বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, দেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় নিয়ে ততই যেন ‘আগ্রহ’ বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জোর দেয়ার নামে মূলত আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন। তবে আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনা হেরে গেলে, বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কিন্তু কেন বলা হচ্ছে এই অস্থিতিশীলতার কথা? ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত এক লেখায় সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক প্রণয় শর্মা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবেশীদের মধ্যে যে ভারতবিরোধী মনোভাব রয়েছে সেখানে দেশটির সবচেয়ে কাছের এবং একমাত্র নির্ভরযোগ্য অংশীদার মনে করা হয় শেখ হাসিনা সরকারকে। ভারত ঐতিহ্যগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বড় শক্তি’ হিসেবে স্বীকৃত হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দিল্লির সেই অবস্থানকে গুরুতরভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে চীন। এই অঞ্চলে বেইজিংয়ের আগ্রহ এবং পদচিহ্নও দিন দিন বাড়ছে।
এদিকে, বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ’ রোধ করতে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তা নিশ্চিত করতে নানা ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
‘নির্বাচনী কারচুপিতে’ জড়িত হলে, তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকির পাশাপাশি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বেশ কয়েকজন কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে।
দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নিজের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃত্ব এবং ধারাবাহিক বিজয়ের পথ প্রশস্ত করার জন্য ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপি এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর অভিযোগ রয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথাই বলেছেন। কিন্তু তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলীয় নেতাকর্মী, সরকারি সংস্থা ও কর্মকর্তাদের চাপ দিচ্ছে এবং সব রাজনৈতিক দলকে ‘নির্ভয়ে’ নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা বলছে। এর প্রমাণ পাওয়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকার এক উপনির্বাচনে (ঢাকা-১৭ আসন)। ওই নির্বাচনে অংশ নেয়া এক স্বতন্ত্রপ্রার্থীর ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা। এ ঘটনার পর বিবৃতি দিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত গণতান্ত্রিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি উল্লেখ করে দ্য হিন্দু জানায়, ওই সম্মেলনে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ, এমনকি পাকিস্তানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এছাড়া গেল মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে গেলে বাইডেন প্রশাসন তাকে উপেক্ষা করেছিল বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের গণ্তন্ত্রকে ধ্বংস করতে কাজ করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা একবার সংসদে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যেকোনো দেশের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি মুসলিম দেশ হয়।’
প্রণয় শর্মা লিখেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছে বিরোধী দলগুলো। সরকারকে আক্রমণ করে মিছিল-মিটিং করছে বিএনপি। এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা জামায়াতসহ অন্যান্য দলও যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক প্রাণচঞ্চলতা ফিরে পেয়েছে।
দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশর সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে এবং তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথ বন্ধ করেছে। কিন্তু সেই জামায়াতও গত ১০ বছরের মধ্যে সম্প্রতি ঢাকায় বড় র্যালি করেছে।
দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত এবং নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যা দুই দেশের পাশাপাশি এই অঞ্চলের জন্যও সুফল বয়ে এনেছে। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির অনেক নেতার মুসলিমবিদ্বেষী এবং বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যকে শেখ হাসিনা যে পাত্তা দেননি— এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে শক্তিশালী ও বিশ্বাসপূর্ণ সম্পর্ক বিদম্যান।
প্রতিবেদনে সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে বলেছিলেন, ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক সহযোগিতা এবং নিরাপত্তামূলক সম্পর্কে পরিণত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত সরকার দুই পক্ষের মধ্যে একটি উইন-উইন সিচুয়েশন তৈরি করেছে এবং দুই দেশের সরকারই উন্নতির ক্ষেত্রে একে-অপরের ওপর নির্ভরশীল।’
এই সম্পর্কের মাধ্যমে, ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে প্রতিবেশীরা কীভাবে সুফল পেতে পারে তার একটি উদাহরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ভারত। দ্য হিন্দু বলছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সহায়তা করলেও, পরবর্তীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার সক্রিয়ভাবে ভারতবিরোধী শক্তিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই চালাতে উৎসাহিত করেছিল। ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল করেন এবং ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করেন।
তবে নয়াদিল্লি এবং ঢাকার আশঙ্কা, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো এই সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে। কিন্তু যেখানে তাদের নিজেদের স্বার্থ থাকে, সেখানে তারা কোনো বিষয়ে নাক গলায় না। বাংলাদেশ নিয়ে কেন তারা এতটা মাথা ঘামাচ্ছে, সেটির কারণ জানা উচিত।
এ বিষয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র নৌকায় ঝাঁকুনি দিতে পারছে। বাংলাদেশ মার্কিনিদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, কিন্তু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণেই বাইডেন প্রশাসন মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র ইস্যুতে বাংলাদেশকে চাপ দিতে পারছে।’
শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। গত দশকে ৭ শতাংশ বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সোশ্যাল ইন্ডিকেটরও ভালো।
বিশ্বব্যাংকের বরাতে হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন দেখেছে। স্বাধীনতার পর বিশ্বের অন্যতম গরীব দেশ থেকে অন্যতম দ্রত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভূ-রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্যিকভাবে গুরুদ্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিতে নেতৃস্থানীয় শক্তিগুলোর মধ্যে চলমান ক্ষমতার লড়াইয়েও কোনো পক্ষ নেননি শেখ হাসিনা। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার নীতিও রয়েছে বাংলাদেশের।
যদিও সম্প্রতি ভারত ও চীনের একটি ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ, কারণ দুটি দেশই বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। অন্যদিকে দিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে শত্রুতাও কারও অজানা নয়। আর এর মধ্যেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিষয়টি পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দীর্ঘ বৈরিতার প্রভাবও পড়ছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েনে চীন শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে হিন্দুর প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়, গেল জুনে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভৌগলিক অখণ্ডতাকে কঠোরভাবে সমর্থন করার কথা জানান চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়েং ওয়েনবিন। বাংলাদেশের স্বাধীন নীতি ও উন্নয়নের পথকে সমর্থনের কথাও জানায় চীন।
তবে উদ্ভুত এমন পরিস্থিতি ভারতের জন্য দেখা দিয়েছে সংকট হিসেবে। দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা প্রত্যাশা বাড়িয়েছে যে, তারা শেখ হাসিনার পক্ষে বাইডেন প্রশাসনের নেয়া পদক্ষেপে হস্তক্ষেপ করবে। অন্যদিকে চীন ঢাকার পক্ষে থাকায়; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনাকে সহায়তায় কাজ করছে ভারত। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে মানাতে না পারলে, আদতে তা ভারতের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারালে নয়াদিল্লিকে বাংলাদেশে একটি ‘বৈরি শক্তির’ মোকাবিলা করতে হবে। তবে চীন বিএনপির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যার নেতৃত্বও পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ। তাই বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে চীনের স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা কম।
আরশিকথা বাংলাদেশ সংবাদ
তথ্য ও ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
২৩ আগস্ট ২০২৩