Type Here to Get Search Results !

ভাষা আন্দোলনের বিস্মৃত দিন ‘১৯শে মে’ ঃ অগ্নিশ্বর সরকার, বর্ধমান


 নানা বৈচিত্রে ভরা বিপুলা এই পৃথিবী। ২০২২-এর মে মাসের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৭.৯ বিলিয়ন মানুষের বসবাস এই পৃথিবীতে, এর মধ্যে ৫০.৫% পুরুষ এবং ৪৯.৫% মহিলা। পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা প্রায় ৭১১১ (Living Language)। প্রত্যেক মানুষের জন্মের সাথে সাথেই প্রয়োজন হয় মনের ভাব প্রকাশের। প্রথমে হাত-পা দিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে প্রয়োজন হয় ভাষার। যে ভাষা প্রথম আমাদের কণ্ঠ থেকে মনের ভাব প্রকাশের জন্য নির্গত হয় তা হল মাতৃভাষা। মায়ের ভাষা। আমরা এই ভাষাতেই কথা বলতে সবথেকে স্বচ্ছন্দবোধ করি। মাতৃভাষা আমাদের জন্মগত অধিকার; কিন্তু যখন এই অধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন সংগঠিত হয় তখন তা পরিণত হয় ভাষা আন্দোলনে। হয়েছে প্রতিবাদ, ঝরেছে রক্ত, নিভেছে প্রাণ প্রদীপ। পরিশেষে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে মায়ের ভাষা। পৃথিবীতে ভাষা আন্দোলনের সংখ্যা প্রায় কুড়ি। বাংলা ভাষা আন্দোলন বললেই মনে পড়ে অধুনা বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক সেই আন্দোলনের কথা। সেই আন্দোলনকে স্মরণ করা হয় প্রতি বছরে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস হিসাবে। 

ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বের একটি রাজ্যেও সংগঠিত হয়েছিল একটি ভাষা আন্দোলনের। অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার প্রতিবাদে অসমের বরাক উপত্যকাতে দানা বেঁধেছিল এক আঞ্চলিক ভাষা আন্দোলনের, যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয়েছিল একটি বৃহৎ ভাষা আন্দোলনে। 

অসম মূলত দুটি নদ/নদীর অববাহিকা অঞ্চলে বিভক্ত। ব্রহ্মপুত্র ও বরাক। দুই অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে প্রভূত ফারাক লক্ষ্য করা যায়। যেহেতু রাজ্যের নাম আসাম, সুতরাং এখানকার মূল ভাষা বা দপ্তরিক ভাষা অসমিয়া হওয়াই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবের পরিসংখ্যান আলাদা কথা বলে। অসামের পাশেই আছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। অসমে প্রচুর বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। কেউ স্থায়ী বাসিন্দা আবার কেউ কর্মক্ষেত্রে ওখানে বসবাস করেন। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ।  ১৯৫৫ সাল থেকে অসমে বাঙালীদের ওপর অত্যাচার চরমে ওঠে। অসমিয়ারা সরকারপক্ষকে অসমিয়া ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার জন্য চাপ দিতে থাকে। 

১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে অসম প্রদেশ কংগ্রেস অসমিয়া ভাষাকে সরকারী ভাষা তথা একমাত্র দপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করে। 

এরপর থেকে শুরু হয় অসমিয়াদের বাঙালীদের প্রতি অত্যাচার। ধীরে ধীরে এই অত্যাচার সহিংসতার রূপ নেয়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বাঙালী পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নেন। প্রায় নব্বই হাজার বাঙালী অসমের উত্তর-পূর্বে বা বরাক উপত্যকায় পালিয়ে আসেন। অসমের পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়; এই জেলা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা। নয়জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক লোক আহত হয়।  ১০ অক্টোবর, ১৯৬০ অসমের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমিয়াকে অসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক শ্রী রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তীব্র বাদানুবাদের পর  ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়। অর্থাৎ অসমিয়া ভাষাকে সরকারী তথা দপ্তরিক ভাষা হিসাবে সিলমোহর দেওয়া হয়। শুরু হয় গণ-আন্দোলন। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে জন্ম হয় ‘কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ’ নামক সংগঠনের । এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারী ভাষা হিসাবে সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়ের। প্রথমে এরা রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের তাদের দাবি পেশ করেন।  ১৪-ই এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা ‘সংকল্প দিবস’ পালন করেন।  ২৪শে এপ্রিল থেকে ২রা মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় একটি দীর্ঘ পদযাত্রার। প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির প্রত্যেকটি গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন সদস্যরা। পদযাত্রা শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী শ্রী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করলেন, যদি ১৩ এপ্রিল,১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে-তে তারা ব্যাপক হরতাল করবেন। ১২ মে থেকেই সেনা কমান্ডে পরিচালিত আসাম রাইফেলস জওয়ানেরা শুরু করেন ফ্ল্যাগ মার্চ। সত্যাগ্রহের সমর্থনে ১৮ মে দুপুরে এক বিশাল মশাল মিছিল হয় শিলচর শহরে। তখনও সব কিছু ছিল শান্ত। ১৮ মে গ্রেপ্তার হন রবীন্দ্রনাথ সেন, নলিনীকান্ত দাশ, বিধুভূষণ চৌধুরীসহ ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা। ওই দিন রাত থেকেই হাজার হাজার মানুষ জড় হতে শুরু করলেন শিলচর স্টেশনে। গণসংগ্রাম কমিটির নেতা রবীন্দ্রনাথ সেনের পূর্ব ঘোষণা মতো ১৯ মে ১২ ঘণ্টার হরতালের শুরু হয়। শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। বিক্ষোভ শুরু হয় অসমের বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের সামনে। ১৮ই মে রাত থেকেই হাজার হাজার মানুষ জড় হতে শুরু করলেন শিলচর স্টেশনে। লক্ষ্য ছিল শিলচর স্টেশন দখল করে নেওয়া। কিন্তু তার বহু আগে থেকেই অসম পুলিশ, সি.আর.পি.এফ, অসম রাইফেলস, পি.এ.এস.সি জওয়ানরা স্টেশন চত্ত্বর দখল নিয়েছিল। ভোর থেকে কোনো টিকিট বিক্রি হয়নি। প্রথমে শুরু হয় অহিংস প্রতিবাদ। কিন্তু বেলা বারার সাথে সাথে আন্দোলনকারীদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। কিছু মহিলা আক্রমণ করে বসেন ষ্টেশনে থাকা পুলিশদের। শুরু হয় প্রতি আক্রমণ। পুলিশ গ্রেপ্তার শুরু করে। সত্যাগ্রহীদের ট্রাকে করে সরিয়ে দিতে থাকে। 

বেলা আড়াইতে নাগাদ ন'জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) দিকে অগ্রসর হল। ট্রাকটি জনতার ভিড়ে আটকে গেল তারাপুর স্টেশনের কাছে। উত্তেজিত জনতা ট্রাকটির উপর অগ্নিসংযোগ করে। যদিও দমকল বাহিনির তৎপরতায় সেই আগুন আয়ত্তে আনা হয়। ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছে।  ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর বন্দুক ও লাঠি চার্জ শুরু করে।  সাত মিনিটের ভিতর তারা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে বিনা প্ররোচনায় ১৭ রাউণ্ড গুলি চালায়। ১২টি গুলি সরাসরি আঘাত আহানে ১২জনের ওপর। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়ল ৯টি তাজা প্রাণ। আহতের নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। পরে মারা যান আরও ২জন।    কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম মহিলা শহীদ।  এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আরও ২৪ বছর বেঁচে ছিলেন কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস। কার্ফু জারি করল প্রশাসন। প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হল আন্দোলনকারীদের মৃতদেহ লোপাটের। যদিও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা সেই মৃতদেহগুলিকে নিয়ে শোক মিছিল করলেন।  এই ঘটনার পর আন্দোলনের ধাঁচ পালটে ফেলা হল। তখন আর সরকারী অফিসের সামনে ধর্ণা নয়, আন্দোলনকারীরা অফিসের তালা খুলতেই কর্মীদের চেয়ার দখল করে বসে পড়তেন সেখানে। ফলে সরকারী কাজ প্রায় স্তব্ধ হয়ে পড়ল। 

ঘটনা সামাল দিতে দিল্লি থেকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এলেন অসমে। শুরু হয় দফায় দফায় বৈঠক। শেষে শ্রী শাস্ত্রী গণ সংগ্রাম সংগঠনের সামনে একটি সমাধান সূত্র দেন যা ‘শাস্ত্রী ফর্মুলা’ নামে অভিহিত। যদিও সেই ফর্মুলা সংগঠন প্রত্যাখ্যান করে। জুন মাসে সরকার সমস্ত আন্দোলনকারীকে জেল থেকে মুক্ত করে।  শেষ পর্যন্ত অসম সরকার তাদের ১৯৬০ সালের ভাষা আইন পরিবর্তন করে করে, তাতে বলা হয়, বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা হবে সরকারি ভাষা। বাংলা ভাষাকে ব্যবহার সরকারীভাবে সমস্ত দপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা হয়। 

১৯৬১ সালের ১৯শে মে’র সেই গুলি চালনার বিচার আজ পর্যন্ত দূরে থাক, তদন্তও হয় নি। এমনকি ১৯ মের ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গঠিত বিচারপতি গোপাল মেহেরতরা কমিশনের রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয়নি। সেদিন নারকীয় ঘটনাকে অনেক ইতিহাসবিদ জালিওনয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সাথে তুলনা করে থাকেন। সেদিনের ভাষা শহীদদের জন্য তৈরি করা হয় কয়েকটি শহীদবেদী। শিলচর রেলওয়ে ষ্টেশনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ভাষা শহীদ ষ্টেশন শিলচর’। এই পর্যন্তই। ভাষা শহীদদের আত্মা আজও নীরবে বিচার ভিক্ষা করছে। শুধুমাত্র কিছু জেদী, একরোখা মানুষের আন্দোলন সরকারও স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হল বাংলা ভাষাকে। বন্দুকের নলের সামনে বুক চিতিয়ে মানুষ রক্ষা করল তাদের মাতৃভাষার সম্মান। বাংলা ভাষার মর্যদা রক্ষার এটা ছিল দ্বিতীয় সংগ্রাম।

যেকোনো জাতির উন্নতি সাধন হয় তাদের শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি-কৃষ্টির মধ্যে দিয়ে; আর এগুলোর মধ্যেই সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমই হল ভাষা। যদি সেই ভাষাই অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে তবে সেই জাতি এগোবে কীভাবে? আর ভাষার প্রতি ভালোবাসা না থাকলে সেই জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। ইতিহাস সাক্ষী আছে শাসক তাদের আক্রমানত্মক শাসনক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য প্রজাদের উপর অনেক কিছু জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। প্রজারা জোটবদ্ধ হয়ে রুখে দিয়েছে শাসকের এই খামখেয়ালীপনাকে। এই ভাষা আন্দোলনও সেই প্রতিবাদেরই অংশ। লাঠি আর বেয়োনেটের সামনে তৈরি হয়েছে গণ সংগ্রাম।  অসমের বরাক উপত্যকার বাঙালিরা আজও বঞ্চিত। উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য ছোট ছোট জনগোষ্ঠী পৃথক রাজ্য পেলেও বরাক থেকে দাবিটুকুও উঠছে না সেভাবে। জনসংখ্যার নিরিখে বরাক যদি পৃথক রাজ্য হয়, তবে সেটা হবে উত্তর-পূর্ব ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য। বরাকের লোকসংখ্যা ৪২ লাখেরও বেশি। আজও বরাক অপেক্ষায় আছে বাংলা ভাষা শহীদদের যোগ্য সম্মানের। 


তথ্যসূত্র :

১. উইকিপিডিয়া

২. প্রথম আলো (সংবাদপত্র)

৩. গুগুল ও ইন্টারনেট

৪. এই সময় (সংবাদপত্র)

৫.  Report of Non-Official Enquiry Commission on Cachar

৬. countrymeters.info



অগ্নিশ্বর সরকার, বর্ধমান

ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট

১৯শে মে ২০২২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.