শিশুরা সমাজের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।বর্তমান শিশুরা আগামী দিনের নাগরিক। রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শিশুদের বিশেষ অবদান রয়েছে । কবি গোলাম মোস্তাফার কথায় – “ ঘুমিয়ে আছে যে শিশু , ভবিষ্যৎ সে হবে পরিবারের সর্বময় কর্তা । আর এ কারণেই শিশুকে গোটা সমাজ তথা রাষ্ট্রের স্বার্থে উপযুক্ত ভাবে গড়ে তুলতে হবে ।
“ অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে । " — মানব সম্পদকে কাজে লাগাতে হলে শৈশব থেকেই হৃদয়কে বিকশিত করতে হবে । শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয় , খেলাধূলা , সংস্কৃতিচর্চায় শিশুদের দক্ষ হতে হবে । নতুবা মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে না । আমাদের শিশুরা বর্তমানে যারা স্কুলে যাচ্ছে এবং লেখাপড়া করছে , তারা কেমন আছে ? খুব একটা ভালো নেই । দুবছর অতিক্রম না হতেই অনেক মা - বাবা সন্তানদের নার্সারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন । কারণ একটাই প্রতিযোগিতার বাজারে যেন পিছিয়ে না যায় । অনেক সময় শোনা যায় বড় বড় বনেদি প্রাইভেট স্কুলগুলিতে তো নাকি সন্তান মাতৃজঠরে থাকাকালীন সময়েই ভর্তির জন্য আগাম নাম লেখা হয় । স্কুলে ভর্তির পর থেকেই শিশুদের না চাপ । কেন , মা বাবার লক্ষ্য একটাই ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতায় অন্তত প্রথম শিরোপা আমাদের চাই । কেননা , একবিংশ শতকে সন্তান শুধু দুধে ভাতে থাকলে চলবে না , অভিভাবকদের সুপ্ত কামনা সন্তানদের রাখতে হবে চারতলা ফ্ল্যাটে । মা বাবার গগন চুম্বী প্রত্যাশার চাপে শিশুদের অবস্থা এখন ত্রাহি ত্রাহি । এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর লেখা শিশুদের অবস্থা সম্পর্কে – “ ভয়ে ভয়ে যাই ভয়ে ভয়ে চাই ভয়ে ভয়ে শুধু পুঁথি আওড়াই । ” শিশুরা স্কুলে যায় , পুঁথি আওড়ায় সত্য কিন্তু মূল্যবোধের শিক্ষা লাভ হচ্ছে না । আজ বিদ্যালয়গুলিতে আধুনিক পদ্ধতিতে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে । তথ্য প্রযুক্তির দৌরাত্ম্যে শিশুদের হাতে কম্পিটারের মাউস শোভা পাচ্ছে । মনে হয় কবিগুরু যদি বর্তমানে জীবিত থাকতেন , তবে হয়তো শিশুদের বর্তমান অবস্থা দেখে চিৎকার করতেন । কেননা , বিশ্বকবি বিশ্বাস করতেন , গোটা প্রকৃতিই হচ্ছে মুক্ত শিক্ষাঙ্গন । তিনি শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে শিশুর আত্মবিকাশ ও সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন । তিনি স্বাধীনতা ও আনন্দের মধ্যে দিয়ে শিশুদের শিক্ষা দেবার পক্ষপাতী ছিলেন । কঠোর শাসন ও নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে শিশুকে তর বিচারশক্তি ও চেনতা বিকশিত হবার সুযোগ দিতে হবে । লেখাপড়ার বাইরে শিশুদের পছন্দ বা স্বাধীনতা অনুযায়ী অন্য ইচ্ছা পূরণ করতে দেওয়া হয় না । তাছাড়া একাংশ শিশুরা এখনও আমাদের দেশে রয়েছে যারা শিক্ষার আঙিনা থেকে বঞ্চিত । শিশুশ্রম আইন পাশ হলেও শহরের বিভিন্ন বাড়িতে ৬-১২ বছরের অনেক ছেলেমেয়েরা আজ দুবেলা অন্নের তাগিদে কাজ করে চলছে । কখনো বা পরিবারের ভরণ পোষণের দায়ে শিশুদের বই - খাতা ফেলে রুটি - রোজগারের প্রশ্নে পথে নামতে হয় । জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী এ প্রসঙ্গে আক্ষেপ করে বলেছেন – “ শিশুকে অর্থের বিনিময়ে শ্রম করানোর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কিছুই হতে পারে না ” অন্যদিকে দেশের ৪৬ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে । শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ভারতবর্ষে ৪৯ জন । অথচ পার্শ্ববর্তী চীনে -২১ , নেপালে ৫১। ত্রিপুরায় প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার ৩৪ জন । ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় মহিলাদের জন্য অর্ধেক আসন সুরক্ষিত করার পরও সমাজে কন্যা সন্তানরা আজও অবহেলিত । এক শ্রেণির অভিভাবক , সমাজে রয়েছে যারা শৈশব থেকেই শিশুদের মগজ ধোলাই এ উদ্যোগী হয় । উদ্দেশ্য একটাই – টেনে হিচড়ে শিশুর প্রতিভার বিকাশ ঘটানো । বোধ হয় , এ কারণেই বৃহৎ অংশের শিশুরা ইদানিংকালে রোবটে পরিনত হচ্ছে । মনে রাখতে হবে , শিশুদের সাবলীল বিকাশের পটভূমিকা তৈরী না হলে শিশুর অধিকার রক্ষা করা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না । শিশু উৎসব বা শিশু মেলার প্রাসঙ্গিকতা একটাই – এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিশুরা লেখাপড়া ব্যতীত অন্যান্য প্রতিভা জন সমক্ষে তুলে ধরার সুযোগ পায় । যেহেতু শিশুরা আমাদের কাছে বোঝা নয় , রাষ্ট্রের সম্পদ।সুতরাং এ সম্পদকে রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিকের । গোটা বিশ্বকে শিশুদের বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ । শিশুদের স্বাধীনতা আমরা আর হরণ করব না । তাদের চাহিদাকে যথার্থ মর্যাদা দেব । তবেই বাস্তবায়িত হবে শিশুর অধিকার আইন । প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর জন্মদিনটি আমাদের দেশে শিশু দিবস হিসাবে পালন করা হয় প্রতি বছরই । কিন্তু বিনা সংকোচে বলা যায় দেশ স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘকাল পরেও শিশুদের জন্য মর্যাদাময় ও পরিপূর্ণ মানবিক জীবন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি । এবার শপথ হোক কোমলমতি শিশুদের স্বাধীনতার চিন্তা করার পথ প্রশস্ত করে দেব আমরাই । কেননা , এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের কথায় “ আগে থেকেই শিশুর পঞ্চইন্দ্রিয়ের প্রজ্জ্বলিত করার সলতেটা পাকিয়ে রাখা চাই । ”
তবেই শিশুর যথার্থ বিকাশ ঘটবে।পরিপূর্ণ নাগরিক হয়ে উঠবে সে।কেননা, দার্শনিক ড.মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারীজীর ভাষায়-' মানবজীবনের পরিপূর্ণতা মনুষ্যত্ব অর্জনে।'মনুষ্যত্ব বিকাশই হোক শিশুদের জীবনে মূল লক্ষ্য।তবেই সার্থকতা আমাদের এই সমাজের।
- মিঠুন রায়, ত্রিপুরা
কবি ও প্রাবন্ধিক