Type Here to Get Search Results !

ইতিহাসের আলোকে ১৪ই ফেব্রুয়ারিঃ শ্রীমান দাস, ত্রিপুরা

১৪ ই ফেব্রুয়ারি একটা বিশেষ দিন। প্রেম - বিরহ, ঘাত-প্রতিঘাত, ঘটনা-দুর্ঘটনা মিলিয়ে আমাদের কাছে এই দিনটির বিশেষত্ব অনেক। দেশপ্রেমী আপামর ভারতবাসীর কাছে এটি একটি শোক বিহ্বল দিন। ২০১৯ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারী কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি গাড়ীতে চক্রান্তমূলক বিস্ফোরণ সংগঠিত হয়।এই হামলার ফলে ৪০ জন কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল (সিআরপিএফ) কর্মী এবং আক্রমণকারী শহীদ হন।পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনই এই হামলার ছক কষেছিলো বলে জানা যায়। অবশ্য জাইশ-ই-মোহাম্মদ এই হামলার দায়ভার স্বীকার করেছে। হামলাকারীরা ছিলেন পুলওয়ামা জেলার স্থানীয় আদিল আহমদ দার এবং জয়শ-ই-মোহাম্মদের সদস্য। মূহুর্তেই সেদিন সারা ভারতবর্ষের অলিতে গলিতে বেদনার করুন ক্রন্দন ছড়িয়ে পড়ে।বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের সমস্ত উদ্দীপনা সেদিন ম্লান হয়ে গিয়েছিল এক নিমিষেই। দিকে তেজী হয়ে উঠেছিল ক্ষোভের আগুন। নানা মহল থেকে দাবী ওঠে ১৪ই ফেব্রুয়ারীকে জাতীয় কালা দিবস হিসেবে পালন করার জন্য। যাইহোক সেদিক থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারী দিনটি আপামর ভারতবাসীর কাছে একটি বেদনার দিন,স্মরণের দিন, শপথের দিন।

তারপর আসা যাক বহু চর্চিত ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে। ১৪ ই ফেব্রুয়ারী বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের পরিচয় নিয়ে বিপুল পরিমানে সমাদৃত প্রেমকাঙাল মানুষের কাছে।  ভালোবাসার জন্য নির্দিষ্ট কোন দিন থাকতে হবে - আমি এ ধারণার পক্ষপাতী নই। নিজের অজান্তেই মানুষের বুকের ভেতর জন্ম নেয় ভালোবাসা। শাসন বারনের প্রাচীর তুলে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশকে হয়তোবা কিঞ্চিৎ দমিয়ে রাখা যায় । কিন্তু বুকের গভীরে জন্মানো ভালবাসাকে আটকে রাখা যায় না। ভালবাসা বাধা মানে না ,ভালোবাসা শাসন মানে না। ভালোবাসা মানুষের সহজাত একটা প্রবৃত্তি। যাইহোক, তবুও এতো এতো দিবসের ফাঁকে  একটা দিন নির্দিষ্ট আছে প্রাণভরে ভালোবাসার জন্য। বুক ফুলিয়ে কাছে আসার জন্য।কারো কাছে চুটিয়ে প্রেম করার মোক্ষম দিন এটি। আবার কোথাওবা এই দিনকে ঘিরে নির্লজ্জ বেলাল্লাপনার খবরও ভেসে ওঠে দূরদর্শন, সংবাদ পত্র আর সামাজিক মাধ্যমে। যাইহোক এই ভালোবাসা দিবস ব্যক্তির আবেগের ঊর্ধে উঠে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের মহিমায় উন্নীত হয়েছে। ভালোবাসার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করার দৃষ্টান্তও ঢের আছে। ভালোবাসার জন্য ইতিহাসও তৈরি করেছেন অনেকে। কেউবা দিয়েছে জীবন। ভালবাসার প্রতি, প্রেমের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতেই ১৪ ই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস পালনের রেওয়াজ শুরু হয়। প্রতিক্ষণ প্রতি পল মানুষ তার হৃদয়ে ভালোবাসা ধারণ করে। ভালবাসার মধ্যে যাপন করে। তারপরেও প্রতীকি দিন হিসেবে ১৪ ফেব্রুয়ারিকেই কেন ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেনটাইন ডে হিসেবে নির্ণয় করা হলো, তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া যায় বিভিন্ন রকমের তথ্য।

একটি তথ্য থেকে জানা যায়, রোমের ধর্মযাজক তথা খ্রিস্টান ধর্মের প্রচারক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এবং রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস এর মধ্যে সংঘাতের ফলেই এই দিনটির সূত্রপাত। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মের প্রচারক। অন্যদিকে দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস ছিলেন বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা অর্চনায় বিশ্বাসী। এমতাবস্থায় রোমের সম্রাট সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে দেবদেবীর পূজার্চনায় উদ্যোগী হওয়ার নির্দেশ দিলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন তা প্রত্যাখ্যান করেন। তখন সম্রাট তাকে কারারুদ্ধ করে রাখেন।তার পর তাকে খ্রিস্টধর্ম প্রচার থেকে বিরত থাকতে বলা হলে তিনি সেটাও প্রত্যাখ্যান করেন। যার ফলশ্রুতিতে ক্ষুব্ধ রোম সম্রাট ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় আদেশ লংঘনের দায়ে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ফাঁসির আদেশ দেন। সেদিন থেকেই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এর নামে এই ভ্যালেন্টাইন-ডে পালন শুরু হয় বলে জানা যায়।

 ১৪ ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে পালনের ভিত্তি খুঁজতে গিয়ে আরেকটি যে তথ্য পাওয়া যায় সেটিও সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কাহিনী ঘিরেই। জানা যায় কারারুদ্ধ অবস্থায় রোমের প্রচুর ছেলেমেয়েরা সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে আসতো এবং তার সাথে অনেক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাকে উচ্ছলিত উচ্ছ্বসিত রাখার চেষ্টা করত। এই সময় এক কারারক্ষীর অন্ধ মেয়ে তাকে রোজ দেখতে আসত। ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে খুব সখ্যতা গড়ে ওঠে। একটা সময় পরস্পর পরস্পরের প্রেমে পড়ে যায়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন তার আধ্যাত্মিক চিকিৎসার দ্বারা ওই অন্ধ মেয়েটির চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়। এই খবর চলে যায় রোমের সম্রাটের নিকট। এবং রোমের ছেলেমেয়েদের সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রতি অগাধ ভালবাসার কথাও সম্রাটের গোচরে চলে যায়। তখন ক্ষিপ্ত সম্রাট  ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

     খ্রিস্টীয় ইতিহাস অবলম্বনে জানা যায়, রক্তখেকো রোমান সম্রাট ক্লাডিয়াসের স্বার্থ চরিতার্থ করতে গেলে তার এক বিশাল সৈন্যবাহিনীর দরকার ছিল। কিন্তু যুবকরা তার সৈন্য বাহিনীতে যোগদান করতে অনীহা প্রকাশ করত। এমতাবস্থায় সম্রাট লক্ষ্য করলেন যে, অবিবাহিত যুবকরাই যুদ্ধে নিজেকে ধৈর্য্যশীল রাখতে পারছে। তাই নিজের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে সম্রাট তখন ফন্দি করে যুবক যুবতীদের বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সম্রাটের এই ঘোষনা যুবক-যুবতীদেরকে বিদ্রোহী করে তোলে। তখন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে এক যুবক সম্রাটের এই ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করেন। শুধু তাই নয় তিনি মারিয়াস নামক এক যুবতীকে বিবাহ করে সম্রাটের এই ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি নিজের গির্জায় বদ্ধ রুমের ভেতর মোমবাতির আলোয় ফিসফিস মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে অন্য যুবক যুবতীদের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাটের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ অল্পদিনের মধ্যেই সম্রাটের কানে চলে যায়। তখন ক্ষুব্দ সম্রাট সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেপ্তার করেন এবং ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি তাকে হত্যার আদেশ দেন। আরেকটি তথ্য থেকে জানা যায় প্রাচীন রোমে দেবতাদের রানি ঝুনুর সম্মানে প্রতি বছর ১৪ ই ফেব্রুয়ারি ছুটিপালন করা হতো এবং ছুটির পর দিন ১৫ ই ফেব্রুয়ারি হতো ভোজ উৎসব। এই উৎসবে সামিল হয়ে সমস্ত ছেলেরা চিরকুটের মধ্যে মেয়েদের নাম লিখে চিরকুট গুলি একটা বাক্স পাতিল এর মধ্যে ফেলতো। পরে এক একজন যুবক এসে সবার সম্মুখে একটি করে চিরকুট ঐ বাক্স বা বড় পাত্র থেকে তুলতো। ওই চিরকুট এর মধ্যে যে মেয়ের নাম লেখা থাকতো সেই মেয়ের সঙ্গে এক বছর যাবত প্রেমে মজে থাকতো। দুজন দুজনার এই প্রেমের সম্পর্ক কখনো কখনো বিয়ে পর্যন্ত গড়াতো। আবার চাইলে এক বছর পর এই প্রেমের সম্পর্কটিকে নবীকরণ করা যেতো, বা সম্পর্ক ছিন্নও করা যেতো।বহু সমালোচক এই ব্যবস্থাটির সমালোচনা করেন। তাদের মতে এভাবে লটারীর মাধ্যমে মেয়ে নির্বাচন করে পুরুষের সঙ্গী বানিয়ে দিয়ে মেয়েদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ছাড়া এটা কিছুই নয়। ১৪ ই ফেব্রুয়ারীর এইযে শোকগাঁথা কিংবা সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই যে ত্যাগ তার উপর ভিত্তি করেই ১৪ ই ফেব্রুয়ারি দিনটি আজকের এই ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে পরিচিতি পায়।

একশ্রেণীর ইসলামী চিন্তাবিদ ১৪ ই ফেব্রুয়ারি এই দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে পালনের ঘোর বিরোধিতা করেন। তাদের মতে এটি আগ্রাসন দিবস। এটি বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি নয়। এটি মূলত খ্রীষ্টিয় সংস্কৃতি। এটি পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ। তাদের মতে এটি পরিপূর্ণভাবে ইসলামী সংস্কৃতির পরিপন্থী এবং হারাম।

   প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারী এলেই একটা অংশের মানুষ এই দিনটিকে ভগৎ সিং রাজগুরু সুখদেব এর শহীদ দিবস বলে গা ভাসিয়ে দেন। কিন্তু প্রকৃত তথ্য এবং ইতিহাস অনুযায়ী এটা ভুল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রায়ের হত্যার প্রতিবাদে ক্ষিপ্ত ভগৎ সিং প্রতিশোধের স্পৃহায় এক ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন।সেই অপরাধের বিচারে তাঁকে ফাঁসির শাস্তি দেওয়া হয়। রাজগুরু,সুকদেব সহ ভগৎ সিংয়ের এই ফাঁসি কার্যকর হয় ১৯৩১ সালের ২৩শে মার্চ। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল বলে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে সামাজিক মাধ্যম জুড়ে এমন বহু পোস্ট চোখে পড়ে। সামাজিক মাধ্যমের এসব পোস্টে দাবি করা হয় ১৯৩১ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারীতেই ভারতের তিন বীর বিপ্লবী ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরু-দের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।অথচ তথ্যমতে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা কেবল। ২০১১ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি এই বিষয়ে দ্য হিন্দু পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল।সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৪ ফেব্রুয়ারি ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরু-দের ফাঁসি হয়েছিল এই তথ্য একেবারেই ভুল।টিম শহিদ ভগৎ সিং ডট কম নামে এক ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী জেলের সুপারিটেন্ডেন্টের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেটেও ফাঁসির দিন ২৩ মার্চ ১৯৩১ উল্লেখ রয়েছে।

 ইতিহাসের আলোকে ১৪ ই ফেব্রুয়ারীকে দেখতে গেলে দেখা যায়,এই দিনে সংগঠিত হয়েছে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।১৫৫৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী মাত্র ১৪ বছর বয়সে আকবর মোগল সম্রাট হিসেবে হুমায়ুনের স্থলাভিষিক্ত হন।১৮৬৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী নারী সংগঠন ‘ব্রহ্মিকা সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী কলকাতায় অবিভক্ত ভারতের প্রথম হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ স্থাপিত। ১৯৯০  সালের এই ১৪ ফেব্রুয়ারী ব্যাঙ্গালোরে বিমান দুর্ঘটনায় ৯০ জন যাত্রী নিহত হন। এছাড়াও এই দিনেই প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিত হয় স্বৈরাচার বিরোধী দিবস ও সুন্দর বন দিবস।রয়েছে আরো নানাবিধ ইতিহাস। এছাড়াও বিভিন্ন যশশ্বী ব্যক্তিদের জন্মদিন মৃত্যুদিন তো আছেই। সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় মূলত ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবেই এই ১৪ ফেব্রুয়ারী দিনটি অধিকতর সমাদৃত।

 # তথ্যঋণ - সমকাল/যুগান্তর

শ্রীমান দাস

ত্রিপুরা


১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০২২







 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.