দিবাকর আউটডোরে রোগী দেখছে। বাইরে তেমন ভীড় নেই। কোনো একজন রোগী বা রোগীর আত্মীয় উঁচু স্বরে কথা বলছে। বার বার বাইরের কথায় কান চলে যাচ্ছে। না তেমন বিরক্তিকর লাগছে না। বেশ স্পষ্ট সুন্দর মার্জিত কথা।কেমন যেন মনে হলো এই কণ্ঠ দিবাকর শুনেছে। চিরচেনা কেউ পর্দার আড়ালে।দিবাকর অস্থির হয়ে উঠলো। যদিও ডাক্তারের ধ্যান রোগীর দিকেই থাকার কথা, তবুও। যে রোগীকে দেখছিলেন তিনি বয়স্ক মহিলা। তিনি বলেই যাচ্ছেন বাবা ---
---কেঁইলের ব্যাথায় সিধা অইতাম নঅ হারিয়ের।উত্তইয়ারে হাডি।আইজ্যা হোন্ডো দিন হমানে ব্যাথা। নাতিয়ে বঁই চাইরগ্যা আনি দিছে। খাই হুরাইছি, ব্যাথা নঅকমে"।
দিবাকর দীর্ঘদিন এই এলাকায় থাকে। এই ভাষা প্রথমদিকে না বুঝলেও এখন ঠিক বুঝতে পারে। একটু আধটু বলতেও পারে।যখন শান্তির বাজার ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতাল হয়েছে তখন থেকেই দিবাকর শান্তির বাজার থাকছে।প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে ভদ্রমহিলাকে বললেন--
---পনেরো দিন পর একবার এসে দেখিয়ে যাবেন মাসিমা।
ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে বললেন,---আইচ্ছা বাবা।
তারপর দুই তিন মিনিট আর কোনো রোগীই ঢুকছে না। সৌরভকে ডেকে একবার জিজ্ঞেস করলে হয় না, আর কেউ আছে কিনা? দিবাকর বিচলিত মনে এটাই ভেবে চলেছে।হঠাৎ ধুমকেতুর মতো এক ভদ্রমহিলা ঢুকলেন। ঢুকেই নিজের ফাইল পত্র বের করতে লাগলেন। দিবাকর ভাবলো, সিগনেচার নিতে এসেছেন। দিবাকর কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময়---
--- আচ্ছা আমি কি একটু কথা বলতে পারি?
---হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আপনাকে কথা বলতে কে নিষেধ করেছে!
---না নিষেধ নয়, অনেক ডাক্তারবাবুরা তো বেশি কথা বললে বিরক্ত হন। তাই পারমিশন নিয়ে নিলাম।
---আমি বিরক্ত হই না , আপনি বলুন।
এতোক্ষণ বাইরে যিনি কথা বলছিলেন। কুড়ি বছর আগে যে মেয়েটার পাশে বসেছিল বাসে। কুড়ি বছর ধরে যে মেয়েটাকে শুধু একবার দেখতে চেয়েছিল সেই মেয়েটা এখন মাঝ বয়সী মহিলা। কিন্তু সেই সেই দিনের মতোই সে।যে টিকিট ধরিয়ে দিয়েছেন তাতে নামটা দেখছিল দিবাকর। পৌলমী বসু। হঠাৎ আবার ধুমকেতু জ্বলে উঠেছে--
---আচ্ছা স্যার, আপনি কি আমার কথা শুনছেন? এই জন্যই জানতে চেয়েছিলাম, বলবো কি বলবো না।
---আরে, না না আমি সব শুনেছি। আপনার পাঁচ বছরের রোগের ইতিহাস।
---এগুলো আপনার জানা খুব দরকার। ট্রিটমেন্ট করতে গেলে
রোগের লক্ষণ বুঝতে হলে রোগীর হিস্ট্রি জানা খুব দরকার।
---ঠিক, একদম ঠিক। এখন আপনার সমস্যা কোথায় বা কী সেটা বলেননি। আর আপনাকে দেখে কোনো দিক থেকেই রোগী মনে হচ্ছে না।
---আমি, আমি তো এমনই। শুধু আপনি না কোনো ডাক্তার বাবু আমাকে দেখে বলতে পারবেন না আমি রোগী। আমার প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও আমি বকবক করি তো তাই।
---এটা খুব ভালো গুণ।
পৌলমী আরও কত কী বলছে।দিবাকর ভাবছে সেই দিনের কথা। তখন দিবাকর মেডিকেল কলেজের ছাত্র। পৌলমী মিউজিক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী।দিবাকর মাসির বাড়ি যাচ্ছে সাব্রুম।পৌলমী বাড়িতে যাচ্ছে।বাসে উঠেই সিট নাম্বার দেখে দিবাকরের পাশে গিয়ে বসলো।বসেই শুরু করে দিয়েছিল--
--- আচ্ছা আপনি কি জানালার পাশে আমাকে বসতে দেবেন ?
দিবাকর ভাবলো বমি বমি ভাব হয় তাই হয়তো ! বসেই বলতে লাগলেন "আপনি বসতে না দিলে আমি ম্যানেজ করে অন্য সিটে চলে যেতাম, জানালার পাশে বসে প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে যাবো আর গুন গুন করে গান করবো"।
দিবাকর ভাবলো-- আচ্ছা ডাটওয়ালা মেয়ে তো, সুবিধাও নিলো আবার কেমন ভাও দেখালো!
তারপর পুরোটা রাস্তা গল্প করতে করতে গেলো দুজনে। দিবাকর বুঝলো মেয়েটা ভালো। বেশি কথা বলে কিন্তু স্বচ্ছতা আছে। অবান্তর অযৌক্তিক কথা বলে না। দিবাকর ওর কথার প্রেমে পড়ে গেলো। ইচ্ছে হলো ওকে একবার ভালো করে দেখার কিন্তু ঘাড় ঘুড়িয়ে সেই ভাবে দেখা যায় না।মনু বাজার আসার আগে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো মেয়েটি।দিবাকর নামটা পর্যন্ত জানতে পারেনি পৌলমীর। পৌলমী মিষ্টি হেসে বলেছিল
--নেমে পড়ুন, কাল যাবেন মাসির বাড়ি। দিবাকর সৌজন্যতা বিনিময়ে বললো -- পরে দেখা হবে।
সেই দেখা এতো বছর পর। পৌলমী হয়তো সেই দুই ঘণ্টা মনে রাখেনি। অথচ দিবাকর ভুলেইনি কোনোদিন। একটুও পাল্টায়নি পৌলমী। দিবাকরের একবার মনে হলো মাস্কটা খুলে একবার বলে--দেখুনতো চিনতে পারেন কি না?তারপর ভাবলো "কী লাভ, থাকনা পৌলমী ঠিক আগের মতো কেউ জানবে না। একটি মেয়ে ঝড়ের মতো আমাকে তছনছ করে দিয়েছিল"। সেই সন্ধ্যায় পৌলমী বাস থেকে নেমে যাওয়ার পর দিবাকরের যে শূণ্যতা অনুভব হয়েছিল। বাস ছেড়ে দেওয়ার পর ভাবছিল সত্যি যদি সে নেমে যেতো... । তেমনি এক ঝড় যেন আর থামতে চাইছে না।পৌলমী বেরিয়ে যাওয়ার পর দিবাকর চশমা, মাস্ক খুলে জলের বোতল হাতে তুলে নিল। গলাটা শুকিয়ে গেছে। পৌলমী কী যেন ফেলে গিয়েছে।
----আসবো স্যা--র? দিবাকরকে দেখেই পৌলমী চমকে গেলো। লোকটা যে পৌলমীর চেনা। পৌলমী জানতে চাইলো---
--- আপনি কি আমার পরিচিত?
আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুনতো?ইস্ মনে করতে পারছি না।
---না আমার তেমন মনে হচ্ছে না।
হয়তো আপনার কোনও পরিচিত লোকের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন।
---হুঁ, হবে হয়তো,তবে আপনি যখন কথা বলছিলেন তখনও মনে হয়েছিল। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি এক্সরে রিপোর্ট ফেলে গিয়েছিলাম। আসছি স্যার।
দিবাকর প্রচণ্ড ঘামছিল।সৌরভ এসে পাখা চালিয়ে গেল।ভগবান এতোটা সময় নিলো যখন দুজনের জগৎ আলাদা।না কোনোদিন বলবে না।এইটুকু অনুরাগ রহস্যময় হয়ে থাক। সন্ধ্যায় চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো দিবাকর। নিজের অজান্তেই সার্চ করলো পৌলমী বসু। ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবে কিনা ভাবছিল। নোটিফিকেশন এলো পৌলমী বসু সেন্ট ইও ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট।
অনামিকা লস্কর
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
১৩ই নভেম্বর ২০২২