নির্মীয়মান এক পুজো প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো - "বাপরে - বিশ্বকর্মা পূজোর এতো বড়ো প্যান্ডেল ?"
যে লোক গুলো প্যান্ডেল বানাচ্ছিলো,প্রশ্ন করলো - "ক্যানে ব খুড়া,উয়ার নাইলে কার হবেক ,উনিই ত শিষ্টি কত্তা বিধাতা !"
- "সেকি,সৃষ্টি কর্তা তো ব্রহ্মা ?"
- "এই ভাল,বম্ভা তো প্যালেন দিয়েই খালাস,উটো বানাবেক কে ? এইযে এই প্যান্ডেল টর,প্যালেন কইল্লেক স্বপন দা,কিন্তুক,কথায় ক ফুট বাঁশ লাইগবেক,কথায়,ক ইঞ্চি বাটাম লাইগবেক,কথায় কন রংয়ের কাপড় লাইগবেক ই গুলান ত আমি কইরব,তা হইলে শিল্পী ট কে আমি - ন - স্বপন দা ?"
চমকে উঠলাম,আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে বৈদিক মুনি ঋষিদের ভাবনায় যে চিন্তা ধারা দেখা দিয়েছিল,একটা লেখা পড়া না জানা লোকের মাথায় সেই ভাবনা এলো কি করে ?
এর উত্তর খুঁজতে ঢুকে পড়লাম শ্রী শ্রী বিশ্বকর্মার সংসারে !
" দংশ পাল মহাবীর সুচিত্রকর্ম কারক!
বিশ্বকৃত বিশ্বধৃক ত্বঞ্চ বাসনামানদন্ড ধৃক!!
ওঁম বিশ্বকর্মনে নমঃ !"
- হে দংশপাল,হে মহাবীর,হে বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্ববিধাতা,হে সুন্দর চিত্ররূপ কর্ম্মকারক, আপনি,মাল্য চন্দন ও মানদন্ড ধারণ করেন ! সেই বিশ্বকর্ম্মাকে নমস্কার !!
এই তো তার ধ্যান মন্ত্রে তো বলছে - তিনি বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও বিধাতা !
আবার The Hindu Temple বইতে লিখছে -Originally,the name Viswakorma is that of the working aspect of the Supreme Principle,Brahma being its thinking aspect "- মানে বিশ্ব বিধাতা এক ! তাঁর ভাব দুটি - একটি কর্ম্মময় আরেকটি মননশীলতা - একজন চিন্তা করছেন আরেক জন তার রূপ দিচ্ছেন !
পুরাণ বলছে,তাঁর জন্ম অষ্টবসুর এক বসু প্রভাসের ঔরসে এবং বৃহস্পতির ভগিনী বরবর্ণিনীর গর্ভে ! আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বলছে,ব্রহ্মার নাভি দেশ থেকে জন্ম ! বেদ কিন্তু বলছে তিনি - অজাত পুরুষ - সনাতন পুরুষ !
এসব বিতর্ক পন্ডিতরা করুন,আমরা বরং বিশ্বকর্ম্মার ঘর কন্নায় নজর দিই !
দেব শিল্পী তিনি,যেমন কনদর্প কান্তি রূপ তেমনি বলশালী,বীর্যবান শরীর,যে দেখে সেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে ! ( আমাদের চিত্রশিল্পী উত্তম কুমার কেই দেখুন না,এক সময় আট থেকে আশী বছরের মহিলারাও ওনাকে দেখে ফিদা হয়ে যেতেন )!!
তো একদিন ইন্দ্রর নৃত্য গীত সভায় দেবতা বিশ্বকর্মা নর্তকী ঘৃতাচির বিলোল নয়ন কটাক্ষে ঘায়েল হয়ে গেলেন ! সুযোগ বুঝে কামদেবও পঞ্চসর ছেড়ে দিলেন! প্রথমে স্বর্গ রাজ্যে কানাকানি,তারপর জানাজানি,অবশেষে ধমকানি - শোনো বাপু স্বর্গে এসব বেলেল্লা পনা চলবে না,তোমাদের দুজন কে শাপ দিলাম মর্ত্য ধামে গিয়ে যা খুশী করো !
শাপভ্রষ্ট বিশ্বকর্ম্মা আর ঘৃতাচী মর্ত্য এলেন এবং বিশ্বকর্ম্মার ঔরসে ঘৃতাচীর গর্ভে জন্ম হলো ন টি সন্তানের - মালাকার,কর্ম্মকার,কাংস্য কার,সঙখ কার,সূত্র ধর,কুম্ভকার,স্বর্ণকার,চিত্রকর এবং কূবিন্দক বা তন্তুবায়! ছেলেরা তো নিজের নিজের কর্মে লিপ্ত হলো কিন্তু মুস্কিলে পড়লেন একমাত্র মেয়ে - চিত্রাঙ্গদা কে নিয়ে ! এখনকার মেয়েদের মতো স্বাধীন চেতা মেয়ে,রূপে লক্ষী গুনে সরস্বতী,কিন্তু বাপের বিমানেই হউক বা রথেই হউক ( এখন যেমন মেয়েরা স্কুটি নিয়ে ঘুরছে ) যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায় আর প্রেম করে, একদিন কী হলো বিয়ে করে বর নিয়ে সোজা বাপের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো! বিশ্বকর্মা তো রাগে হিন্দী সিনেমার অমরেশ পুরীর মতো লাফাতে থাকলেন ,এ বিয়ে তিনি মানেন না,রেগে অভিশাপ দিলেন -" স্বামীর সঙ্গে তোর বিচ্ছেদ ঘটবে "!
কিন্তু আর্য্য সমাজে তো ( ডিভোর্স ) বিবাহ বিচ্ছেদ চলেনা ! গোলমাল শুনে মহর্ষি ঋত ধ্বজ এলেন মীমাংসা করতে ! রেগে বললেন -" তুমি দেবতা হয়ে অসাধু দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে? এতো বানরের নিব্বুধিতা ! যা হবার তা হয়ে গেছে আর তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই,জামাতা আর কন্যাকে সাদরে ঘরে তুলে নাও,আরে বাবা মেয়েতো যাকে তাকে বিয়ে করেনি ,জামাতা রূপে যাকে পেলে উনি তো রাজা সুরথ !
কিন্তু রক্ষনশীল পিতা,নিজ প্রতিজ্ঞায় অটল! মহর্ষি বিরক্ত হয়ে অভিশাপ দিলেন - "তুমি বানরের মতো নির্বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছো ,যাও তুমি বানর যোনি প্রাপ্ত হও "!
( এই অভিশাপের ফলে বিশ্বকর্মার ঔরসে বানরী মাতার গর্ভে জন্ম হয়ে ছিলো নলের,যিনি শ্রী রামচন্দ্রর জন্য দুস্তর সমুদ্র বক্ষে বিশাল সেতু নির্ম্মান করেছিলেন ) যাই হউক ব্যাপার টা এতদূর গড়াবে বিশ্বকর্ম্মা বুঝতে পারেন নি,শেষে মহর্ষির মধ্যেস্থতায় বিবাহ স্বীকৃত হয়,কন্যা ও পিতা উভয়েই শাপ মুক্ত ও মুক্তা হন !
বিশ্বকর্ম্মা কেবল নিজেই শিল্পী নন,তিনি শিল্পী সমাজের স্রষ্টা বা জন্ম দাতা,
ঘৃতাচির ন জন সন্তান ছাড়াও তাঁর আরেক স্ত্রী,দৈত্য রাজ প্রহলাদের কন্যা বিরোচনার গর্ভে তারই ঔরসে জন্ম হয় দৈত্য শিল্পী -" ময় দানবের "!
তাহলে দেব কূলে ত্বষ্টা নামে আরেক জন শিল্পী কে পাই তিনিও বিশ্বকর্ম্মার ই সন্তান ইনি দেবশিল্পী!
দেব,দৈত্য,মনুষ্য,ও বানর কুলে তাঁর সব সন্তানই সু প্রসিদ্ধ!
এবার তাঁর দু একটি শিল্প কর্মের নমুনা দেখাই -
তিনি ই প্রথম বিশ্বের বিমান নির্মাতা কুবেরের পুষ্পক রথ,পরশু রামের খড়্গ,দোধিচি মুনির অস্থি দিয়ে বজ্র,শ্রী বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, মহিষাসুর কে বধ করতে দেবী দূর্গা কে অভেদ্য দংশ বা কবচ, কুবেরের অলকা পুরী,রাবনের স্বর্ণ লংকা,শ্রী কৃষ্ণের দ্বারকার ভাস্কর্য - দেবদ্বেষী সুন্দ উপসুন্দকে বিনাশের জন্য বিশ্বের সকল সৌন্দর্য্য কে তিল তিল আহরণ করে যে লাবণ্য ময়ী দেববালা ভাস্কর্য শিল্পের অনুপম নিদর্শন তিলোত্তমা কে সৃষ্টি করেছিলেন তো তিনিই।
সাধন মিত্র,পুরুলিয়া
১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২২