Type Here to Get Search Results !

'নীল পাঞ্জাবী' ।। গল্প ।। উম্মে কুলসুম মুন্নি ।। বাংলাদেশ

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। দুরের গ্রামের ছোট ছোট ঘরগুলোতে সন্ধ্যাবাতির ক্ষীন আলো দেখা যাচ্ছে। ট্রেনের দুলুনিতে সিয়ামের চোখে রাজ্যের ঘুম ভর করেছে। কোনরকমে সিটের পেছনে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছে । হঠাৎই দেখলো লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে মা তার সামনে দাঁড়িয়ে গোলাপ বালা পড়া হাতটা আলতো করে তার কপালে রাখলো,
-কিরে বাবা,কেমন আছিস ? নতুন চাকরিটা কেমন চলছে ? কি যেন নাম মেয়েটার ? ও মনে পড়েছে, চারু,দারুণ মিস্টি দেখতে, ও কেমন আছে ? অনেকদিন কথা হয় নি । এবার ঢাকা গেলে ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবি, আমি নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবো ।
কিরে,চুপ করে আছিস কেন ? মেয়েটা কিন্তু আসলেই অনেক ভালো,কি সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে,আর তুই,কিছু ঠিক মতো বলতে পারিস না । কিছু গুছিয়ে রাখতে পারিস না। ওর মতো একটা মেয়েই আমার চাই  যে আমার আধার ঘরে বাতি জ্বালাবে। তোকে সামলে রাখবে । আর তোর কথা শুনবো না,পড়াটা শেষ করি,চাকরি হোক, এসব বলে বলে এতদিন আটকে রেখেছিস। এবার গিয়েই ওর বাবা মার কাছে যাবো,তোর জন্য মেয়েটাকে ভিক্ষা চাইবো । তোর দাদীর দেয়া সীতাহারটা তুলে রেখেছি তোর বউকে পড়াবো বলে,সে হবে আমার সোনাবউ ।
ভাবিস না, তোর বাবাকে আমি ঠিক রাজী করিয়ে নিব,এত সুন্দর আর লক্ষী মেয়ে দেখে সে না করতে পারবে না ।
হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে ট্রেনটা কোন এক স্টেশনে থামলো,মানুষ হুড়োহুড়ি করে নামছে। কুলিদের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। পাশের লোকটা যাওয়ার সময় সিয়ামকে ধাক্কা দিল,
-ভাই,কই নামবেন ?
সিয়ামের ঘুম ভেঙে গেল,কিন্তু লোকটার কথার কোন জবাব না দিয়ে সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল । স্টেশনে লোক সমাগম তেমন নেই ,শেষ ট্রেন টা হয়তো ছেড়ে গেছে । স্টেশনের অল্প আলোয় দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে তাকালো,রাত দুইটা বাজে। ধীরে ধীরে আড়মোড়া ভেঙে সে বুঝলো এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল । মায়ের কোন কথার জবাব সে দিতে পারে নি, আর দিবেই বা কি করে, জবাব দেয়ার মতো উত্তর তো তার জানা নেই ।
আবার ট্রেনটা তার গন্তব্য পানে চলতে শুরু করলো। মনে হয় অমাবস্যা, বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার,কিছুই দেখা যায় না, তবুও সিয়াম একভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে । গত কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া অনাকান্খিত ঘটনাগুলো মানসপটে এখনো জ্বলজ্বল করছে।
মাত্র দুই মাস আগে এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে সে আর চারু কফিশপে বসে গল্প করছিল। সেদিন ছিল সিয়ামের জন্মদিন । চারু তার জন্য একটা নীল রঙের পাঞ্জাবী আর একটা কেক নিয়ে এসেছিল । নীল রঙে নাকি সিয়ামকে ভালো মানায়,মা ও এমনটাই বলে । সেসময় দুজনেই বেশ উৎফুল্ল ছিল। একসাথে কেক কেটে একজন আরেকজনকে খাইয়ে দিল । তারপর খুনসুটিতে মেতে উঠল ।

চারু বিশ্ববিদ্যালয়ে সিয়ামের এক ক্লাস নিচে পড়ত । সিয়াম পাশ করে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে আর চারু ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে । ধন্যাড্য বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম দিনেই সিয়ামের সাথে পরিচয় । সেই পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব এবং ধীরে ধীরে তা ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে । দুজন দুজনের অন্তঃপ্রান । দুজনের বাবা মা ও জানত তাদের সম্পর্কের কথা । চারুর পরীক্ষার পর তাদের বিয়ে নিয়ে ভাবছিল তারা । কিন্তু নিয়তির নির্মম খেলায় হেরে গেল তারা । তাদের আনন্দ সুখের স্বপ্নগুলো নিমিষেই কর্পূরের মতো উড়ে গেল ।

সেদিন কফিশপে হাসিগল্পের মাঝে সিয়াম খেয়াল করল চারুর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে । কিছু  বুঝে উঠার আগেই চারু জ্ঞান হারিয়ে সিয়ামের গায়ের উপর ঢলে পড়ল । সিয়াম কি করবে বুঝতে পারছিল না, তাড়াতাড়ি চারুর ফোনটা নিয়ে চারুর গাড়ির ড্রাইভারকে ফোন দিল,তারপর দুজনে মিলে ধরে চারুকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালের দিকে ছুটল । এরমধ্যে চারুর মাকে ও জানানো হল । হাসপাতালে পৌছানোর সাথে সাথে ডাক্তার প্রাথমিক পরীক্ষা করে আইসিইউ তে ভর্তি করাতে বলল । ততক্ষণে চারুর বাবা মা ও চলে এসেছেন ।একমাত্র সন্তানের  এ অবস্থা দেখে তারা হতভম্ব, কি করবে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।   ডাক্তার চারুর বাবার বন্ধু তাই সে দ্রুত চারুর কিছু টেস্ট করানোর ব্যবস্হা করলেন আর চারুর বাবা মাকে ধৈর্য্য ধারণের পরামর্শ দিলেন । সিয়াম আর চারুর বাবা মা অস্থির হয়ে আইসিইউ র বাইরে অপেক্ষা করছে কখন চারুর জ্ঞান ফিরবে সে আশায় ।
সময় যেন কাটছে না কোনভাবেই, সিয়াম আর চারুর বাবা করিডরে পায়চারী করছে,চারুর মা বসে বসে মেয়ের জন্য দোয়া করছেন আর অঝোরে চোখের জল ফেলছেন।  সারারাতের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভোরবেলা চারু চোখ মেলে তাকিয়েছে শোনামাত্র তিনজনই একসাথে ভিতরে ঢুকল । চারুর মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল । সিয়াম আর চারুর বাবা পাশে দাঁড়িয়ে নিরবে চোখের জল মুছছে ।
চারু আস্তে আস্তে বলল-আমার কিছু হয় নি,ভালো আছি আমি,তোমরা সবাই কাঁদছো কেন ?
আর তখনই ডাক্তার রুমে এসে বলল-ঠিকই তো,চারু মামনি ভালো আছে, তোমরা শান্ত হও,আমাকে দেখতে দাও। তারপর ডাক্তার চারুকে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে দেখে কেবিনে শিফট করতে বলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল ।
চারুর বাবা ডাক্তার এর পিছনে বেড়িয়ে গিয়ে জানতে চাইল- চারুর কি হয়েছে ?
ডাক্তার চারুর বাবার কাঁধে হাত রেখে বলল-টেনশন করো না,বিকেলে টেস্ট রিপোর্ট গুলো আসুক, তখন নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে । চারুর বাবা কিছু না বলে কেবিনে ফিরে এল ।

সারাদিন চারু বাবা মা আর সিয়ামের সাথে অনেক কথা বলল,বিকেলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ।
সিয়াম ঘুমন্ত চারুর নিষ্পাপ,মায়াবী মুখের দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে, সেই সাথে কেমন যেন একটু ভয় ভয় করছে , যদি চারুর টেস্ট রিপোর্টে খারাপ কিছু আসে,পরক্ষণেই নিজেকে বোঝায়,না না চারুর কিছু হয় নি । ওর সব রিপোর্ট ঠিক ভালো হবে।
হাসপাতালের কাছাকাছি কোন মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে । এমন সময় একজন নার্স এসে বলল ডাক্তার রোগীর স্বজনদের তার রুমে ডাকছেন । সিয়াম আর চারুর বাবা দ্রুত ডাক্তার এর রুমে ছুটে গেল ।তখন ডাক্তার রুমে পায়চারি করছে, কিছুটা বিমর্ষ চেহারা। সিয়ামদের বসতে বলে নিজেও তার চেয়ারে বসল ।কার ও কোন কথা নেই, সুনসান নীরবতা ।  তার সামনে কিছু কাগজ দেখে সিয়াম আর চারুর বাবা বুঝে গেল এগুলো চারুর রিপোর্ট। ডাক্তার এর চুপ থাকা দেখে তারা একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে । সিয়াম কিছু বলতে যাবে তখনই ডাক্তার কথা শুরু করলেন আর যা বললেন, সিয়াম বা চারুর বাবা কেউ তা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। চারুর ব্লাড ক্যানসার লাস্ট স্টেজ । চারু আর বেশি দিন তাদের মাঝে নেই । এ কথা শুনে তাদের দুজনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল , দুজনেই ভাষা হারিয়ে নির্বাক নয়নে ডাক্তার এর দিকে তাকিয়ে আছে যদি ডাক্তার কোন আশার বানী শোনায়। কিন্তু ডাক্তার বিষন্ন বদনে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানাল আর লুকিয়ে চোখের জল মুছল।
সিয়াম আর চারুর বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল,তারপর ধীর পায়ে সেখান থেকে বের হয়ে চারুর কেবিনের দিকে গেল কিন্তু চারু আর ওর মাকে কি বলবে এটা ভেবে পাচ্ছে না। অনেক কস্টে চোখের পানি মুছে চারুর রুমে ঢুকল। ততক্ষণে চারু ঘুম থেকে উঠে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে । তারা দুজনেই মিথ্যে হাসি দিয়ে পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা  করছে। চারু আর ওর মার দিকে না তাকিয়ে চারুর বাবা বলল-বলেছি না চারুর কিছু হয় নি,সবকিছু ঠিক আছে,ডাক্তার একথাই বলল,তাই না সিয়াম ?

সিয়াম অন্যমনস্ক হয়েই বলল -হ্যা চারুর তেমন কিছু হয় নি, দূর্বলতার জন্য হয়তো এমনটা হয়েছে ।রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে । কথাগুলো বলতে কস্টে সিয়ামের বুক ফেটে যাচ্ছিল । 
কিছুক্ষন পর নার্স এসে চারুকে ইঞ্জেকশন দিয়ে গেলে চারু ঘুমিয়ে পড়ল । চারুর বাবা মনে মনে ভাবলো একমাত্র সন্তানের অসুস্থতার কথা তার মায়ের কাছে গোপন রাখা কোনভাবে সম্ভব  না তাই সে চারুর মা আর সিয়ামকে নিয়ে বারান্দায় গেল, চারুর মা মেয়ের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন,চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে বাবা মা দুজনের ।

অন্যদিকে সিয়াম কি বলবে তা বুঝতে পারছে না, কি বলে তাদের সান্ত্বনা দিবে। সে নিজেই তো জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়েছে । কিভাবে সে বাঁচবে চারুকে ছাড়া । তার ইচ্ছা করছে চিৎকার করে চারুকে বলতে-চারু, তুমি কথা দিয়েছ কখনো আমায় ছেড়ে যাবে না,তবে কেন এমন হলো,কেন আমায় একা করে তুমি চলে যাবে, কি নিয়ে থাকবো আমি, বল !! 

রাতের আধার ও যেন তাদের কস্টের নিরব সাক্ষী হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে । থমথমে আকাশ ভেঙে কখন যে বৃষ্টি নেমেছে  টেরই পায় নি তারা । একসময় বৃস্টি থামলো, অন্ধকার পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
ক্ষনজন্মা চারুর নিস্প্রভ জীবনে কিছুটা আলোর ছোঁয়া বইয়ে দেয়ার সংকল্প নিয়ে সিয়াম আর চারুর বাবা মায়ের নতুন সংগ্রাম শুরু হল। চারুকে নিয়ে তারা বাড়িতে ফিরল। ডাক্তার এর পরামর্শ অনুযায়ী চারুর চিকিৎসা চলছে, সেই সাথে তাকে খুশি রাখার জন্য যা দরকার তাই তারা করছে । সিয়াম প্রায় প্রতি দিন চারুকে নিয়ে তার পছন্দের জায়গায় ঘুরতে যায়। বাবা মা ও এখন যতটা সম্ভব মেয়েকে সময় দিচ্ছে, তাকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে । যদিও ভিতরে ভিতরে চারুকে হারাতে হবে এ ভাবনা তাদের প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ।
এদিকে হঠাৎ করে সিয়াম আর বাবা মা তার এত খেয়াল রাখছে এটা দেখে চারু ও কিছুটা বিস্মিত, সে কারন জানতে চাইবে ভেবে ও আর জিজ্ঞেস করা হয় নি ।
এভাবে প্রায় দুই মাস কেটে গেল । একদিন চারুর বাড়ির লনে সিয়াম,চারু আর ওর বাবা মা বসে গল্প করছিল এমন সময় হাসতে হাসতে চারুর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হল, তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলল । দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার দেখে বলল,  চারুর সময় আর বেশি নেই , ওকে আইসিইউ তে লাইফ সাপোর্টে রাখা হল ।
তিনদিন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে চারু পারি জমালো না ফেরার দেশে । বাবা মা একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায়  আর সিয়াম তার ভালোবাসার এমন মৃত্যুতে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল ।জন্মিলে মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু চারু বড্ড অসময়ে চলে গেলে,আমাকে একা ফেলে কেন চলে গেলে,কি নিয়ে বাচঁবো আমি -বলে চারুর নিথর হাত দুটো ধরে চিৎকার করে কাদঁছে সিয়াম ।
অবশেষে সমস্ত প্রক্রিয়া শেষে আজিমপুর কবরস্থানে চারুকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হলো । সিয়াম মনে মনে ভাবলো যে শহরে তার চারু নেই সেখানে আর তার থাকা হবে না, এখানে থাকলে চারুর স্মৃতি তাকে তাড়া করবে। তাই চারুকে শেষ বিদায় জানিয়ে চারুর বাবা মা কে বলে সে সন্ধ্যার ট্রেনেই চেপে বসলো চট্রগ্রামে নিজের বাবা মায়ের কাছে যাবে বলে ।

ট্রেন ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের পানে পিছনে ফেলে সব অমানিশা ।তেমনি সিয়াম ও চারুর স্মৃতিকে ইটপাথরের শহরে ফেলে এসে পালিয়ে বাঁচতে মরিয়া কিন্ত সে যে নিজের অজান্তেই চারুর স্মৃতিকে ধারন করে আছে, তার জন্মদিনে চারুর দেয়া শেষ উপহার সেই নীল পাঞ্জাবী তার গায়ে,যেন চারু আস্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে আছে ।






উম্মে কুলসুম মুন্নি, বাংলাদেশ

৩রা সেপ্তেম্বের,২০২২

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.