দুপুর বারোটা। আমরা ক্লাস করে হোস্টেলে ফিরে এসেছি লাঞ্চ করতে। নীলু তখনও ঘুমোচ্ছে। পিঠের ওপর চিৎ হয়ে মাথাটা বালিশের একদিকে কাত করে। দুটো হাত দেহের দুপাশে সমান্তরাল। হাতের তালু সিলিঙের দিকে। নীলু ঘুমোচ্ছে। নীলুর তখন মাঝ রাত। ভোর চারটেয় ঘুমোতে গেছে উপন্যাসটা শেষ করে। নীলু বিখ্যাত তার ঘুমের জন্যে। শীতের সকালেও ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে, সব দাঁড় জানলা খোলা রেখে লেপ মুড়ি দিয়ে নীলু ঘুমিয়ে থাকে দুপুর পর্যন্ত। দুপুর থেকে শুরু হয় ওর সকাল।
উদো, মানে উদয়ন ভোর পাঁচটায় নিয়ম করে ওঠে। অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। বইমুখো। ডিপার্টমেন্ট ফার্স্ট। ফান্ডাবাজ। একটু ঘ্যাম আছে বৈ কি! নিজেই যেন একটা ঘড়ি। প্রতি ঘন্টা, প্রতি মিনিটের হিসেব একদম কষে রাখা আছে। রুটিনের বাইরে যায় না কখনোই। চোখে অনেক স্বপ্ন, আমেরিকা যেতে হবে।
ঘচা, ভালো নাম নিজেও বোধহয় ভুলে গেছে। বইপত্র দেখলেই রেগে যায়। তবু ক্লাসে যায়। সবাই যায় তাই ঘচাও যায়। কেন যায়, কি জন্যে যায় নিজেও জানে না। ক্লাসে গেলেই স্যাররা ওকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়। ও প্রতিবাদ করে না। গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে ক্যান্টিনে চলে আসে। ওর মতো কিছু চেনা মুখে তখন ধোঁয়া উড়ছে, না হয় চায়ের কাপ। ঘচা ওদের সঙ্গে বেঞ্চি বাজিয়ে গান ধরে - কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই...
ওই যে গিটার হাতে ছেলেটাকে ঘুরতে দেখছেন এদিক ওদিক। ওর নাম এলভিস প্রেসলি। বাবা-মার দেওয়া নাম অনির্বান আড়ালে চলে গেছে কলেজে আসার পর। গেল বছর ফেল করেছে। নির্বিকার। ইংরেজি গান গায়। আরো দু-একজনকে জুটিয়ে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। মাঠের মাজখানে বসে জিং-জ্যাং গিটার বাজিয়ে চিৎকার করে রক গায়।
আপাত দৃষ্টিতে এই চরিত্রদের সংমিশ্রনে একটাই জিনিস কমন। এরা সবাই ইঞ্জিনিয়ার হতে এসেছে। ভুল বললাম জয়েন্ট এন্ট্রান্সে নাম ঢোকানোর অপরাধে বাবা-মা এদের ইঞ্জিনিয়ার নামক ক্যারিয়ারে বন্দি করতে চেয়েছেন। অনেকেই বন্দি হয়েছে আবার অনেকেই হয়নি।
সেই সব চরিত্রদের মাঝে আমিও একটা। নিজেকে তো বাইরে থেকে দেখার সুযোগ পাই নি। তবুও মনে হতো আমি যেন একটা একঘেয়েমি চরিত্র। নিশুতি রাতে একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো একঘেয়েমি। চারিদিকে কালো রাতে একভাবে সেই ডাকের মতো একঘেয়েমি। থেকেও আলাদা করে নেই৷ যে নিয়ম করে দিনের শেষে বইখুলে পড়তে বসত । যে কিনা ক্লাস করতে করতে হঠাৎ হঠাৎ ক্লাস কেটে নন্দনে সিনেমা বা একাডেমিতে নাটক দেখতে যায়। শীতের সকালে সপ্তাহান্তে পড়াশোনা বন্ধ রেখে একটু ক্রিকেট খেলা। অন্যদের পাল্লায় পড়ে দিনে একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে চারটে, চারটে থেকে কখন একটা পুরো প্যাকেটটাই দুই ঠোঁটের নিচে পুড়ে ছাই করে দিত।
হোস্টেল জীবন। বাবা-মায়ের আঁচল বন্দি থাকার পর জীবনে যেন প্রথম মুক্তির স্বাদ। সেই মুক্তির আশায় জীবনে কারো প্রেম চাই। যেমন মশার। লিকলিকে চেহারায় হাওয়া দিলে গায়ের জামাটা কেমন পতপত করে ওড়ে। পাঁচ ফুট দুয়ের মশা প্রপোজ করে বেড়ায় অর্পিতা, কাবেরী, নীলাঞ্জনাদের। একটা না হলে আরেকটা - প্রেম যেন লটারির টিকিট। কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থ হয়েও মশার হার না মানা চরিত্র সবসময় আশার আলো দেখে। কলেজ ছেড়ে পাশের গার্লস স্কুলে ক্লাস কেটে ঘুরতে দেখা যায়। ভাদ্র মাসের পচা গরমে গায়ে ব্লেজার চাপিয়ে বান্ধবী খুঁজে ফেরে মশা। তারপর? তারপর একদিন সত্যি সত্যি লটারি লাগে। অবশেষে প্রেমের অবতরণ হয় মশার জীবনে। কোনো এক মেয়ে মশার ডাকে সাড়া দেয়। সাড়া পড়ে যায় কলেজেও। অনেক আলসে চরিত্ররা অনুপ্রাণিত হয়ে জেগে উঠলেও আমাদের মতো একঘেয়ে কুঁড়ে চরিত্রদের কোন কিছুই অনুপ্রাণিত করে না। আশাহীন ভাবে বেঁচে থাকি।
আমাদের অধিকাংশই হয়ত সেই রকম। আশাহীন। কেমন যেন নির্জীব। কিন্তু মামা ছেলেটা তো খুব প্রাণবন্ত ছিল। হাসত, খেলত, মাঝে মাঝে পড়াশুনাও করত। কিন্তু গ্রীষ্মের ছুটিতে সেই যে বাড়ি গেল আর এলো না। ওর আত্মহননের খবর পেয়ে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম। পরে শুনেছিলাম যে মেয়েটাকে ও ভালোবাসত সে নাকি ওর বিশ্বাসভঙ্গ করেছিল। মামাও যে এমন একটা কাজ করতে পারে আমরা কেউই বিশ্বাস করতে পারিনি। একদম যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। অদ্ভুত! উপরের আবরণে লুকানো এক ভিন্ন চরিত্র যে কিনা বেশ নিঃসঙ্গ, আবেগী। ঠিক যেন শামুকের মতো, যার শক্ত উপরের আবরণের নিচে লুকিয়ে থাকে এক নমনীয় তুলতুলে জীব।
একসময় কারও ছেলে ছিলাম। স্বপ্ন দেখার চোখ ছিল। এখন আর নিজেকে নিয়ে কোন স্বপ্ন নেই। প্রতিটা দিন বা প্রতিটা রাত প্রায় একরকম। মানুষ বড়ো হয়ে গেলে বোধহয় সময়টা বড্ডো একঘেয়ে হয়ে যায়। ছেলেবেলা হারিয়ে গেছে বহু আগে। সেই সব চরিত্রেরা আজ অস্তমিত হয়ে অন্য চরিত্রে মেটামরফোসিস হয়ে গেছে কোন কালে। হয়ত অজান্তে, হয়ত বা নিয়ম মেনে। কালের নিয়মে ব্যতিক্রম হয়নি আমারও। এখন কারও বাবা। সেই ছোট্ট ছেলেটা কেমন যেন হঠাৎ করে বড়ো হয়ে গেল। এবার পাখি খাঁচা থেকে উড়ে যাবে। যেমন একদিন উড়ে গেছিলাম আমিও। মনে পড়ছিল কোনো এক মেঘলা দিনে একটা ট্রাঙ্ক ও একটা বেডিং নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম আমিও। বাবা পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমার হোস্টেল জীবন শুরু হয়েছিল এক আলো-আঁধারি মেঘলা বিকেলে। হোস্টেলের প্রথম বিকেল, প্রথম সন্ধ্যে, প্রথম রাত আজও মনে পড়ে। আস্তে আস্তে সেই সব চরিত্ররা ধীরে ধীরে পাখা মেললো। তারা আজ কে কোথায় কে জানে? যে কলেজ থেকে আমি বেরিয়েছি, সেই কলেজেই ছেলে যাবে। আজ আমি বাবার চরিত্রে। সেই সব বাবাদের যেন প্রায় একই রকম লাগত যখন হোস্টেলে আসতেন। আমিও বোধহয় সেই রকম একজন এখন। কোথাও যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো জীবনে।
এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি ব্রিটিশ আমলের সেই বড়ো ঘড়িটার তলায় যেটা নাকি গত একশো বছরেরও বেশী সময় ধরে বৃত্ত সম্পন্ন করে চলছে আজও। ঘড়ির কাজই হলো বৃত্ত সম্পন্ন করা। প্রতিদিন নিয়ম মেনে সকাল থেকে সন্ধ্যে, সন্ধ্যে থেকে রাত, রাত থেকে সকাল একইভাবে ঘুরে যায়। হঠাৎ করে আজ এই ঘড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রতিটা জীবন যেন একটা ঘড়ি। টিক টিক করে চলতে চলতে কখন যেন অজান্তে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
ছেলেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাকি ছেলেদের দেখছে, কথা বলছে। জানি না বাবার মতো আমিও ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ারের ঘেরাটোপে ছেলেটাকে বন্দি করলাম কি না। জানি না কি নিকনেম অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। জানিনা কোন চরিত্রে ওর অভিষেক হবে। সে দিনের মত আজও আকাশ মেঘলা। বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। আমি মেইন বিল্ডিঙের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ফিরে গেছি তিরিশ বছর আগে। ঘুরে বেড়াতে দেখছি সেই সব মুখগুলোকে। খুব চেনা। তবে বেশ কিছুটা বিবর্ণ। তারা যেন কানে কানে কি বলতে চাইছে। চোখের দৃষ্টিতে কিছুই ধরা পড়ছে না, যা দেখছি সব স্মৃতির দৃষ্টিতে৷ কতক্ষন এমনি করে দাঁড়িয়ে ছিলাম খেয়াল নেই। সম্বিৎ ফিরল যখন ছেলে বললো - "বাবা বৃষ্টি থেমে গেছে। এবার হোস্টেল যেতে হবে।" ওকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আমি পা রাখলাম বাইরে। দু-এক ফোঁটা করে বৃষ্টি পড়ছে এখনও। একটা ফোঁটা চশমার কাচ বেয়ে ওপর থেকে নিচে নেমে এল। দৃষ্টিটা এখন যেন কিছুটা অস্পষ্ট, ঘোলাটে। চশমাটা খুলে একবার মুছে নিলাম। কাঁচ পরিষ্কার তবুও যেন সামনে আবছা পৃথিবী। আপন খেয়ালে ঘুরে চলেছে। ঘুরে চলেছে সবাইয়ের নজর এড়িয়ে। ভ্রুক্ষেপহীন….
মানস দে, আমেরিকা
আরশিকথা অতিথি কলাম
২১শে আগস্ট, ২০২২