Type Here to Get Search Results !

বিবেকানন্দের দেশপ্রেম ঃ সুস্মিতা এস দেবনাথ, ত্রিপুরা

আমাদের চিন্তা-চেতনায়, ভাব ভাবনায় স্মরণে মননে চিরউজ্জ্বল যে ব্যক্তিত্ব আজও আছেন, থাকবেন আরও সহস্র বছর তিনি আর কেউ নন, বীরেশ্বর বীর স্বামী বিবেকানন্দ। 

বৈদান্তিক সন্ন্যাসী ভারতাত্মার মূর্ত বিগ্রহ, স্বামীজির কাছে ভারত ছিল,'পুণ্যভূমি'। যে ভূমির প্রতিটি ধুলিকণা পর্যন্ত তাঁর কাছে ছিল পবিত্র। ভারতকে ভালোবেসে তিনি শুধু ভারতের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ান নি, দেশ বিদেশেও ঘুরে ঘুরে ভারতের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে প্রচার করেছেন। রাতের পর রাত রাস্তায়, কখনও রেলস্টেশনে, কখনও কারো বাড়ির বারান্দায় শুয়ে রাত কাটিয়েছেন। অভুক্ত থেকেছেন দিনের পর দিন, কখনও বা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেড়িয়েছেন। তারপর ও ক্ষান্ত হন নি, লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হন নি।অনেকে বলে থাকেন স্বামীজি ধর্ম প্রচারের জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। 

কিন্তু স্বামিজী আমেরিকা গিয়েছিলেন মূলত ওদেশ থেকে ভারতের জন্য সাহায্য আনতে।সৌরেন্দ্র মোহন  লিখেছেন ,"সতের দিন ধরে অনুষ্ঠিত শিকাগো সম্মেলনে উদ্বোধন অধিবেশন ও  বিভাগীয় অধিবেশন গুলিতে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতাগুলোতে এ কথাই সবচেয়ে বেশী ফুটে উঠে, ধর্ম নয় রুটি  ভারতের সর্বাগ্রে প্রয়োজন। "স্বামীজি আমেরিকায় যাওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে বলেছিলেন, দেখ ভাই, এ দেশে যেরকম দুঃখ দারিদ্র্য, এখানে এখন ধর্ম প্রচারের সময় নয়, যদি কখনও এদেশের দুঃখ দারিদ্র্য দূর করতে পারি, তখন ধর্মের কথা বলব। সেই জন্য কুবেরের দেশে যাচ্ছি। দেখি যদি কোনো উপায় করতে পারি। "

তিনি অগ্নিময় ভাষায়  বলেছেন, পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ । শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম, দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ । ঘোষণা করলেন, “ক্ষুধা র যাতনায় কোটি কোটি ভারতবাসী কাতর কন্ঠে শুধু খাদ্য চায় । কিন্তু আমরা শুধু তাদের পাথরের টুকরো দিই । ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের বাণী দেওয়া তাকে অপমান করা । অনাহারীকে দর্শন শাস্ত্র শেখানো তাকে অসম্মান করা ।” সাহিত্যিক বনফুল স্বামীজী উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করে লিখেছেন, “এ অগ্নি আমাদের স্পর্শ কর তুমি । অঙ্গার হয়ে কতকাল থাকবো আমরা জড়ের মতো । আমাদের প্রাণবান কর, শক্তিমান কর, উজ্জ্বল কর, মহৎ কর । মুক্ত কর আমাদের হীন-পশুত্বের কারাগার থেকে । আমরা আজও তোতাপাখীর মতো তোমার বন্দনা করে যাচ্ছি, হৃদয়ের মধ্যে তোমাকে অনুভব করিনি । আমাদের প্রতি দয়া কর । হে ধন্বন্তরি, দূর কর আমাদের অন্ধকার । আমাদের প্রেরণা দাও, আমাদের বাঁচাও ।” এই অগ্নিদেবতা বিবেকানন্দের কাছে মানুষই ছিল প্রথম এবং মানুষই হল শেষ কথা । মানুষের সুপ্ত আত্মার জাগরণে, মানুষের হৃদয়ের দেবত্বকে জাগরিত করতে সারাটা জীবন তাঁর সংগ্রাম । বিশ্বাস করেছেনত্যাগ ও সেবার মাধ্যমেই জাতির উন্নতি । স্বদেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে মহামন্ত্র শুনিয়েছেন, “শ্রদ্ধাবান হও, বীর্যবান হও । আত্মজ্ঞান লাভ কর, পরহিতায় জীবনপাত কর এবং মানুষকে ভালবাস ।

স্বামীজির জীবনে সর্বপ্রথম ও শেষ ছিল ভারত, আর এই ভারতকে কেন্দ্র করেই ছিল তাঁর যাবতীয় চিন্তাভাবনা, কিভাবে ভারতকে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত করা যায় সেটাই ছিল জীবনের শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত ভাবনা।বিবেকানন্দের দেশপ্রেম নিয়ে যদি তাঁর জীবনে আলোকপাত করি তাহলে দেখি,দেশের প্রতি তাঁর ভালবাসা সর্বজনবিদিত । মহাত্মাগান্ধীর উক্তি এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য । তিনি বলেছিলেন, ‘বিবেকানন্দর রচনাবলী পাঠের পর দেশের প্রতি আমার ভালবাসা শতগুণে বর্দ্ধিত হয়েছিল ।’ কিন্তু তাঁর দেশপ্রেম সাধারণ দেশপ্রেমিকদের দেশপ্রেম থেকে ভিন্ন প্রকৃতির ছিল । অখণ্ডানন্দজী সুন্দর করে তা ব্যাখ্যা করেছেন, ‘স্বামীজীর দেশপ্রেম অত সোজা নয় । এ patriotism নয় –দেশাত্মবোধ । সাধারণ লোকের হচ্ছে দেহাত্মবোধ, তাই দেহের সেবাযত্নে বিভোর । তেমনি স্বামীজীর হচ্ছে দেশাত্মবোধ – তাই সারা দেশের সুখ দুঃখ, ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমান নিয়ে তাঁর চিন্তা ।’ ইতিহাসে দেশপ্রেমের অনেক উদাহরণ থাকলেও দেশাত্মবোধেরউদাহরণ খুবই বিরল ।সেদিক থেকে স্বামীজি একজন সত্যিকারের দেশ প্রেমিক ছিলেন। তিনি দেশকে ভালোবেসে ছিলেন বলেই ভারতকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে দেশাত্মবোধের লক্ষণ দেখা যায়। বাড়িতে ভিক্ষা করতে আসা দরিদ্রদের তিনি জানালা দিয়ে মায়ের ভালো কাপড়, শালের চাদর দিয়ে দিতেন। জাতপাতের নামে সমাজে যে শোষন বা  ধর্মের নামে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। জাতপাতের  ঊর্ধ্বে উঠে তিনি দেশকে ভালোবেসেছেন বলেই তিনি ছোটবেলায় বাবার বৈঠকখানায় রাখা হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি বিভিন্ন জাতের জন্য আলাদা  হুকোয় টান দিয়ে দেখেছিলেন কিভাবে জাত যায়? তিনি চেয়েছেন," নতুন ভারত বেরুক । বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে । বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে । ... এই সামনে তোমার উত্তরাধিকারী ভবিষ্যৎ ভারত । "সাধারণ মানুষ, নিচু তলার মানুষ শোষিত নির্যাতিত মানুষের উত্থানের স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি স্পষ্ট বাক্যে বলেছেন, "ভারতের ভরসাস্থল জনসাধারণ। "

ছাত্রাবস্থায় তিনি সত্য ঈশ্বরের সন্ধানে   সর্বত্র খুঁজে বেড়িয়েছেন, সবাইকে পাগলের মত জিজ্ঞাসা করেছেন, ভগবানকে দেখেছো? ব্রাহ্মসমাজের সান্নিধ্যে এসেও তিনি সঠিক উত্তর পাননি। শেষে বৌদ্ধধর্মের সংস্পর্শে এসে বৌদ্ধদর্শন এর সাথে পরিচিত হয়েছেন, কিন্তু মনের জিজ্ঞাসার উত্তর পান নি। শেষে রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এলেন ১৮৮৯ সালে তার মনের উত্তর পেলেন। মুগ্ধ হলেন এ মন অমূর্ত বিষয়ের মূর্ত, প্রাঞ্জল ব্যাখা শুনে।  তারপর ধীরে ধীরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস যুক্তি-তর্ক সব কিছুর মধ্য দিয়ে নরেন্দ্রনাথ উত্তেরিত হলেন সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ নামে । রামকৃষ্ণের কাছে মুক্তি চাইলেন বিবেকানন্দ। তখন  রামকৃষ্ণ তাকে বলেছেন, "তুই শুধু নিজের মুক্তি চাইলি,যা যাস শালা তুই হবি এক বিশাল বট গাছের মত যার ছায়ায় এসে পৃথিবীর মানুষ শান্তি লাভ করবে তুই জগতকে শিক্ষা দিবি। রামকৃষ্ণ একবারের জন্য বিবেকানন্দকে  অধ্যাত্মজীবনে  টেনে নেন নাই, বলেন নাই  ধর্ম ঈশ্বর নিয়ে মেতে থাক। ধর্ম জীবনের সর্বোচ্চ উপলব্ধি। নির্বিকল্প সমাধি লাভ করার পরও বিবেকানন্দকে রামকৃষ্ণ বলেছেন, "এই উপলব্ধির চাবি আমার কাছে রেখে দিলুম।  জগতের প্রতি কর্তব্য যখন শেষ হবে তখন নিজের হাতে এই উপলব্ধির দ্বার খুলে দেবো।এখন যা শালা,জগতের সেবা কর।"

জগতের কর্তব্য বলতে দেশসেবার কথায় রামকৃষ্ণ  বুঝিয়েছেন।  তিনি দেখলেন পরাধীন ভারত, নিরন্ন ভারত দারিদ্র্য কুসংস্কার আর  অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত ভারত। এই ভারতবর্ষকে তিনি সন্নাসীর মতো নিস্পৃহভাবে দেখলেন না। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে তিনি গভীরভাবে ব্যথিত হলেন, উদ্বেলিত হলেন। অনাহারক্লিষ্ট, গৃহহীন  বাস্তহীন মানুষের জন্য  তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠল। তিনি শুধু শাস্ত্র বাক্য উচ্চারণ করে কিংবা একে নিয়তির বিধান বলে দূরে বসে থাকতে পারলেন না।  

 একজন পাঠকের মত, ধার্মিকের মত , একজন তাত্ত্বিকের মত,  বিজ্ঞানীর মত বেদবেদান্ত উপনিষদ, গীতা, কাব্য মহাকাব্য অধ্যয়ন করে তার সারবত্তা তুলে ধরেছেন মানুষের সামনে। এই দুঃখ দুর্দশার কারণ অনুসন্ধান করলেন, এর প্রতিকারের পথ নির্দেশ করলেন। এখানেই প্রশ্ন বিবেকানন্দ যদি  প্রকৃত ঈশ্বরবিশ্বাসী হতেন তাহলে তিনি বলতে পারতেন, অনাহার, দরিদ্র জনগণ তোমরা ঈশ্বরের নাম জপ তপ ধ্যান কর, তাহলে তোমাদের ক্ষুধা দূর হবে, কিন্তু তিনি তা বলেন নি, কারন তিনি কর্মে বিশ্বাসী ছিলেন।  বরং ঠাকুর রামকৃষ্ণের সাথে তিনিও বলেছেন, "গীতাপাঠের চেয়ে  ফুটবল খেলা অনেক ভালো।"

বিবেকানন্দ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকা পর্যন্ত সমগ্র ভারত পরিভ্রমণ করে একদিকে দেখলেন ভারতের ঐতিহ্য আর অন্যদিকে দরিদ্র ক্লিষ্ট পরাধীন ভারত।বেদনা কাতর হৃদয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন রামকৃষ্ণ প্রদত্ত অমূল্য মন্ত্রটির   তাৎপর্য, "জীবে দয়া নয়, শিব  জ্ঞানে জীবের সেবা।"তারপর তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন শিবরূপী মানুষের সেবায়। তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো, 'জীবে প্রেম করে যেজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। "

বিবেকানন্দ জন্মগত সন্ন্যাসী ছিলেন না, রামকৃষ্ণ তার পরম গুরু, কিন্তু একবারের জন্যও বিবেকানন্দকে ধর্মের দিকে টেনে আনেন নি। যদি তিনি  বিবেকানন্দকে  সন্ন্যাসী করতে চাইতেন তাহলে আরও অনেক আগেই তাকে গেরুয়া দিতেন, কিন্তু দেন নি। রামকৃষ্ণ-ও চাইতেন, বিবেকানন্দ  জগতের ভগবান রূপী মানুষের সেবা করুক।বিশ্বমাঝে একটা দাগ রেখে যাক। যা বিবেকানন্দ করেছেন। 

দেশ প্রেমিক বিবেকানন্দের দেশের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসার অজস্র নিদর্শন আমরা পাই।ভারতের ধর্মকে বিশ্বের দরবারে স্থান করে দিতে বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলন চিকাগো শহরে যোগ দিয়েছেন। আমাদের দেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে পরিচিতি ঘটিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। শিকাগো ধর্ম মহাসভায় ভারতকে এক নতুন পরিচিতি প্রদান করার পর তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি স্বামিজী ভারতে পদার্পণ করেছিলেন। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ভারতবর্ষের আত্মমর্যাদা। দেশব্যাপী  গান্ধীজী, নেতাজি, শ্রীঅরবিন্দ -প্রত্যেকেই স্বামীজির  জাতীয়তাবোধ ও  দেশপ্রেমের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।বিশেষত  নেতাজি সুভাষচন্দ্র মুক্তকণ্ঠ বলেছেন, 'বিবেকানন্দের পুণ্যপ্রভাবে আমার জীবনের প্রথম উন্মেষ। আজ যদি তিনি  জীবিত থাকতেন নিশ্চয়ই তিনি আমার গুরু হতেন।"

চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী যথার্থই বলেছেন, "তিনি না থাকলে আমরা আমাদের ধর্ম হারাতাম এবং স্বাধীনতাও লাভ করতে পারতাম না। আমাদের সবকিছুর জন্যই তো আমরা বিবেকানন্দের কাছে ঋণী। "

 স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশ থেকে যখন ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন তখন তার মন প্রাণ জুড়ে শুধু ছিল ভারতবর্ষের চিন্তা। সেভিয়ার দম্পত্তি যারা তার সঙ্গে এসেছিল তাদের তিনি বলেছেন," এখন আমার শুধু একটিমাত্র চিন্তার বিষয় আছে-- আর সে হল ভারত। আমি তাকিয়ে আছি  ভারতের অভিমুখে-- শুধু ভারতের দিকে। "বিদেশ থেকে ভারত প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত কোথাও তিনি একবারের জন্য বলেন নি আমার একমাত্র কাজ ঈশ্বরসাধনা, ধর্ম বিস্তার করা। ইংল্যান্ডে তার এক  ইংরেজ বন্ধু তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, "এই বিলাসবহুল পাশ্চাত্য দেশে চার বছর কাটানোর পর মাতৃভূমি আপনার কেমন লাগবে?" উত্তরে স্বামীজি বলেছিলেন, "দেশ ছেড়ে আসার আগে আমি ভারত কে ভালবাসতাম  এখন ভারতের প্রতি ধূলিকণা পর্যন্ত আমার কাছে পবিত্র, ভারতের বায়ু পর্যন্ত পবিত্র, ভারত এখন পূণ্যভূমি -তীর্থক্ষেত্র।"

 দেশকে প্রানের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন বলেই দেশ-বিদেশ সর্বত্র ছুটে বেড়িয়েছেন। ভারত প্রত্যাগত স্বামীজির চরিত্র, ব্যক্তিত্ব,বাগ্মিতা ও পাণ্ডিত্যের শক্তি ভারতবাসীকে এটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল --হ্যাঁ আমরাও পারি, আমরা ছোট নই, হীন নই। আমাদের এমন কিছু আছে যা মহামূল্যবান অথচ যা শুধু আমাদেরই আছে, অন্য কার ও নেই। 

ভারতবাসীকে স্বামীজি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন জাগতিক ঐশ্বর্যে  ভারত দরিদ্র হতে পারে, কিন্তু চিন্তার ঐশ্বর্যে ভারতবর্ষ ধনীশ্রেষ্ঠ। মানুষ কত সুন্দর ও মহৎ হতে পারে এ দেখানোর কৌশলে ভারতবর্ষ  পৃথিবীতে সবচেয়ে দক্ষ। এই আত্মবোধ, এই নবদৃষ্টি  দেশপ্রেম ভারতবর্ষকে স্বামীজীর দান। 

রোমারুলা বলেছেন," যিশুখ্রিস্টের আহ্বানে মৃত ল্যাজারাস যেমন কবর থেকে উঠে এসেছিলেন, স্বামীজীর আহ্বানেও তেমনি গোটা ভারতবর্ষ কুম্ভকর্ণের মহানিদ্রা ত্যাগ করে জেগে উঠেছিল।দেশকে উজ্জীবনের জন্য স্বামীজী যুব সম্প্রদায়কে ডাক দিয়েছিলেন, কারণ সমাজের প্রতিটি অন্যায় বা কুসংস্কারের প্রতি যুব সম্প্রদায়ই প্রথম প্রশ্ন তোলে । "

স্বামীজি ভারতের বেকার যুবকদের বেকারত্ব যন্ত্রণা বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাইতো মাদ্রাজে যাওয়ার পথে জামসেদজী টাটাকে তিনি ভারতের যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য ইন্ডাস্ট্রি খুলতে বলেছেন। সাইন্স এন্ড টেকনোলজি উন্নতির জন্য কিছু করতে অনুরোধ করেছেন। এর থেকে বোঝা যায় তিনি দেশের  যুবকদের জন্য কতটা চিন্তিত ছিলেন। নিজের দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রতি দৃঢ় আস্হার   এক আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল স্বামীজীর জীবনে ও ব্যক্তিত্বে।

তিনি কতটা ভারতকে ভালোবাসতেন তার প্রমাণ তাঁর বাণীতে,  তিনি বলেছিলেন," দুঃখী ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী --মেথর, হরিজন ভারতবাসী আমার ভাই।" কোন সাধুকে আমরা এত বড় কথা বলতে শুনি নাই। ধর্মের কথাই যদি বলি, তিনি বলেছেন," সব ধর্মই সমান। "সবার চেয়ে বড় ধর্ম  হল মানুষ।সকল ধর্ম ও মানবজাতির প্রতি স্বামী বিবেকানন্দের প্রীতি ও শ্রদ্ধার  এত বড় নিদর্শন ইতি পূর্বে দেখা যায়নি। ভারতমাতার কিভাবে উন্নতি হবে, দেশের দুঃখ দূর হবে সেই চিন্তাই তিনি সবসময় করেছেন।এটা মানতেই হবে, বিবেকানন্দের তখন যে ক্ষমতা ছিল এক বাক্যে তিনি ভারতের অলিতে-গলিতে বহু মঠ মন্দির মসজিদ বানাতে পারতেন, কিন্তু  তিনি তা করেন নি। তিনি যুবকদের বলেছেন, তোমরা জাগো, ভারত মা তোমাদের ডাকছে।দেহচর্চা করো, তোমরা বলিষ্ঠ হও, সাহসী হও। তিনি কিন্তু কোথাও কখনো কোন যুবকের উদ্দেশ্যে বলেন নি তোমরা জপতপ কর, ঈশ্বর সাধনা করো, মঠ মসজিদ বানাও। এখানেই বিবেকানন্দের দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম। বিবেকানন্দের ভারতবর্ষ শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী এক মানবচেতনা, এই বিশ্বত্ব ভারতীয়ত্বের  মূলকথা। বিবেকানন্দ আমাদের একই সঙ্গে ভারত চেতনা ও বিশ্বদর্শনের বানী শুনিয়েছেন এবং চেয়েছেন ঐ পথে আমাদের জীবনধারা প্রবাহিত হোক।এতবছর আগে ভারতের জনমানব ও মননকে বিবেকানন্দ যেইভাবে বুঝেছিলেন তা আজও একই ভাবে বিদ্যমান । গোটা পৃথিবীর এই সংকটময় পরিস্থিতিতে এবং দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে স্বামীজীর মত দেশপ্রেমিকের আজ আমাদের বড়ই প্রয়োজন।


সুস্মিতা এস দেবনাথ

ত্রিপুরা

আরশিকথা গ্লোবাল ফোরাম



আরশিকথা হাইলাইটস

১২ই জানুয়ারি ২০২২

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.