(শেষ পর্ব )
রাতেই ঠিক করে রেখেছিলাম পরের দিনের প্রোগ্রাম।ম্যানেজার বললো তিনশ টাকা করে মাথা পিছু লাগবে শেয়ার গাড়িতে ঘুরতে।নতুন কপোত কপোতীর সময় পেরিয়ে গেছে আমাদের।দাম্পত্য সম্পর্কের একটা সময় নাকি ভাই বোনের সম্পর্কে এসে ঠেকে।ভাইবোনের যেমন যুক্তি তর্কে মিলে কম তেমনি স্বামী স্ত্রীতেও তেমনি।তাই এমন সময়ে এমন সম্পর্কে শেয়ার গাড়িতেই ঘোরা নিরাপদ।।কথা হলো সকাল নটায় গাড়ি ছাড়বে।সারাদিন ঘুরিয়ে যার যার ঠিকানায় ছেড়ে যাবে সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়।রুটিন মাফিক সকাল নটার মধ্যে স্নান টিফিন সেরে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।প্রথমেই উটি লেক।আমাদের চার্চ হিল কটেজ থেকে দুই কিমি পথ। জোর কদমে চলছে বৃষ্টি।দৃশ্যমান নতুন কপোত কপোতীদের জন্য উৎকৃষ্ট সময় হানিমুনের।গেছে যেদিন একেবারেই গেছে।মন চলে গেছিল পঁচিশ বছর আগের রোমান্টিকতায়,কিন্তু প্রকাশের সুযোগ নেই।তবু গুন গুন করে উঠে মন--" বরষো রে মেঘা মেঘা,বরষো রে মেঘা বরষো রে---"।
চলতে চলতে কেবলই মনে জাগে ---- " এমন দিনে তারে বলা যায় ,এমন ঘন ঘোর বরিষায় ---।" এই বয়সে এই সময়ে মন কেবল একলা ধেঁয়ে বেড়ায়।চারিদিকে ঘেরা ঘন ইউক্যালিপটাস গাছের মাঝখানে তৈরী কৃত্রিম হ্রদ।ঘন বর্ষার কারনে এদিন বোটিং বন্ধ ছিল বটে,কিন্তু মন ভেসে গেছে অলকানন্দারূপ জলাশয়ের বুকে।হঠাৎ বৃষ্টি থেমে যেতেই বুকটা কেমন চিনচিন করে উতলা হয়ে উঠল।মনে পড়ে যায় রবি ঠাকুরের দুটো লাইন --- " বৃষ্টি শেষের হাওয়া কিসের খোঁজে বইছে ধীরে ধীরে।গুঞ্জরিয়া কেন বেড়ায় ওযে বুকের শিরে শিরে।"
বৃষ্টির দিনে এমন বিবাগী হয়ে উঠে প্রকৃতি থেকে মনুষ্যকূল --সবাই।ভূমিতে থাকা জলাশয় ,আকাশ থেকে উপচে পরা বৃষ্টিবিন্দুকে কিভাবে জড়িয়ে ধরছিলো সে দৃশ্য কিছুক্ষন উপভোগ করে চলে এলাম তার উল্টোদিকে অবস্হিত বিশ্বখ্যাত থ্রেড গার্ডেনে।আশ্চর্য হলাম শুনে যে,এখানকার এই কৃত্রিম বাগান বাড়িটি তৈরীর পেছনে পঞ্চাশজন দিব্যাঙ্গ মহিলাদের অদম্য পরিশ্রমের কাহিনী শুনে।শুনে ঈশ্বরের অপার মহিমার প্রতি নত হতে হয়।ভাবছিলাম,ঈশ্বর মানুষের সব দরজা বন্ধ করলেও বাঁচার জন্য জানালা হলেও খোলা রাখেন শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য।এমন জায়গায় দৃষ্টি না পড়লে তা উপলব্ধি হতো না।মিহি রেশম সূতোয় নিঁখুতভাবে ফুল ,লতা পাতায় সাজিয়ে রেখেছেন দিব্যাঙ্গনাজন।খবর নিয়ে জানতে পারলাম বিক্রিলব্ধ টাকার পঞ্চাশ শতাংশ তাদের উন্নয়নের কাজে লাগানো হয়।এমন মহতী উদ্যোগ সত্যিই প্রশংশনীয়।
এবারের গন্তব্য কুন্নুর।নীলগিরি পাহাড়ের কোলে ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্হিত দ্বিতীয় শৈলশহর ।নীলচে পাহাড়ের কোলে সবুজের চাদরে ঢাকা পাহাড়ি ঢাল বেয়ে চায়ের বাগিচা আর এলেবেলে পথে প্রকৃতির কারুকাজে অনাবিল উপত্যকাভূমির এক বাহারি চিত্র।সিলভার ওক,ফার্ণ,ইউক্যালিপটাস আর পাইনে ছাওয়া পুরো রাস্তা।
গাড়ী চলছে বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া সাফ রাস্তা দিয়ে।যেন পথিকের সাদর অভ্যর্থনার আয়োজন।কোথাও ধূলোর মলিনতা নেই।গাড়ি এসে থামলো ক্যাটি ভ্যালীর পাশে।যেখানে বাস করে নীলগিরি পাহাড়ের সবচেয়ে পুরনো উপজাতি টোডা সম্প্রদায়ের মানুষ।একশত পঞ্চাশ বছরের পুরনো এদের বাস।একসময় নাকি তারা পাহাড়ের অন্তরালেই থাকতো।ধীরে ধীরে বাইরের জগতে পা ফেলতে থাকে।তাদের রীতিনীতি,ধর্ম,সংস্কৃতি,ভাষা আলাদা।বাঁশী বাজাতে নাকি টোডা মহিলারা অভ্যস্ত।এছাড়াও কুরুমবার,বাদাগা,ইরোলা এই সম্প্রদায়ের লোকেরা ক্যাটি ভ্যালী জুড়ে বাস করেন।সব্জি ও কৃষির বেশীরভাগটাই তাদের দখলে।পাহাড়ের ধাপকে সবুজ চাদরে ঢেকে রাখতে তাদের তুলনা নেই।দেখে নিলাম উটি থেকে কুন্নুর পর্যন্ত একশ সত্তর কিমি রেলপথ ,যতটুকু দৃষ্টি যায়।ক্যাটি ভ্যালী পাখিদের মুক্তাঞ্চল শুনে গেছিলাম,কিন্তু বিধি বাম।বৃষ্টির তোড়ে সে ইচ্ছা ভেস্তে গেল।এবার শুরু হলো গাইডের নির্দেশনায় চলচ্চিত্র তৈরীর মোক্ষম অঞ্চলগুলো বর্ণনার পালা।টিভির পর্দায় বা মাল্টিপ্লেক্সের বিশাল পর্দায় দেখা আর চোখের সামনে নয়নাভিরাম জলজ্যান্ত প্রেক্ষাপট মনের দরজায় কেমন নাড়া দেয় তা একান্তই অনুভবের।ভাষা সেখানে শূণ্য।ক্যাটি ভ্যালীকে ছুঁয়ে ছায়াচ্ছন্ন বাংলো বাড়ির ছাদ চুঁইয়ে জল পড়া,হলিডে হোমগুলোর ফুল বাগিচা,মেঘ উড়ে উড়ে এসে হোম স্টে গুলোকে সোহাগ মেখে দেওয়া,সব মিলিয়ে স্বর্গোদ্বানে ভেসে বেড়ানো।মেঘের ঘেরাটোপে সীমাহীন ঢেউয়ের মত পর্বতমালা,অন্যদিকে পাহাড়ের খোপে খোপে সুবিস্তীর্ণ উপত্যকা ,যেন পাহাড়ের কোলে মুখ লুকিয়ে চুপটি করে আছে।রাস্তার পাশে সারি সারি হোম মেড চকোলেটের দোকান আর নীলগিরি চায়ের দোকান।আবার কখনো মেঘের ভিতর লুকিয়ে থাকা সবুজের ভেলা।
গাড়ি পৌঁছায় কুন্নুর থেকে দশ কিমি নিশ্চিদ্র পাহাড়ি পথে ডলফিন নোজে।ডলফিনের নাকের মত দেখতে এই জায়গার মূল আকর্ষণ ক্যাথেরিন ফলস্।মেঘে ঢাকা এই ফলস্ মেঘের আড়ালেই ছিল ।ঘোমটা সরিয়ে একটু দেখা দিয়েই আবার মেঘের কোলে মুখ লুকায়।দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে আসায় খাবারের পালা শেষ করে আবার ছুটা শুরু।
এবার উটি থেকে প্রায় কুড়ি কিমি দূরে অবস্হিত পাইকারা জলপ্রপাত।টোডা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নদী এটি।লেইকের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করা হয় নি ভেজা আবহাওয়ার জন্য।পাইন গাছের সারির ভিতর দিয়ে বাসে করে যেতে যেতে একটা সময় আরাম পায়চারী করে উদ্যম হাওয়া আর ঝিরঝিরে বৃষ্টিকে মাথায় করে লেইকের কাছাকাছি পৌঁছলাম।কারণ বাতাসে ক্ষিপ্রতায় ছাতার মাথা মুড়ে গিয়েছিল।যেতে যেতে প্রকৃতির অপার মহিমায় পথচারীদের মোহময় হয়ে উঠার সুযোগ করে দেয়।পাইকারা লেকের বুকে "আজব প্রেম কী গজব কাহিনী" র স্যুটিং হয়েছিল। উপর গড়ে উঠেছে পাইকারা ড্যাম,যা দক্ষিণ ভারতের অতি প্রাচীন পাওয়ার প্ল্যান্ট।পথের ধারে টোডা উপজাতিদের তৈরী গয়না,নানা ধরণের সুগন্ধী তেল,এলাচ দারুচিনীর পসার সাজিয়ে বসে আছে রমণীরা।আমরা মকাই দানা সেদ্ধ আর মশলাদার বাদাম সেদ্ধ হাতে নিয়ে গাড়ি চাপলাম।
ঘন সুউচ্চ পাইন ফরেষ্টের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা, দিশেহারা হবার মত।সবুজ পথের মায়ায় যেতে যেতে হালকা বৃষ্টিতে একটা শীতার্ত অনুভূতি।সাথে হলিউডি,বলিউডি সিনেমার দৃশ্যগুলোকে চোখের সামনে দাঁড় করাচ্ছে আমাদের গাইড ভদ্রলোক।পাইন গাছে ঘেরা সিক্স মাইল,স্যুটিং স্পট।তারপর এলো নাইনথ মাইল।উটি থেকে যার দূরত্ব 14.49 km.এই জায়গাটিকে নাকি স্যুটিং মেডু বলা হয়।এখানে দুইশটিরও বেশি ম্যুভি হয়েছে।এর মধ্যে পনেরোটি বলিউড ম্যুভি।"ছাঁইয়া ছাঁইয়া" গানের স্যুটিং, এখানেই হয়েছিল।আরও কত ম্যুভি --"বরফি"
"কুছ কুছ হোতা হ্যায়","রাবণ","আন্দাজ আপনা আপনা ","হাম আপকে হ্যায় কৌন","রাজা হিন্দুস্তানী","তেরি উম্মিদ","পুকার",,"রোজা","এয়সি দিওয়াঙ্গী", আরো অনেক ম্যুভির নাম বলছিল গাইড।
পাইকারা গলফ ফিল্ডে গিয়ে মনে হয় নি উটি আছি,মনে হয়েছিল সিমলায় আছি।মিনি সিমলা বলা যায় অঞ্চলটিকে ,পাইনের সাড়ি সাড়ি দাঁড়ানো অবস্হা তাই মনে করিয়ে দেয়।
এবারের গন্তব্য মাইসোর রোডে অবস্হিত মধুমালাই টাইগার রিজার্ভ ফরেষ্ট।উটির অনেকটা নীচুস্তরেই অবস্হিত।বৃষ্টির জন্য জিপ সাফারি আর হয় নি।গাড়িতে বসেই কিছু চিতল হরিণের পায়চারী চোখে পড়েছিল।বুনো মহিষ আর বাইসনের লুকোচুরি চলছিল ঝোপে ঝাড়ে।তবে বাঘ নজরে আসে নি।সারাদিন ঘুরেফিরে সন্ধ্যায় হোম স্টেতে ফিরে এলাম।
পরের দিন ফিরবো কোয়েম্বাটুর।কিন্তু চড়তে হবে টয় ট্রেণ।খবর নিয়ে জানতে পারলাম ,বেলা বারোটায় উটি টু মেট্টোপালায়াম ট্রেণ ছাড়বে।হোম স্টে ছেড়ে বের হয়ে এলাম অটো নিয়ে উধাগামন্ডলম স্টেশনে।এসে মাথায় হাত ।সব ট্রেণ বাতিল।বসে রইলাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে।হঠাৎ সিগনাল পাওয়া গেল ,মেট্টোপালায়াম যাবে না তবে কুন্নোর অবধি একটা ট্রেণ চালু করবে আমাদের মত উচ্ছ্বসিত দর্শনার্থীদের কথা ভেবে।উধাগামন্ডলম টু কুন্নোর,কুন্নোর টু উধাগামন্ডলম।ফিরে আবার কোয়েম্বাটুরের বাস ধরতে হবে।মন আনন্দে নেচে উঠল।তিনশ টাকা করে মাথা পিছু টিকিট।যাওয়া আসা।কাউন্টার সাহেব লাল টুপি আর হাত ব্যাগ ধরিয়ে দিল।সময় বিকেল দুটো।যথাসময়ে ট্রেণ ছাড়লো পাহাড়ের বুক চিরে।এক ঘন্টার সফর।টয় ট্রেণে চেপে যাত্রীরা সব শৈশবে ফিরে গেছিল।চোখমুখের হাবভাব তাই বলেছিল সেদিন।মাথায় লাল টুপি,ট্রেণের হুইশেল,পাহাড়ী জনপদের হাতছানি,বাহারী ফুল আর পাতার দৌড়াত্ম,সব মিলেমিশে একাকার।চলার পথের অভিজ্ঞতা অবর্ণনীয়।কেবল অনুভবে ছোঁয়া যায়।রেল ট্র্যাকের দুধারে সবুজ চা বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে এক স্বর্গীয় অনুভূতি ঘিরে রাখে। খোপে খোপে সুদৃশ্য বাংলো টাইপের ঘর।সবুজের মখমলে পা দিয়ে পাহাড়ী জনের চলাফেরা।মুখে স্মিত হাসি।যেন ফুলের ঘ্রাণে মগ্ন চিত্তে কোন অ-সুখ তাদের নেই।কুন্নুর পৌঁছে ট্রেন থেকে নেমে মেঘের টুকরোয় পা ছুঁয়ে কুন্নুর স্টেশানে বসে ফ্রি সামোসা আর জুস পান করে আবার বসে পরলাম ট্রেণে।উধাগামন্ডলম পৌঁছে বাস ধরার জন্য বাস টার্মিনাসে পৌঁছে উটির অমোঘ মায়াবী আকর্ষণকে স্মৃতির ঝোলায় ভরে কোয়েম্বাটুরের উদ্দেশ্যে বাসে বসে পড়লাম।
রীণা দাস।আগরতলা।ত্রিপুরা।
৬ই অক্টোবর ২০১৯