তখন ক্লাশ ইলেভেনে বাংলা পড়াই। একটা আর্টিকেল ছিলো - " দেশে বিদেশে "। পড়াবার আগে নিজে একবার পড়ে নিই। তিন-সাড়ে তিন পৃষ্ঠার রচনাংশ। এক নিঃশ্বাসে শেষ হয়ে গেলো। এমন মজাদার লেখা, এমন রস রসিকতা, এমন সেন্স অব হিউমার, এমন সুপ্রযুক্ত শব্দ চয়ন, এমন অসাধারণ পাণ্ডিত্য, এমন মুন্সিয়ানা - আর কত বিশেষণ দেবো।
এই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অপ্রতিদ্বন্ধী লেখক সৈয়দ মুজতবা আলি। নামটা আগেই জানতাম। " দেশে বিদেশে " নামক একটি অসামান্য গ্রন্থও লিখেছেন - তাও জানতাম। কিন্তু সাড়ে তিন পাতাই যেভাবে মনটাকে রসের ভিয়েনে চুবিয়ে দিয়ে গেলো, তাতে এই ধনুর্ধর বাঙালি লেখক সম্বন্ধে জানবার আগ্রহটা পরখের মরুভূমি অঞ্চলের পারদের মতো ওপরের দিকে উঠতে লাগলো।
সিলেটি বাঙালি। বনেদিয়ানা পরিবার। ধন দৌলতের অভাব নেই। কিন্তু অভাব ছিলো পড়াশুনার প্রতি মন সংযোগ করার। তবে বাড়িতে নিশ্চয়ই শিক্ষা সংস্কৃতির এমন আবহ ছিলো, যা পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে একমেবদ্বিতীয়ং করে গড়ে তুলতে মুজতবাকে সাহায্য করেছিলো।
ঘরবাড়ি ছেড়ে কিছুদিন করিমগঞ্জে অসহযোগ আন্দোলনে " ইংরেজ সরকার ভারত ছাড়ো " গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করেছিলেন, কিন্তু বিধাতা পুরুষ যার ললাটে সাহিত্যিকের রাজতিলক এঁকে রেখেছেন, তিনি অসহযোগে বাঁধা পড়বেন কেন?
রবীন্দ্রনাথকে মুজতবা প্রথম দেখেন ১৯১৯ সালে যখন কবিগুরু শ্রীহট্টে গিয়েছিলেন। তারপর মুজতবার সিলেটের পড়াশুনার পাট চুকিয়ে, অসহযোগকে বাই বাই জানিয়ে শান্তিনিকেতনে হাজির। কবিগুরুর শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র। সেটা ছিলো ১৯২১ সাল।
কমলকলিকা যেমন সূর্যকরস্পর্শে ধীরে ধীরে দল মেলতে শুরু করে শতদলে বিকশিত হয়, শান্তিনিকেতনে এসে মুজতবার বিচিত্র সাহিত্য প্রতিভার ক্রমবিকাশ ঘটতে লাগলো। তাঁর কলমের দাপটে স্বয়ং কবিগুরুও থ বনে গেলেন। শান্তিনিকেতনে ছিলেন বছর পাঁচ ছয়েক। এরই মধ্যে কত অসংখ্য গুরুগম্ভীর, পাণ্ডিত্যপূর্ণ, রসেবনে টইটুম্বুর প্রবন্ধ লিখে তা বিশ্ব ভারতীয় সাহিত্য সম্মিলনীর সভায় পাঠ করে এক অনবদ্য কৃতিত্বের নজির স্থাপন করলেন এবং বিশেষ উল্লেখ্য যে, নিজের সাহিত্য প্রতিভার দৌলতে মুজতবা বিশ্ব ভারতী সম্মিলনীর কার্য পরিচালক সমিতির সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হলেন। এক সিলেটি বাঙালি মুসলমানের পক্ষে এই স্বীকৃতি তো এমনি এমনি আসেনি? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সভায় মুজতবার প্রবন্ধ শুনে উচ্চ প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। আবার এমনও হয়েছে, সাহিত্য সভায় সভাপতিত্ব করছেন মুজতবা আলি, আর সে সভায় প্রবন্ধ পাঠ করছেন প্রমথ নাথ বিশীর মতো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব।
কী অসাধারণ মেধা ! দেশি বিদেশি প্রায় ১৫টি ভাষা ছিলো তার করায়ত্ত। আর স্মৃতিশক্তি ! দ্বিতীয় খুঁজে পাওয়া ভার। "সঞ্চয়িতা"র আদ্যোপান্ত গড়গড় করে আবৃত্তি করে, দেবদেবীর পূজার মন্ত্র পর্যন্ত বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে চোখ বুজে বলে যেতে পারতেন। তার বহু গল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা অর্থাৎ বৈচিত্র্যের এক রাজহংসকে শান্তিনিকেতন গড়ে দিয়েছিলো। তাঁর লেখা দেশ বিদেশের মতো হৃদয়স্পর্শী বই বাংলা সাহিত্যে বিশেষ নেই - একথা বলেছেন একালের এক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক শংকর। মুজতবার লেখা " গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন " গ্রন্থে চেনা অচেনা বহু ব্যক্তি মর্মগ্রাহী প্রতিকৃতি হয়ে আছে। গল্প লিখেছেন প্রচুর। তাঁর প্রথম গল্প ' নেড়ে '। প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'রবীন্দ্রনাথ ও স্পিটলার'। শ্রীহট্টের দু-একটি গীত'শিশুমারী, চেকভের ছোট গল্প, ঈদ, ওমর খৈয়াম, রুশ সাহিত্যিক শেখভের জীবনী ও ছোট গল্প ইত্যাদি বাংলা ইংরেজি নানা প্রবন্ধের ও বক্তৃতার পুষ্পবৃষ্টি ঘটিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। আর পত্র সাহিত্য ? শংকর লিখেছেন, " রবীন্দ্রনাথের পর আলি সাহেবের মতো অকৃপণ পত্রলেখক আমাদের সাহিত্যে দেখা যায়নি। " আরও লিখেছেন, " একথাও সত্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পর ইদানিংকালের তিনি সর্বাপেক্ষা উদ্ধৃত লেখক। কিন্তু একাডেমি ও রবীন্দ্র পুরস্কারের সংকীর্ণমনা মালিকগণ তাঁকে অবহেলা করে যে মহাপাপ করেছেন তার কোন তুলনা নাই।" এজন্য একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলা সাহিত্যিক লেখকের স্বীকারোক্তি মুজতবা আলির মতো লেখকের অঙ্গুলি হেলনে শত শত শংকরের সৃষ্টি হতে পারে। এর চাইতে একাডেমি পুরস্কার কি আর বেশি মূল্যবান ?
তাঁর জ্ঞানের জগতটাও ছিলো সারা বিশ্বময়। শান্তিনিকেতনের পাঠ সাঙ্গ করে কিছুদিন আলিগড়ে অধ্যয়ন, পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়, বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি, প্যারিস ও কায়রোতেও পড়াশুনা করেছেন। তারপর বরোদার মহারাজার সাদর আহ্বানে কর্মজীবনে প্রবেশ। আকাশবাণী অধিকর্তা পদেও কাজ করেছেন। যেমন বিচিত্র জীবন তেমনি বিচিত্র তাঁর লেখার জগৎ। আর যে প্রসাদগুণ তাঁর সাহিত্যকে অন্যতম উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলো তা হলো, উনি নিজেকে নিয়ে যে উচ্চমানের, সুরুচিপূর্ণ রসিকতা করতে পারতেন তা আর কোন বাঙালি সাহিত্যিকের রচনায় অমিল।
অগ্নিকুমার আচার্য, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক
আগরতলা, ত্রিপুরা
১লা ডিসেম্বর ২০১৮ইং
এই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অপ্রতিদ্বন্ধী লেখক সৈয়দ মুজতবা আলি। নামটা আগেই জানতাম। " দেশে বিদেশে " নামক একটি অসামান্য গ্রন্থও লিখেছেন - তাও জানতাম। কিন্তু সাড়ে তিন পাতাই যেভাবে মনটাকে রসের ভিয়েনে চুবিয়ে দিয়ে গেলো, তাতে এই ধনুর্ধর বাঙালি লেখক সম্বন্ধে জানবার আগ্রহটা পরখের মরুভূমি অঞ্চলের পারদের মতো ওপরের দিকে উঠতে লাগলো।
সিলেটি বাঙালি। বনেদিয়ানা পরিবার। ধন দৌলতের অভাব নেই। কিন্তু অভাব ছিলো পড়াশুনার প্রতি মন সংযোগ করার। তবে বাড়িতে নিশ্চয়ই শিক্ষা সংস্কৃতির এমন আবহ ছিলো, যা পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে একমেবদ্বিতীয়ং করে গড়ে তুলতে মুজতবাকে সাহায্য করেছিলো।
ঘরবাড়ি ছেড়ে কিছুদিন করিমগঞ্জে অসহযোগ আন্দোলনে " ইংরেজ সরকার ভারত ছাড়ো " গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করেছিলেন, কিন্তু বিধাতা পুরুষ যার ললাটে সাহিত্যিকের রাজতিলক এঁকে রেখেছেন, তিনি অসহযোগে বাঁধা পড়বেন কেন?
রবীন্দ্রনাথকে মুজতবা প্রথম দেখেন ১৯১৯ সালে যখন কবিগুরু শ্রীহট্টে গিয়েছিলেন। তারপর মুজতবার সিলেটের পড়াশুনার পাট চুকিয়ে, অসহযোগকে বাই বাই জানিয়ে শান্তিনিকেতনে হাজির। কবিগুরুর শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র। সেটা ছিলো ১৯২১ সাল।
কমলকলিকা যেমন সূর্যকরস্পর্শে ধীরে ধীরে দল মেলতে শুরু করে শতদলে বিকশিত হয়, শান্তিনিকেতনে এসে মুজতবার বিচিত্র সাহিত্য প্রতিভার ক্রমবিকাশ ঘটতে লাগলো। তাঁর কলমের দাপটে স্বয়ং কবিগুরুও থ বনে গেলেন। শান্তিনিকেতনে ছিলেন বছর পাঁচ ছয়েক। এরই মধ্যে কত অসংখ্য গুরুগম্ভীর, পাণ্ডিত্যপূর্ণ, রসেবনে টইটুম্বুর প্রবন্ধ লিখে তা বিশ্ব ভারতীয় সাহিত্য সম্মিলনীর সভায় পাঠ করে এক অনবদ্য কৃতিত্বের নজির স্থাপন করলেন এবং বিশেষ উল্লেখ্য যে, নিজের সাহিত্য প্রতিভার দৌলতে মুজতবা বিশ্ব ভারতী সম্মিলনীর কার্য পরিচালক সমিতির সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হলেন। এক সিলেটি বাঙালি মুসলমানের পক্ষে এই স্বীকৃতি তো এমনি এমনি আসেনি? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সভায় মুজতবার প্রবন্ধ শুনে উচ্চ প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। আবার এমনও হয়েছে, সাহিত্য সভায় সভাপতিত্ব করছেন মুজতবা আলি, আর সে সভায় প্রবন্ধ পাঠ করছেন প্রমথ নাথ বিশীর মতো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব।
কী অসাধারণ মেধা ! দেশি বিদেশি প্রায় ১৫টি ভাষা ছিলো তার করায়ত্ত। আর স্মৃতিশক্তি ! দ্বিতীয় খুঁজে পাওয়া ভার। "সঞ্চয়িতা"র আদ্যোপান্ত গড়গড় করে আবৃত্তি করে, দেবদেবীর পূজার মন্ত্র পর্যন্ত বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে চোখ বুজে বলে যেতে পারতেন। তার বহু গল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা অর্থাৎ বৈচিত্র্যের এক রাজহংসকে শান্তিনিকেতন গড়ে দিয়েছিলো। তাঁর লেখা দেশ বিদেশের মতো হৃদয়স্পর্শী বই বাংলা সাহিত্যে বিশেষ নেই - একথা বলেছেন একালের এক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক শংকর। মুজতবার লেখা " গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন " গ্রন্থে চেনা অচেনা বহু ব্যক্তি মর্মগ্রাহী প্রতিকৃতি হয়ে আছে। গল্প লিখেছেন প্রচুর। তাঁর প্রথম গল্প ' নেড়ে '। প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'রবীন্দ্রনাথ ও স্পিটলার'। শ্রীহট্টের দু-একটি গীত'শিশুমারী, চেকভের ছোট গল্প, ঈদ, ওমর খৈয়াম, রুশ সাহিত্যিক শেখভের জীবনী ও ছোট গল্প ইত্যাদি বাংলা ইংরেজি নানা প্রবন্ধের ও বক্তৃতার পুষ্পবৃষ্টি ঘটিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। আর পত্র সাহিত্য ? শংকর লিখেছেন, " রবীন্দ্রনাথের পর আলি সাহেবের মতো অকৃপণ পত্রলেখক আমাদের সাহিত্যে দেখা যায়নি। " আরও লিখেছেন, " একথাও সত্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পর ইদানিংকালের তিনি সর্বাপেক্ষা উদ্ধৃত লেখক। কিন্তু একাডেমি ও রবীন্দ্র পুরস্কারের সংকীর্ণমনা মালিকগণ তাঁকে অবহেলা করে যে মহাপাপ করেছেন তার কোন তুলনা নাই।" এজন্য একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলা সাহিত্যিক লেখকের স্বীকারোক্তি মুজতবা আলির মতো লেখকের অঙ্গুলি হেলনে শত শত শংকরের সৃষ্টি হতে পারে। এর চাইতে একাডেমি পুরস্কার কি আর বেশি মূল্যবান ?
তাঁর জ্ঞানের জগতটাও ছিলো সারা বিশ্বময়। শান্তিনিকেতনের পাঠ সাঙ্গ করে কিছুদিন আলিগড়ে অধ্যয়ন, পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়, বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি, প্যারিস ও কায়রোতেও পড়াশুনা করেছেন। তারপর বরোদার মহারাজার সাদর আহ্বানে কর্মজীবনে প্রবেশ। আকাশবাণী অধিকর্তা পদেও কাজ করেছেন। যেমন বিচিত্র জীবন তেমনি বিচিত্র তাঁর লেখার জগৎ। আর যে প্রসাদগুণ তাঁর সাহিত্যকে অন্যতম উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলো তা হলো, উনি নিজেকে নিয়ে যে উচ্চমানের, সুরুচিপূর্ণ রসিকতা করতে পারতেন তা আর কোন বাঙালি সাহিত্যিকের রচনায় অমিল।
অগ্নিকুমার আচার্য, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক
আগরতলা, ত্রিপুরা
১লা ডিসেম্বর ২০১৮ইং