Type Here to Get Search Results !

ঐতিহাসিক ১৯মে ঃ ড. বিশ্বম্ভর মণ্ডল, পশ্চিমবঙ্গ

সারা বছর ধরে এখন চলছে বন্ধু দিবস, হাতি দিবস, বাবা দিবস, প্রেম দিবস, ভালোবাসা দিবস সহ কোন না কোন দিবস উদযাপন। এটা একটা সাম্প্রতিক ট্রেন্ড বলা যেতে পারে। আমাদের শৈশব, কৈশোর কেটেছে গুটি কয়েক দিবস উদযাপন করে। সময়ের সাথে সাথে এখন দিন বদলেছে। নতুন নতুন উপকরণ নিয়ে হাজির হচ্ছে সভ্যতা। কোন কিছুকে ছোট না করেও বলতে পারি "প্রাণের পরশ খুজে মরি, খুঁজে না পাই' অবস্থা অনেক সময় হচ্ছে। শয়ে শয়ে দিবস পালনের ভিড়ে নতুন প্রজন্মের কাছে না হারিয়ে যায় শ্রমিক দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পরিবেশ দিবস, ভাষা দিবসের মত অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে মর্যাদা পাওয়া দিনগুলোর গভীর তাৎপর্য । প্রসঙ্গান্তরে না গিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব শুধু বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে আসামের বাঙ্গালীদের এক ঐতিহাসিক অবদানকে । 

মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালির আবেগ মূলত দুটি দিনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে বছরের পর বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আর ১৯ মে । যদিও আগাগোড়াই ১৯ মের তুলনায় একুশে ফেব্রুয়ারির উদযাপন হয় অনেক বেশি সাড়ম্বরে । আর ইউনেস্কোর ঘোষণার পর বিগত কয়েক বছর ধরে তো পৃথিবী জুড়ে মাতৃভাষা দিবস উদযাপন হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি। ফলে অনেকটাই আড়ালে পড়ে গিয়েছে উনিশে মে। নয় নয় করে অনেক বছর হয়ে গেল ভাষা দিবস উদযাপনকে কেন্দ্র করে অনেক লেখা, পড়া, বক্তৃতা শোনা আর নানা রঙয়ের অনুষ্ঠানে জড়িয়ে থাকা । অনেক বাঙ্গালীর এটা জীবনচর্চার একটা অংশ হয়ে গিয়েছে। যদিও কখনো কখনো মনে হয়েছে কোন একটা অভ্যাসের বশবর্তি হয়ে যেন অধিকাংশ উদযাপনগুলো ঘটে চলেছে। অনেক বক্তার বক্তৃতা শুনলে মনে হয় চর্বিত চর্বন , মনে হয় যেন একই স্ক্রিপ্ট পাঠ কয়েক বছর ধরেই চলছে। লেখকদের অনেক লেখা পড়ে মনে হয় আগে কখনো পড়া হয়ে গেছে শব্দগুলো বা এই প্রসঙ্গ।। মাঝে মাঝে মনে হয় আজকের যুবক আজকের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার সঙ্গে ভাষাকে কেন্দ্র করে এই সব উদযাপনকে প্রাসঙ্গিক মনে করছেন তো আদৌ! এই রকম টানাপোড়েনের মধ্যেও কোথাও গিয়ে যেন একটা অনুভব কাজ করছে যে, বোধহয় আসামের ছেলেমেয়েগুলো যারা তাদের জীবনটাকে দিয়েছে মাতৃভাষাকে রক্ষার লড়াইয়ে তাদের কথা বোধহয় আরও বেশি করে জানানো দরকার মানুষের সামনে। 

 অনেকেই আছেন যারা গড়গড় করে বলে দিতে পারবে ১৯৫২র ২১শে ফেব্রুয়ারি কি হয়েছিল। বলে দিতে পারবে ৫ জন ভাষা শহীদের নাম, কিন্তু অনেকেই হয়ত চমকে ওঠেন যখন জানেন ঐ পাঁচ জন শহীদের একজন ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার ছেলে। সেই জনতার অনেকেই নিশ্চুপ হয়ে যান আসামের ভাষা শহীদদের সম্পর্কে কিছুই না জানার কারণে। এমনকি ১৬ বছরের সেই মেয়েটা কমলা ভট্টাচাৰ্য যে সারা পৃথিবীতে প্রথম নারী ভাষা শহীদ তার নামের সাথেও পরিচয় নেই বাংলা ভাষার দরদগাথা ছাপানো পাঞ্জাবীতে সজ্জিত মানুষটির। ওর বোন মঙ্গলার কথাও মনে নেই আমাদের অনেকের, যে মেয়েটা গুলি খেয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও সারাজীবন মানসিক পঙ্গু হয়ে বেঁচে ছিল। মাতৃভাষার জন্যে এগারোটা পরিবারের এই আত্মত্যাগ আড়ালে চলে যাওয়াটা একটু অবাকই লাগে। কারণ মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার জন্যে একসাথে এতো জন শহীদের বলিদান পৃথিবীতে আর কোন ভাষার জন্যে হয় নি।। মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে জীবনের সব থেকে মূল্যবান উপহার আসামের ১১ জন শহীদও (কমলা ভট্টাচাৰ্য, শচীন্দ্র পাল, হিতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, সত্যেন্দ্র দেব, কানাইলাল নিয়োগী, বিরেন্দ্র সূত্রধর, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ , সুনীল সরকার, কুমুদ দাস) দিয়েছেন । কিন্তু আর্ন্তজাতিক স্তরে তো দূরের কথা, জাতীয় স্তরেই স্বীকৃতি তেমন মিললো কোথায়! দেশবাসীর অনেকের কাহেই অজানা থেকে গেল আসামের লড়াই । যদিও অনেক ক্ষেত্রেই জন্মদিন, মৃত্যুদিন পালনের অনুষ্ঠানগুলো প্রায় ছুটি কাটানোর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বা মন-প্রাণহীন স্মরণ অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। মাতৃভাষার জন্যে উৎসর্গীকৃত আসামের শহীদদের অবদান ইউনেস্কোর দলিলে স্থান পাক বা না পাক ,  দেশবাসীর কাছে সেই সংগ্রামী ও উজ্জ্বল গৌরবের ইতিহাস যেন হারিয়ে না যায় সেটা খেয়াল রাখাটা জরুরী । আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবে থাকা এই সময়ে মাতৃভাষা চর্চার যাবতীয় ঐশ্বর্য লুট হয়ে যাচ্ছে দেখেও আমরা নির্বিকার চিত্তে যেন বসে না থাকি । যারা ভাবছেন ‘বাংলা জেনে হবে টা কি’, তাদের জেনে রাখা দরকার যে, মাতৃভাষায় জ্ঞান থাকলেই অন্য কোন ভাষায় দক্ষতা আনা অনেক সহজ হতে পারে –এটাই আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানীদের অভিমত। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে ১৯মে আসামের বাঙ্গালীদের আত্মবলিদান প্রচারের আলোয় কম থাকতে পারে, সরকারের কাছে মূল্যহীন মনে হতে পারে, তবে ইতিহাস মানুষকে এই শিক্ষাই বারেবারে দিয়েছে যে, দেশের মানুষের স্বার্থে কোন আত্মত্যাগ বিফলে যায় না ।


ড. বিশ্বম্ভর মণ্ডল,সহকারী অধ্যাপক

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ

ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট

১৯শে মে ২০২২

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.