মানবজাতির সাহিত্য , শিল্প , সভ্যতা , সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি হলা মাতৃভাষা । মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম । মাতৃভাষা মানে জনজাগরণের যাত্রাবিন্দু। গ্রীক শব্দ Lagos শব্দ থেকে এসেছে ইংরাজী language , যার বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ভাষা । আর Lagos মানে চিন্তাশক্তি ।মায়ের মুখ থেকেই শিশু শেখে প্রথম মাতৃভাষা । মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ ছড়িয়ে দেয় নিজের স্বপ্ন । অন্যভাবে বলা যায়, মাতৃভাষাই মানবজাতির সত্তা বিকাশের নির্ণায়ক শক্তি। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংগ্রাম করেছে পৃথিবীর বহু দেশ । মাতৃভাষার টানে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বুকের রক্ত ফেলে দিয়েছিল রফিক , সালাম , বরকত , আব্দুল জব্বার সহ বাংলাদেশের বহু তরুণ ।আমরা জানি বাংলাভাষার গড় আয়ূ আড়াই হাজার বছরের বেশী।লিপির বয়স তিন হাজার বছর। বাংলা ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে নানা মত রয়েছে।
অথচ কালের বিবর্তনে এখন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা । আজও শ্রমজীবী সহ সাধারণ জনগণের ভাষাকে বিত্তশালীরা বিলীন করে তাদের সুবিধামতো ভাষা কয়েক চাপিয়ে দিতে চায় । ভাষা বিজ্ঞানী চার্লস্ ডেভিডের মতে , উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ,প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে,হীনমন্যতার কারণে পৃথিবীতে অনেক ভাষার বিলুপ্ত হয়েছে। চিহ্নিত ৬২০০ টি ভাষার মধ্যে ২৫০০ ভাগ বিপন্ন । ভারতবর্ষে প্রচলিত ১৬৫২ টি ভাষার মধ্যে ১৯৬ টি ভাষার অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে । আবার ভাষাতাত্ত্বিক ক্রিস্টোফার এর মতে , পৃথিবীতে মাত্র ১০ জন মানুষের ভাষাও আছে । এমন ১২ টি ভাষা আছে যাতে মাত্র দুই-তিনজন মানুষ কথা বলে । আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২ টি ভাষার বিলুপ্তি হয়েছে । বস্তুত প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষার মৃত্যু হচ্ছে।২০৫০ সনের মধ্যে পৃথিবীর ৫০ শতাংশ ভাষা বিলুপ্ত হবে। ভাষা হল জাতির স্মৃতিভাণ্ডার । জনগণের জীবন সংগ্রামের সাথে ভাষার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে । ভাষার উন্নয়ন ও বৃহত্তর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গঠনের প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে । আমাদের অগ্রসর হওয়ার যাত্রাবিন্দু । একথা সত্য যে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভাষাকে ভিত্তি করেই ভারতবর্ষে রাজ্য পুনর্গঠন ও বিন্যাস হয়েছে । ২২ টি ভাষা আমাদের সংবিধানের তপশীলের অন্তর্ভুক্ত । এছাড়াও ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ১২২ টি ভাষা রয়েছে । বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের ২৩৪ টি মাতৃভাষা রয়েছে । অরণ্য দুহিতা ত্রিপুরায় ১৯ টি উপজাতীয় ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন । প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি।
এবার আসা যাক মাতৃভাষা দিবসের পটভূমি প্রসঙ্গে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এর প্রদীপের শিখা এখনো গোটা বিশ্বে সমুন্নত।ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সুদূর প্রসারী।তবে পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক বহু দিনের । দেশ বিভাগের তার পূর্ব বাংলার সবচেয়ে ভাষা । স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব বাংলার তৎকালীন আর্থ - সামাজিক , রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্হিতির সঙ্গে আমার প্রশ্নটি ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত । এ বিষয়ে উল্লেখ্য , পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই পশ্চিম অংশের নেতারা উদুই হবে নতুন রাষ্ট্র ভাষা এ নিয়ে নিজেদের মনোভাব ব্যক্ত করতে থাকেন । এ সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত মুসলীম লীগ সমর্থক পত্রিকা গুলিতে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয় । ১৯৪৭ সালেই উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করা হবে এই আশঙ্কায় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়' বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব' শীর্ষক প্রবন্ধ দুই পর্বে ছাপা হয় । এ সময় দৈনিক আজাদ পত্রিকায় বাংলা ভাষাকে সমর্থন করে লেখা বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় । ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় । এ অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকে অন্যতম ভাষা হিসাবে ব্যবহার করার দাবি উত্থাপন করেন । ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয় । গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটির বিরোধীতা করে লিয়াকত আলী খান , তমিজউদ্দীন খান সহ মুসলীম লীগের নেতারা বক্তব্য রাখেন । ঐ সব বক্তব্য ৪ মার্চ নওবেলাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । এ সময় ঢাকার মর্নিং নিউজ , পাসবার্ন , সিলেটের আসাম হেরান্ড ,যুগভেরী উর্দুর পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করে । ফলে এই সময় সুপ্ত আকারে হলেও ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ । জনপরিষদের সরকারী ভাষার তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মাচ পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় দেশের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিবার । ১৩ মার্চ সরকার কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র দৈনিক স্বাধীনতা পূর্ব বাংলায় নিষিদ্ধ করে । ঐ দিন তেজগাঁও বিমানবন্দরে পত্রিকাগুলো এসে পৌঁছালে পুলিশ তা বাজেয়াপ্ত করে । গণতন্ত্রের উপর বুলড্রজার আক্রমনের এহীন ঘটনা ভাষাভাষীদের মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে । অন্যদিকে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্না ঘোষণা করেন পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু , অন্য কোনো ভাষা নয় । ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তনে জিন্না সাহেব আবার বলেন,দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। উপস্থিত কিছু ছাত্র না না বলে এর প্রতিবাদ করেন।প্রতিবাদ স্বরূপ ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন । সম্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন,'আমরা হিন্দু বা মুসলমান তেমন স্ত্রীর, তার চেয়ে স্ত্রীর আমরা বাঙালি।...মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা,তিলক টিটিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবান্দর জো টি নেই। ভাষার দাবিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০ জানুয়ারি প্রতীক ধর্মঘট ও জনসভা আহ্বান করে।৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় ।সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় ধর্মঘটের ডাক দেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ত্রিশ দিনের জন্যে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে । অবশেষে এল রক্তস্নাত ২১ ফেব্রুয়ারি ।১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা আমতলায় বসে । ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে - বিপক্ষে চলে আলোচনা । শেষপর্যন্ত ঘণ্টা খানেক বাদে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দেন সভাপতি গাজীউল হক । মুহূর্তে শ্লোগান ওঠে , ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে , রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই । হাবিবুর রহমান শেলীর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে একদল ছাত্র - ছাত্রী । বিকাল ৩ টায় পরিস্থিতির চরম অবনতি হয় । ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানি মদতপুষ্ট পুলিশ । ভাষার দাবিতে রক্তাক্ত হয় রাজপথ।
পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সালাম সহ অন্যান্যরা মাতৃভাষা রক্ষার তাগিদে প্রাণ
দিয়েছেন । এ ঘটনার দাবিতে সমালোচনা করে একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদ গুলিবর্ষণ ও হতাহতদের তালিকা প্রকাশ করে । অবশ্য ছাত্র - ছাত্রীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আজিদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন ।
অন্যদিকে শুরু থেকেই মর্নিং নিউজ পেপার ছিল উর্দু ভাষার সমর্থক । বাংলা ভাষার প্রশ্নে মর্নিং নিউজের কট্টর বিরোধী মনোভাবের কারণে জনতা ২২ ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া পার্ক সহিত উক্ত সংবাদ পত্রের প্রেস ও অফিস জ্বালিয়ে দেয়। ১৯৫২ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার পাকিস্তান অবজারভার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। অবজারভারের মালিক হামিদুল হক চৌধুরী এবং সম্পাদক আবদুস সালামকে আটক করা হয়।
পরিশেষে বলতে হয় , মাতৃভাষার জন্য যুবকদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি । ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পায়। বাহান্নর একুশ এখন আন্তর্জাতিক বোধ ও বিস্তারে প্রসারিত। মাতৃভাষা দিবস আমাদের গৌরবের উৎসব । চেতনার উৎসব । ২১ ফেব্রুয়ারি মূলত একটি আলোকোজ্জ্বল দিন । একুশ আমাদের শিক্ষা দেয় পৃথিবীর সকল ভাষার বিকাশ আর সকল ভাষার সম্মানে নিজেকে শামিল করার । অবশ্যই বলতে হয় একবিংশ শতকেও গোটা বিশ্বকে একভাষী করে তোলার চক্রান্ত চলছে । বৃহত্তর ভাষা গোষ্ঠীর আগ্রাসনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জন্যগোষ্ঠীর ভাষাকে একেবারে নির্মূল করার প্রয়াস চলছে । অথচ কবির কথায় -বিনে স্বদেশী ভাষা । মিটে কি মনের আশা?
না ,মনের আশা মেটে না । কেননা , মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে মাতৃভাষা।মাইকেল মধুসূদন দত্ত একসময় মাতৃভাষা প্রসঙ্গে খেদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন – 'হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে অবোধ আমি ; অবহেলা করি পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ
পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি....
বাহান্নর একুশ আজও বাঙালির প্রাণের আবেগের সঙ্গে জড়িত । কেননা , এর সাথে যুক্ত আছে চেতনার সুর। একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই আমাদের কানে ধ্বনিত হয় বিদ্রোহের সুর,মাতৃভাষার প্রতি আবেগের সুর।তাইতো আনন্দে কবি বলে ওঠে-
' এক চিলতে সবুজ মেঘ গড়ে উঠে
বর্ণময় একুশের আকাশে
মাটির গন্ধে বসন্তের বাতাসে
বৃক্ষের পর বৃক্ষ মাতোয়ারা হয়
দুধের দাঁতে শিশু যেমন নতুন বুলি শেখে ।
আমরা কুড়িয়ে তুলি রক্তিম পলাশ
আমরা ছিঁড়ে আনি পথের ভাঁটফুল
আমাদের হৃদয় আজ বিভিন্ন আবিরে রাঙা বিবর
প্রিয় বর্ণমালাকে রাঙাই দু’হাতে
মেঘের ওলান বেয়ে ঝরে পড়ে বর্ণমালা ।
রক্তে রাঙা একটি পাহাড় মাথা তোলে ফেব্রুয়ারি মাসে
কিছু পাখি আমাদের মুখের অর্গল খুলে দেয় মাতৃভাষার তরে।'
- মিঠুন রায়, ত্রিপুরা
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
২১শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩