Type Here to Get Search Results !

কবি সুকান্তের জীবন সম্পর্কে কিছু কথা ঃ কলমে মৃণাল কান্তি পণ্ডিত, ত্রিপুরা

"অবশেষে সব কাজ সেরে,

আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে 

করে যাব আশীর্বাদ,

তারপর হব ইতিহাস।" 

--- এই কথাগুলো যার অন্তরের বেদবাক্য -- তিনি হলেন ক্ষণজীবনের এক কবি, একাকীত্বের কবি,  বাংলা সাহিত্যের প্রধান বিপ্লবী কবি, সমাজ তান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় এবং মার্কসবাদী ও  সাম্যবাদী চেতনার আদর্শে উদ্বুদ্ধ তারুণ্যের কবি, যুব কবি -- কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। কলকাতার কালীঘাটের ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের তাঁর মাতামহের বাড়িতে ১৯২৬ সালের ১৫ই অগাষ্ট পিতা নিবারণ ভট্টাচার্য, মাতা সুনীতি দেবীর কোল আলোকিত করে অতি নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কবি সুকান্তের পৈতৃক বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার ঊনশিয়া গ্রামে। মনমোহন, সুকান্ত, সুশীল, প্রশান্ত, বিভাস, অশোক, অমিয় -- এই সাত ভাইয়ের মধ্যে কবি সুকান্ত ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন সারস্বত লাইব্রেরীর পৃষ্ঠপোষক ও প্রতিষ্ঠাতা-- রোজগারের একমাত্র উৎস।  স্বাভাবিক কারণেই ন্যূনতম আয়ের এই পরিবারে তাঁর বেড়ে উঠা। বড় ভাই মনমোহনের স্ত্রী সূরজ দেবী -- তাঁর বৌদির তিনি ছিলেন খুবই ঘনিষ্ঠ। তিনি ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁরই এক জ্যাঠতুতো বোন রাণু-দিরও। সুকান্ত নামটি এই রাণু - দি'রই দেওয়া। ছোট্ট সুকান্তকে রাণু-দি রোজ নিয়ম করে গল্প ছড়া শুনাতেন --- ফলস্বরূপ তার সাহিত্য প্রতিভা দ্রুত বিকশিত হয়।  হঠাৎ করেই এতো কাছের মানুষটির মৃত্যু হয়, এবং অল্পকিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মায়েরও মৃত্যু ঘটে। সবমিলিয়ে সুকান্ত যেন এভাবেই একজন  একাকীত্বের কবি হয়ে উঠেন। একাকিত্বের জড়তা থেকে মুক্তি পেতেই তার সাহিত্যে মনোনিবেশ আরও  গভীরভাবে বেড়ে যায়। একসময় কবিতাই যেন ছিল  তাঁর একাকীত্বের সঙ্গী।

      শৈশবের পড়াশোনা শুরু হয় কমলা বিদ্যামন্দির  বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে। ছোটগল্পের অনুরাগী সুকান্তের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ঐ বিদ্যালয়ের "সঞ্চয়" পত্রিকায় । তারপর "শিখা" পত্রিকায় 'বিবেকানন্দ জীবনী' শীর্ষক একটি গল্প প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে সেই ধারাবাহিকতায় তাঁর লেখা নিয়মিত ভাবে "শিখা" পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। 

    কমলা বিদ্যামন্দিরে প্রাথমিক শিক্ষার পরবর্তী পর্যায়ে তিনি ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিনি যখন নবম শ্রেণির ছাত্র, অন্য সকল  শিক্ষার্থীদের সহপাঠী -- ঠিক সেই সময়েই ১৯৪৪ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন। ঐ বৎসরই তিনি "কঙ্কাল" নামে একটি সাহিত্য সংকলনও শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ঠিকই-- কিন্তু অকৃতকার্য হন। বিদ্যালয়ের বাঁধাধরা নিয়ম যে তাঁর মোটেই ভালো লাগতো না, তাই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এই তরুণ কবি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়মকেই নিয়ম করে নিয়েছিলেন। একদিকে কলমের যুদ্ধ , অন্যদিকে অভাব অনটন -- সবমিলিয়ে অভুক্ত থেকে থেকে পার্টির কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে গিয়ে তারুণ্যের এই কবি প্রথমে ম্যালেরিয়া এবং পরবর্তী সময়ে যক্ষারোগে আক্রান্ত হন। দারিদ্রতা কবি সুকান্তকে এমনভাবে গ্রাস করে রেখেছিল যে সঠিক চিকিৎসা পরিসেবা পর্যন্ত তিনি নিতে পারেননি। তাই অকালেই চলে যেতে হল সাম্যবাদের এই কবিকে। মাত্র একুশ বছর বয়সে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে তিনি পরলোকে চলে গেলেন। 

     ক্ষণজীবন যে ক্ষণপ্রভা হয়ে থাকে না -- তার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত  হলেন এই কবি, কবি সুকান্ত। মাত্র ছয়/ সাত বছরের সাহিত্য সাধনায় তাঁর যে সৃষ্টি, সেই  সৃষ্টিগুলোই  তাঁর বহুমুখী সৃজনশীল প্রতিভার অনন্য স্বাক্ষর হিসেবে আজও প্রতীয়মান। তিনি এমনই দুর্ভাগা জীবিত অবস্থায় তিনি তাঁর কোন গ্রন্থেরই প্রকাশ দেখে যেতে পারেননি। কবি হবার জন্যই হয়তো তিনি জন্মেছিলেন, মৃত্যুটা শুধুই উপলক্ষ মাত্র। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো---- ছাড়পত্র, ঘুমনেই, পূর্বাভাস, মিঠেকড়া, অভিযান, গীতিগুচ্ছ ইত্যাদি রোমহর্ষক কাব্য গ্রন্থ। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখে তাঁর কবিতাগুলো যেন কামানের গোলার চেয়েও আরো বেশি তেজী ছিল। তাঁর কবিতা পাঠেই আবাল বৃদ্ধ সকলের রক্ত টগবগিয়ে উঠতো-- তাইতো তিনি বিপ্লবী কবি।

      "পিঠেতে টাকার বোঝা তবুও যাবে না ছোঁয়া" --রাণার কবিতার এই পঙক্তি গুলোর মধ্যেই তাঁর হৃদয়ভেদী কান্না ফোটে উঠে। তিনি তাঁর "ছাড়পত্র" কাব্যগ্রন্থের "হে মহাজীবন" কবিতাটিতে  পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির সাথে তুলনা করে -- যেন আপামর নিপীড়িত মানুষের ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রনার এক আক্ষরিক রূপ তুলে ধরেছেন। তাইতো তিনি সাম্যবাদের কবি। 

     তাঁর প্রিয় সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেরা সাহিত্য ছিল উনারই লেখা "পথের পাঁচালী"।  এককথায় কবি সুকান্তের কাছে এই গ্রন্থটিই ছিল আদর্শগ্রন্থ। বাল্যকাল থেকেই গড়ে উঠা সখ্যতায় কবি অরুণাচল বসু -ই ছিলেন কবি সুকান্তের একান্ত প্রিয় এবং বিশিষ্ট বন্ধু।  তিনি বিশ্বাস করতেন  'ভালো লেখক হতে গেলে ভালো পাঠক হতে হয়',  তাই আমৃত্যু  তিনি ছিলেন একজন ভালো পাঠক। 

তাঁর ভাষায় ----

       " হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়,

        এবার কঠোর কঠিন গদ্য আনো,

        পদ্য লালিত্যে-ঝংকার মুছে যাক 

        গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো।"


কলমে -- মৃণাল কান্তি পণ্ডিত, ত্রিপুরা


আরশিকথা হাইলাইটস

১৪ই আগস্ট, ২০২২ 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা -- সম্পর্কে সুন্দর নিবেদন। বঙ্গমাতা- কে জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা।

    উত্তরমুছুন
  2. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৬ তম জন্মদিন উপলক্ষে পোস্ট করা তথ্যপূর্ণ লেখাগুলো পাঠ করলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম, সমৃদ্ধ হলাম। বাংলাভাষায় একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাঙালির গর্ব এই স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এমন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন শেখ হাসিনা মহোদয়, যার অন্তর সদা ভাবিত প্রতিটি বাংলাভাষী মানুষের উন্নতিকল্পে। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে আমি উনার সুদীর্ঘ সুন্দর জীবন কামনা করছি। উনি উনার স্বপ্ন পূরণ করার যে অঙ্গীকার নিয়েছেন -- সব কিছুই যেন সার্থক প্রতিপন্ন হয় -- এই শুভ কামনাই করছি। উনাকে জানাই আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।

    উত্তরমুছুন