার বিশেষ কয়েকটি উপজাতিদের এক মহান গৌরবময় পূজা ও উৎসব । ত্রিপুরীদের সুপ্রাচীন পূজা উৎসব এটি। গড়িয়া দেবতা ত্রিপুরার পরম আরাধ্য দেবতা। সকলের বিশ্বাস গড়িয়া দেবতার আশীর্বাদ ব্যতীত জাগতিক কল্যাণ ,সুখ-শান্তি, ভোগবিলাস ও অস্তিত্ব সম্ভব নয়।
ত্রিপুরা রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে ত্রিপুরী ,রিয়াং, জমাতিয়া ,হালাম ও কুকিই হল প্রধান । রাজা-প্রজা সকলেই হলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও শিবভক্ত ।গড়িয়া পূজা মহাবিষুব সংক্রান্তি বা চৈত্রসংক্রান্তি থেকে আরম্ভ হয়ে বৈশাখের প্রথম সাত দিন ধরে উৎসব পালিত হয় ।এই পূজাকে শিব পূজা মতান্তরে গনেশ পূজা বলা হয়।
গড়িয়া পূজার এক সপ্তাহ পূর্বে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়ে থাকে ।ত্রিপুরীদের ভাষায় এই দিনটিকে হারিবিষু বলা হয়। ঐদিন প্রত্যুষে প্রথমে বিভিন্ন রকমের বনফুল বন থেকে সংগ্রহ করতে হয় ।এরপর হাতে কাটা সুতো দিয়ে মালা তৈরি করা হয় ।মালাতে জুমের তুলো ও দেয়া হয় । মালা তৈরি হয়ে গেলে গরু-মহিষের সামনের দুটো পা ধুয়ে ধূঁপধুনা দিয়ে তাদের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হয় ।হারি বিষু উপলক্ষে হাল চাষ ও বন্ধ রাখা হয়। এলাকার বয়োবৃদ্ধরা লাঙ্গা(বেতের তৈরী লম্বা ঝুড়ি) দা ,টাক্কাল নিয়ে বনে যান, নানা জাতের শিকড়,লতাপাতা ও ফল সংগ্রহ করতে।
যে কেওই ইচ্ছে করলে গড়িয়া পূজা দিতে পারেনা। গড়িয়া পূজার অধিকার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
পূজার দিন --- হারি বিশুর দিনে গড়িয়া পূজার ঘট বসানো হয় ।আর জমাতিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে পূজার প্রস্তুতি পূর্ব থেকেই শুরু হয় ।কোন গ্রামের কে মনোনীত হবেন তার তোড়জোড় চলে অগ্রহায়ন মাস থেকেই।গড়িয়া পূজা জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠিত হয় হারি বিষুর সাত দিনের দিনে। ত্রিপুরীসম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকে হারিবিষুর দিনে ঘট না বসিয়ে ,শেষ দিনে ঘট বসিয়ে পূজা দেয়। পূজার দিনে বাড়ির গৃহকর্তা প্রাতঃকালে পবিত্র বস্ত্র পরে বনে গিয়ে পাতা সহ একটি আস্ত কচি বাঁশ কেটে আনে।এই বাঁশটি পূর্ব বা দক্ষিন দিকে পুঁতে দেওয়া হয়। এটি সাধারনতঃ অচাইয়ের মতামত নিয়েই করা হয়।বাঁশের আগায় ফুল ও তুলার মালা, হাতে বোনা নূতন রিসাও ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বাঁশের গোড়ায় বাঁশের কাইম পুতে দেওয়া হয়। কলাপাতা বিছিয়ে বিভিন্ন রকমের ফুল ইত্যাদি রাখা হয়।বিন্নী ধানের খই ভেজে পাতার উপর দেওয়া হয়। ধূঁপধূনা দেওয়া হয়। মোরগ, বাচ্চামোরগ, ডিম গড়িয়া বাবার নামে উৎসর্গ করা হয়।
শুভ কাজে পূজা পার্বনে রিসার ব্যবহার আদিবাসী সমাজে এক পৌরানিক প্রচলিত প্রথা।পূজা কার্য যারা সম্পাদন করেন তাঁরা অচাই ও বারুয়া(পুরোহিতের সহকারী) নামে পরিচিত।অচাই ও বারুয়াকে মহান আদর্শ ও পবিত্রতা বজায় রেখে দেব পূজা করতে হয়।তাদের হতে হয় অতিশয় আচারনিষ্ঠ। তাদের আচারাদি সম্বন্ধে রাজমালায় লিখিত আছে।
"অভ্যক্ষ নাখায়ে তারা সুভক্ষ্য ব্যভর।।"
**********
নারীর রন্ধন তারা নাহি করে ভক্ষ্য।
নিত্য স্নান ধৌত বস্র আকাশে শুকায়।
আকাশে শুকাইয়া বস্ত্র পবিত্রে পেরয়।
স্বহস্তে রন্ধন করি ভোজন করয়।।
দেবতা পূঁজিতে ভক্তি তারা অতিশয়।"
*********
ত্রিপুরী ভাষায়,"অচাই বাতিমানির(পূজারজন্য আহ্বান)একটা বিশেষ নিয়ম আছে।
অচাই ও বারুয়া স্নান করে শুচি ও শ্বেতবস্ত্র পরে পৃজার কাজ করেন। গড়িয়া পূজা রন্ধক ও নকছুমতাইএর পর শুরু হয়। রন্ধক পূজা ভোর সাড়ে চারটার মধ্যে শুরু হয়। ইহার পর আসে নকছুমতাই।
নকছুমতাইয়ের পরে প্রায় ছয়টা নাগাদ গড়িয়া পূজা শুরু হয়।শেষ হতে প্রায় এক ঘন্টা লাগে।ঠিক পূজা শুরু হওয়ার আগে অচাই এসে দেখেন নৈবদ্যও পূজার আনুষাঙ্গিক জিনিষ গুলি ঠিক ঠিক জায়গায় বসানো হয়েছে কিনা।অচাই 'পাতকারনা'
করে পূজা শুরু করেন ।জগল্যা এসে উলুধ্বনি দেয়। 'পাতকারনা,'শেষ হলে অচাই মন্র আওড়ে গড়িয়া দেবের প্রতীক বাঁশে দেবত্ব দান করেন।ইহার পর আবার' পাতকারনা' করে দেখেন অচাই।
ফলাফল ভালো হলে মন্র আওড়ে মোরগ উৎসর্গ করা হয় গড়িয়া দেবের পাদমূলে,উৎসর্গের সময়
জগল্যা জগাল দেয়।গৃহস্বামী ও পরিবারের লোকজন সবাই এসে গড়িয়া দেবতাকে তাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানায়। উৎসর্গের পর মোরগের কয়েক ফোঁটা তাজা রক্ত, মাথা,গলার সামান্য মাংস কেটে গড়িয়ার পাদমূলে দেওয়া হয়।কিছুক্ষন পর মাথাগুলি ঘরে আনা হয়।
অচাই মোরগের পায়ু কেটে অন্ত্র বের করে দেখেন অন্ত্র ভাল অথবা ছেঁড়া কিনা। অন্ত্র ভাল হলে পূজার ফলাফল ভাল হয়।পূজা শেষ হলে মাংস ও মদ দিয়ে পূজার ভালো মন্দ ফলাফল জিজ্ঞাসা করেন,ঘরের মালিক বা "নকফাং"। একে ত্রিপুরী ভাষায় ছেমাছুংগ বলে।পূজার ফলাফল জিজ্ঞাসা করার সময় অচাইকে এক বোতল মদ ও লাঙ্গি দিতে হয়।এই মদ অচাই একা খান না। বারুয়া ,জগল্যা ও অন্যদেরও খাওয়ান।
পূজার ফলাফল জিজ্ঞাসা করার সময় মোরগের ডান পা অচাইকে এবং বাম দিকের মোরগের ডানা বারুয়াকে সিক্ করে মদের সঙ্গে খেতে দেওয়া হয়।পূজা শেষ হয়ে গেলে গড়িয়া দেবের প্রতীক বাঁশের ছায়া মাড়ানো অথবা পার হওয়া নিষেধ । কেও যদি পার হয় গড়িয়া দেবের কোপ দৃষ্টি তার ওপর পরে বলে তাদের বদ্ধমূল ধারনা। বিকেল প্রায় তিনটে থেকেই মোরগের ছানা ও ডিম দিয়ে গড়িয়া দেবের পা ধোয়ানো হয় এবং প্রণামী দেওয়া হয়।পা ধোয়ানোর পরে দেব ভক্তিতে মাতোয়ারা যুবক ও বৃদ্ধরা গড়িয়া দেবের প্রতীক বাঁশে বাঁধা রিসা (রীয়া) খুলে নেয়।
এতে কিছু জুমের তুলা,চাল, ধান ও ফুল মিশিয়ে তিনটি গিঁট দেয়। এবং একে কল(বর্শা) এর মধ্যে ঝুলিয়ে দিয়ে সেই কল কাঁধে নিয়ে দেব ভক্তিতে মাতোয়ারা যুবকরা খাম(ঢাক) এর তালে তালে গান গেয়ে গেয়ে নাচতে শুরু করে। নাচ শেষ হওয়ার পরমূহুর্তে সকলে বর বা আশীর্বাদ চেয়ে নেয়। ত্রিপুরী ভাষায় " বররিমানি "বলে।
আশীর্বাদ বা বর নেওয়ার সময় একটি থালার উপরে পবিত্র সাদা কাপড় ঢেকে, এতে দুই একটা রূপোর টাকা, ফুল ও তুলো রেখে দেয়।একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করে ---- "অ গড়িয়া ছেং করাক্" । তাদের মধ্যে যে কোন একজন " অই" বলে উত্তর দেয়। আবার বলে ---"তার ঘরে কি?" দ্বিতীয় জন উত্তর দেয়, -- "ধান দূর্বা।"
পূজা শেষে আশীর্বাদ গুলো যত্ন সহকারে ঘরে নিয়ে "খুতরুক"(খাড়ার ন্যায় বেত দ্বারা বোনা সিন্ধুক)এর ভেতরে রেখে দেন।খুতরুকের ভেতর রাখার সময় ঘরের মালিককে এই কথা বলে রাখতে হয় ---"হে গড়িয়া দেবতা আগমী বছরও যাতে তোমাকে এই ভাবেই পূজা দিতে পারি।" বরদাতারা যাওয়ার সময় ঘরের মালিককে---"তোমার পরিবারে সুখ শান্তি ,ধন আসবে",বলে বিদায় নিয়ে চলে যায়।গড়িয়ার প্রধান অংগ নাচ ,গান।এই নাচ গানের মধ্যে দিয়েই জনগণের আশা আকাঙ্খা,ব্যাথা বেদনা সব কিছু ফুটে উঠে। ত্রিপুরী, নোয়াতিয়া, কলই ও রিয়াং সম্প্রদায়ের গড়িয়া পূজার প্রথা ও রীতিনীতিতে তাই মিল দেখা যায় প্রায়ই।
পার্বত্য ত্রিপুরার বৈশিষ্ট্য তার প্রচলিত উৎসবেই পরিস্ফুট। ত্রিপুরাকে গভীরভাবে জানতে গেলে তার সংস্কৃতির পরিচয় জানতে হবে -- যা আমরা পাই এখানকার স্থানীয় উৎসবগুলিতে। ত্রিপুরার উপজাতিদের প্রধান উৎসব গড়িয়ার নাচ - গানের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠে তাদের সংস্কৃতির রূপরেখা। "বাবা গড়িয়া" আজ শুধু ত্রিপুরার উপজাতিদের আরাধ্য দেবতা নন, এই দেবতার চরণে ভক্তিভরে শ্রদ্ধা নিবেদন করে নিজের সুখ, নিজের সমৃদ্ধি কামনা করে আজ জাতি - উপজাতি নির্বিশেষে। "বাবা গড়িয়ার" আশীর্বাদকে পাথেয় করে সারা বছরের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা ভুলে নতুন আশায় বুক বাঁধে সকলে। গড়িয়ার নাচে - গানে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় জাতি - উপজাতির সংস্কৃতি, হয়ে উঠে এক মিলনমেলা।
জবা পাল দত্ত, ত্রিপুরা
আরশিকথা হাইলাইটস
২১শে এপ্রিল ২০২২